কলকাতার ১০টি সেরা “বিরিয়ানি হাউস”
বহু ভোজন রসিক বাঙালির কাছে ভালোবাসার অপর নাম বিরিয়ানি। কলকাতার বিরিয়ানির স্বাদ পৃথিবীর যেকোনো বিরিয়ানির স্বাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, বিশেষ করে বিরিয়ানির আলু, আহা! এ স্বাদের তুলনা হয় না। অনেক প্রবাসী বাঙালিরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন নিজের দেশে ফেরেন তখন এই স্বাদ নিতে তারা পৌঁছে যান কলকাতার নামকরা বিরিয়ানি হাউসগুলিতে। আর বিরিয়ানি প্রেমী কলকাতাবাসীদের বেশিরভাগ উইকেন্ডগুলো কাটে শহরের বিভিন্ন বিরিয়ানি হাউসে। তবে শুধু বাঙালি নয়, অবাঙালি থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের মানুষের মনও জয় করে নিয়েছে কলকাতার বিরিয়ানি। কলকাতার ১০টি নামকরা “বিরিয়ানি হাউস” ও তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিয়ে আজ হাজির হয়েছি সমস্ত বিরিয়ানি প্রেমীদের জন্য।
আরসালান
কলকাতার একটি অন্যতম “বিরিয়ানি হাউস” হল আরসালান। এই রেস্তোরাঁটিতে গিয়ে বিরিয়ানি না খেয়ে ফিরে আসা এক কথায় অসম্ভব। স্বাদ ও গন্ধে অপূৰ্ব এই মুঘলাই ডিসটি খাওয়ার জন্য আপনি বার বার এখানে আসতে বাধ্য হবেন।
২০০২ সালের ৬ই অক্টোবর আরসালানের প্রথম শাখাটি খোলা হয় পার্ক সার্কাসের ৭ পয়েন্ট ক্রসিংয়ে, তারপর একে একে আরও অনেক শাখা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন প্রান্তে। রুবি বাইপাস, হাতিবাগান, রাজারহাট, যশোর রোড, রিপন স্ট্রিট, ব্যারাকপুরে আরসালানের অন্যান্য শাখাগুলি অবস্থিত। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আরও অন্যান্য জায়গা সহ বিদেশেও (দুবাই) এর শাখা ছড়িয়ে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই আরসালান সোদপুর ও যাদবপুরে আরও দুটি নতুন শাখা খুলতে চলেছে। ভিন্ন স্বাদ ও মূল্যের নানান ধরণের বিরিয়ানি আপনি পেয়ে যাবেন এই রেস্তোরাঁটিতে।
আমিনিয়া
আমিনিয়া কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় একটি “বিরিয়ানি হাউস“। এই রেস্তোরাঁর প্রথম শাখাটি ১৯২৯ সালে খোলা হয়েছিল। তারপর এই রেস্তোরাঁটি ধীরে ধীরে মুঘলাই খাবারের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। মানুষের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে এর শাখার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে আমিনিয়া নিজের শাখা বিস্তার করেছে। যশোর রোড, শ্যামবাজার, বেহালা, ব্যারাকপুর, সোদপুর, নিউ মার্কেট, রাজারহাট এবং শ্রীরামপুরে আমিনিয়ার মোট আটটি শাখা রয়েছে।
সাধ্যের মধ্যে জিভে জল এনে দেওয়া বিরিয়ানির স্বাদ পেতে হলে অবশ্যই চলে আসুন আপনার নিকটতম আমিনিয়ার শাখাটিতে।
সিরাজ
হেরিটেজ তকমা পাওয়া সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁ বহু যুগ ধরে কলকাতায় মুঘলাই খানার জন্য বিখ্যাত। এই রেস্তোরাঁর একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। ১৯৪১ সালে মহম্মদ আরশাদ আলি এবং মহম্মদ হুসেন বিহার থেকে কলকাতায় আসেন এবং এখানে এসে তাদের আলাপ হয় মহম্মদ সামসুদ্দিনের সাথে। মহম্মদ সামসুদ্দিন ছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের খাস বাবুর্চির বংশধর। এই তিন জন মিলে সিরাজ রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৬ সালে এই রেস্তোরাঁর নাম হয় সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁ। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিট, ভিআইপি নগর ও অজয় নগরে সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁর মোট তিনটি শাখা আছে। আর দেরি না করে এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁটিতে বিরিয়ানির স্বাদ নিতে সপরিবারে চলে আসুন।
