পশ্চিমবঙ্গের ১০টি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান
ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে বিচার করলে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষস্থানীয় রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। এই রাজ্যের বিভিন্ন স্থান আজও বাংলার বহু প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। আজকে আমার লেখনীতে রইল এই রকমই ১০টি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান যা আমাদের সামনে অতীতের কাহিনীগুলি তুলে ধরে।
মুর্শিদাবাদ
স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের নামানুসারে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বতন্ত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে সংঘটিত ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধের সাক্ষী এই স্থান। মুর্শিদাবাদের সেরা আকর্ষণ হাজারদুয়ারি প্যালেস। ১৮৩৭ সালে নবাব নাজিম হুমায়ুন খাঁয়ের শাসনামলে এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়। মোট ১০০০টি দরজা থাকায় এই প্রাসাদের নামকরণ করা হয় হাজারদুয়ারি, যার মধ্যে আদপে ৯০০টি দরজা ও বাকি ১০০টি নকল দরজা। বর্তমানে এই প্রাসাদটি প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া এখানে খোশবাগ, বড় ইমামবাড়া, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, নশিপুর প্যালেস, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ী সহ বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে যা আজও তৎকালীন মুঘলদের জীবনধারার ছবি আমাদের কাছে তুলে ধরে।
কোচবিহার
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে অবস্থিত এই জেলায় এক সময় কোচ রাজবংশের রাজারা নিজেদের রাজত্ব চালিয়েছেন। প্রাচীন ভাস্কর্য, মন্দির ও মসজিদগুলির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় এখানকার রাজকীয় অতীত। বর্তমানে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে কোচবিহার রাজবাড়ি। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের শাসনামলে নির্মিত এই প্রাসাদটি লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। তাঁর শাসনকালেই এখানকার প্রসিদ্ধ পীঠস্থান মদনমোহন মন্দির নির্মিত হয়। মহারাজা হীরেন্দ্র নারায়ণের আমলে নির্মিত হয় সাগর দীঘি। এছাড়া বাণেশ্বরের শিব মন্দির এখানকার আরও একটি বিশিষ্ট দ্রষ্টব্য। কোচবিহারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানগুলির থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এখানকার ইতিহাস ও জনস্মৃতি এবং ভাষার বর্ণালী অনেক বেশি প্রাণবন্ত। এই সুন্দর সাজানো শহরটি পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে এক আলাদাই জায়গা করে নিয়েছে।
মালদহ
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার মালদহ শুধুমাত্র আমের জন্যই নয়, বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান হিসেবেও বিখ্যাত। পূর্বে ইংলিশ বাজার নামে পরিচিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটি। মালদহের দক্ষিণে গৌড় এবং উত্তরে অবস্থিত পাণ্ডুয়া তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত।
প্রাচীন বাংলার তিনটি রাজবংশ পাল, সেন ও নবাবদের রাজধানী ছিল গৌড়। বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় এই ছোট শহরটিতে। লুকোচুরি গেট, ফিরোজ মিনার সহ বহু ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য রয়েছে এই জায়গাটিতে।
পাণ্ডুয়ার প্রধান আকর্ষণ সুলতান সিকান্দার শাহের নির্মিত আদিনা মসজিদ, যেটি ভারতের একটি অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। এখানকার অন্যান্য দ্রষ্টব্যগুলি হল একলাখী সমাধিসৌধ, সালামি দরওয়াজা, বড়ি দরগাহ, ছোটি দরগাহ, ইত্যাদি।
কলকাতা
কলকাতার সমৃদ্ধশালী ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের রাজধানী ছিল এই কলকাতা। এই শহরের প্রতিটি কোণায় রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে শুরু করে ফোর্ট উইলিয়াম, শহিদ মিনার, মার্বেল প্যালেস, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, রাইটার্স বিল্ডিং সহ আরও বহু স্থাপত্য রয়েছে এই শহরের বুকে। উত্তর কলকাতার বহু বসত বাড়িতে রয়ে গেছে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া, যেইগুলি কল্লোলিনী তিলোত্তমার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে আজও বহন করে চলেছে।

চন্দননগর
হুগলী জেলার একটি মফস্বল এলাকা চন্দননগর তার ঔপনিবেশিক অতীতের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। চন্দননগর প্রথমে বাংলার নবাবদের শাসনাধীনে ছিল যা পরবর্তীকালে ফরাসিদের উপনিবেশে পরিণত হয়। ব্রিটিশদের আগমনের পর ফরাসি ও ব্রিটিশদের মধ্যে বহুবার চন্দননগরের সিংহাসনের হস্তান্তর ঘটে এবং অবশেষে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশে পরিণত হয়। আমরা বহু বাংলা সাহিত্যে প্রায়শই এখানকার বিখ্যাত পাতাল বাড়ির উল্লেখ পেয়ে থাকি। এই বাড়ির একটি অংশ হুগলী নদীতে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এখানকার অন্যান্য দ্রষ্টব্যগুলির তালিকায় রয়েছে চন্দননগর মিউজিয়াম, স্যাক্রেড হার্ট চার্চ, নন্দদুলাল মন্দির ও চন্দননগর স্ট্র্যান্ড।