বিরিয়ানি বাই কিলো
কলকাতা শহরের বুকে অবস্থিত একটি নাম করা “বিরিয়ানি হাউস” হল বিরিয়ানি বাই কিলো । এর প্রধান আকর্ষণ হল মাটির হাঁড়িতে পরিবেশন করা বিরিয়ানি, যার স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। বিবাহ বার্ষিকী হোক বা আপনার প্রিয় কারোর জন্মদিন, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের জন্য বিরিয়ানি বাই কিলোর কোনও বিকল্প নেই।
সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এর শাখা ছড়িয়ে আছে। কলকাতার গাড়িয়াহাট রোড আর সল্ট লেকে এই রেস্তোরাঁর দুটি শাখা রয়েছে।
মজার ব্যাপার হল এই রেস্তোরাঁটিতে ওজন করে বিরিয়ানি পাওয়া যায়, ১/২ কিলো ও ১ কিলোর বিরিয়ানির হাঁড়ি আপনি এখানে পেয়ে যাবেন। মনোরম পরিবেশ আর সঙ্গে বিরিয়ানি, এই অসাধারণ কম্বিনেশন উপভোগ করার জন্য চলে আসুন বিরিয়ানি বাই কিলোর যে কোন একটি শাখায়।
ঔধ ১৫৯০
বিরিয়ানির স্বাদ ও তার সাথে যদি আপনি ঐতিহ্যবাহী নবাবি ছোঁয়া পেতে চান তাহলে অবশ্যই ঔধ ১৫৯০ আপনার জন্য আদর্শ একটি রেস্তোরাঁ। শুধু খাঁটি নবাবি খাবারই না, পোশাক থেকে শুরু করে গান বাজনা সব কিছুতেই আছে প্রাচীন ঐতিহাসিক নবাবি ছোঁয়া যা আপনাকে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ এবং তাঁর খানসামারদের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
শিলাদিত্য চৌধুরী ও তার ছোট ভাই দেবাদিত্য চৌধুরী ২০১৩ সালে কলকাতাবাসীকে প্রথম পিরিয়ড ডাইনিং রেস্তোরাঁ ঔধ ১৫৯০ উপহার দেন।
উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার যেসব জায়গাগুলিতে এই রেস্তোরাঁর শাখা রয়েছে সেগুলি হল- দেশপ্রিয় পার্ক, সাদার্ন এভিনিউ, নাকতলা, সল্ট লেক, যশোর রোড, সোদপুর, মধ্যমগ্রাম, টালিগঞ্জ ক্লাব ( শুধুমাত্র ক্লাব মেম্বারদের জন্য), বেহালা।
মনোরম নবাবি পরিবেশে বসে আপনার পছন্দের খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যই চলে আসুন – ঔধ ১৫৯০ “বিরিয়ানি হাউস“।
রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল
১৯০৫ সালে কলকাতার চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল তার যাত্রা শুরু করে। এমন কোনও বাঙালি নেই যে এই রেস্তোরাঁটির নাম শোনেনি। রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল মূলত তার মটন চাঁপের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু এখানকার বিরিয়ানির স্বাদও অতুলনীয়। বিরিয়ানির সাথে রয়্যালের চাঁপ আপনার জিভে এনে দেবে এক স্বৰ্গীয় অনুভূতি।
সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত্রি ১১:৩০ অবধি এই রেস্তোরাঁটি খোলা থাকে এবং এর অন্য কোনও শাখা নেই।
রহমানিয়া
বিরিয়ানি মানেই আমরা যেটা বুঝি সেটা হল প্রচুর পরিমাণে তেল মশলা দিয়ে বানানো একটি মুঘলাই খানা। কিন্তু রহমানিয়া তার কম মশলা ও অল্প তেলের সুস্বাদু বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত। যারা খুব বেশি তেল ঝাল মশলা খেতে পছন্দ করেন না তাদের জন্য এই রেস্তোরাঁটি আদর্শ।
মহম্মদ ফারুক ১৯৮৪ সালে কলকাতার মল্লিক বাজারের কাছে রহমানিয়ার প্রথম শাখাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বালিগঞ্জ, সল্ট লেক সেক্টর ১, সল্ট লেক সেক্টর ৩, সল্ট লেক সেক্টর ৫, বেলেঘাটা, বউবাজার, পার্ক স্ট্রিট এরিয়া, বারাসাত ও তারাতলায় রহমানিয়ার মোট ৯টি শাখা রয়েছে। হালকা অথচ সুস্বাদু বিরিয়ানির স্বাদ নিতে চাইলে চলে আসুন এর যে কোন একটি শাখাতে।
জিশান
একটি ছোট রোল কর্নার থেকে জিশান তার যাত্রা শুরু করে এবং দু'দশকেরও বেশি সময় ধরে এই রেস্তোরাঁটি তার সুস্বাদু মুঘলাই খানার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে ভোজন রসিক বাঙালিদের কাছে।
বর্তমানে কলকাতার পার্ক সার্কাস, দেশপ্রিয় পার্ক, গড়িয়া ও চৌরঙ্গীতে এর মোট চারটি শাখা রয়েছে, তবে পার্ক সার্কাসের শাখাটি সব থেকে বেশি জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বেঙ্গালুরুতেও এর কিছু শাখা রয়েছে। যে সমস্ত বাঙালিরা বেঙ্গালুরুতে থাকেন তারাও অনায়াসে জিশানের বিরিয়ানির স্বাদ নিতে চলে যেতে পারেন বেঙ্গালুরুর এই শাখাগুলিতে।

প্যারাডাইস
সব সময় কলকাতার বিরিয়ানির স্বাদ নিতে নিতে একঘেয়েমি চলে এলে, স্বাদ পরিবর্তনের জন্য চলে আসুন প্যারাডাইস বিরিয়ানি হাউসে। এই রেস্তোরাঁটি হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত।
বর্তমানে হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালুরু, বিশাখাপত্তনম, গুন্টুর, অন্ধ্রপ্রদেশ, চেন্নাই, গুরুগ্রাম, বিজয়ওয়াড়া, তেলেঙ্গানা ও কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এর শাখা ছড়িয়ে আছে। কলকাতার সাদার্ন এভিনিউ ও চৌরঙ্গী ম্যানশন এই দুটি জায়গায় প্যারাডাইসের শাখা রয়েছে।
আপনি যদি কলকাতায় থেকে বিরিয়ানির স্বাদে হায়দ্রাবাদী ছোঁয়া পেতে চান, তাহলে প্যারাডাইস রেস্তোরাঁটি আপনার জন্য আদর্শ।
ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি
এই রেস্তোরাঁটি কলকাতা শহরের বুকে না হলেও শহর থেকে অল্প দূরেই ব্যারাকপুরে অবস্থিত। বহু দূর থেকে বাঙালি, অবাঙালি সকলেই এক বার হলেও দাদা বৌদির বিরিয়ানির স্বাদ নিতে চলে গেছেন শহরতলি ব্যারাকপুরে। অন্যান্য নামি-দামী রেস্তোরাঁর মত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, এর বিরিয়ানির স্বাদ অনায়াসেই যেকোনো ৫ তারা হোটেলের বিরিয়ানিকে হার মানাবে। কম দামে বিরিয়ানির অতুলনীয় স্বাদ পেতে অবশ্যই চলে আসুন এই রেস্তোরাঁটিতে।
উপরের প্রত্যেকটি বিরিয়ানি হাউসের বিরিয়ানির স্বাদ একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রতিটি রেস্তোরাঁর পরিবেশও ভিন্ন ধরণের। কোন রেস্তোরাঁয় আছে ঐতিহাসিক নবাবি ছোঁয়া তো কোনটায় আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে প্রত্যেকটি রেস্তোরাঁ তাদের জিভে জল এনে দেওয়া অতুলনীয় বিরিয়ানির স্বাদের জন্য বিখ্যাত। কলকাতা শহরের যে প্রান্তেই আপনি থাকুন না কেন, অতি সহজেই আপনি চলে যেতে পারবেন এই “বিরিয়ানি হাউস“গুলিতে, কারণ উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার মোটামুটি সমস্ত জায়গাতেই এরা নিজেদের শাখা বিস্তার করেছে। তাছাড়া জোম্যাটো ও সুইগীর যুগে আপনার কাছে একটা স্মার্ট ফোন থাকলেই বাড়িতে এসে হাজির হবে আপনার প্রিয় এই খাবারটি।
বিরিয়ানি প্রেমীদের জন্য রইল কলকাতার বিরিয়ানির ঐতিহাসিক কিছু তথ্য:
অওধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ কলকাতাকে এই নবাবি খানাটি উপহার দেন। তিনি ব্রিটিশদের কাছে নিজের সাম্রাজ্য হারিয়ে লখনউ থেকে বিতাড়িত হন এবং তাঁর শেষ জীবনটা কলকাতার মেটিয়াব্রুজ এলাকায় কাটান। তাঁর সাথে তাঁর প্রিয় কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীত শিল্পী ও বাবুর্চিরাও কলকাতায় চলে আসেন। অর্থাভাবের ফলে তিনি তাঁর বাবুর্চিদের বিরিয়ানিতে মাংসের পরিবর্তে আলু এবং তুলনামূলক কম মশলা ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। আর এখন বাঙালিরা সেই আলু ছাড়া বিরিয়ানির কথা ভাবতেই পারে না। আজ থেকে দু'দশক আগেও কলকাতার অলিতে গলিতে বিরিয়ানি পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন ভূতের রাজার বরে হাততালি দিলেই হাজির হয়ে যায় এই সুস্বাদু মুঘলাই খাবারটি।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Pingback: কলকাতার বুকে ১৫টি বিখ্যাত খাবারের সেরা ঠিকানা - Kuntala's Travel Blog