কালিম্পং
পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট হিল স্টেশন কালিম্পং তার মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ, গির্জা এবং তিব্বতি হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। একসময় এই শহর দিয়েই ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত। স্থানীয় লোকেদের থেকে জানা যায় এই অঞ্চলটি পূর্বে ভুটানি রাজাদের শাসনাধীন ছিল। জাং ডং পালরিফো ব্রাং গোম্পা, থংসা গোম্পার মতো স্থাপত্যগুলি আজও ভুটানের সেই ইতিহাসকে চিহ্নিত করে।
বাঁকুড়া
বাঁকুড়ার ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখলে মিলবে এখানকার মল্ল রাজাদের কাহিনী। পূর্বে বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল মল্লভূম নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বাঁকুড়া থানার মূল অঞ্চলটি (ছাতনা, ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস ব্যতীত) মল্লভূমের অন্তর্গত ছিল। যদিও সংস্কৃত ভাষায় ‘মল্ল' শব্দের অর্থ কুস্তিগির, কিন্তু এই অঞ্চলের মাল উপজাতির নামের সাথে এই নামের কিছু সংযোগ থাকার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হয়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ভারতে ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তারের প্রাক্কাল পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে হিন্দু রাজাদের উত্থান ও পতনের সাথে এই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। তৎকালীন হিন্দু রাজাদের শাসন কালে নির্মিত শ্যাম রাইয়ের পঞ্চরত্ন মন্দির, জোড়বাংলা মন্দির, মদনমোহন মন্দিরের মতো বহু প্রাচীন বাংলার নান্দনিক মন্দির স্থাপত্য পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে বিষ্ণুপুরকে আজ অনন্য করে তুলেছে।
চন্দ্রকোনা-গড়বেতা
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় অবস্থিত চন্দ্রকোনা অর্ধ সহস্রাব্দেরও বেশি পুরানো একটি জনপদ। হিন্দু রাজত্বের বহু দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এখানকার ইতিহাসের কাহিনী তুলে ধরে। এছাড়া কিছু হিন্দু পুরোহিতদের আস্তানার ধ্বংসাবশেষ ও শিখদের উদাসিনী মঠও এখানে দেখতে পাওয়া যায়। মল্ল রাজাদের রাজত্বের বহু চিহ্ন এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে।
চন্দ্রকোনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গড়বেতা অতীতে একটি সমৃদ্ধশালী নগর ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজপুত রাজা গজপতি সিং স্থানীয় অনার্য শাসকদের পরাজিত করে এই অঞ্চলে নিজের রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর শাসনামলে রায়কোটা দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। শিলাবতী নদীর তীরে সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায়।
নবদ্বীপ
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপ ধাম একটি অতি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এই অঞ্চলটি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান। শুধুমাত্র ধার্মিক স্থান হিসেবেই নয় বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান হিসেবেও এই অঞ্চলটি বিখ্যাত। সেন রাজাদের আমলে বাংলার রাজধানী ছিল এই নবদ্বীপ। ১২০২ সালে রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালে বখতিয়ার খলজি নবদ্বীপ দখল করেন, সেই সময় থেকে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে এখানকার পণ্ডিতদের সহায়তায় নবদ্বীপ সংস্কৃত চর্চা ও বিদ্যালাভের পীঠস্থান হয়ে ওঠে এবং ‘বাংলার অক্সফোর্ড'-এর শিরোপা অর্জন করে। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে নবদ্বীপকে হেরিটেজ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বর্ধমান
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে এই স্থানের নাম ছিল বাধ-ই-দেওয়ান, যার অর্থ জেলা সদর। বর্ধমানের মহারাজাদের সদর দপ্তর ছিল এই শহর। মোঘল আমল হোক অথবা ব্রিটিশ রাজ, বাংলার ইতিহাসে এই শহরটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই শহরের মাটিতে আজও বাংলার গৌরবময় অতীতের ছাপ রয়ে গেছে। এখানকার দ্রষ্টব্যগুলির তালিকায় রয়েছে বর্ধমানের প্রবেশদ্বার কার্জন গেট, বর্ধমান রাজবাড়ী, পীর বাহারামের মাজার, শের আফগানের সমাধি, কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দির ইত্যাদি।
দিন বদলায়, যুগ বদলায়, শুধু অতীতের সাক্ষী রয়ে যায় কিছু ইট, কাঠ, পাথরের তৈরি ইমারত। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আপনিও যদি অতীতের রোমাঞ্চকর কাহিনীগুলির সাক্ষী হতে চান তাহলে উল্লিখিত জায়গাগুলির ইতিহাসের গলিপথে একবার হেঁটে আসুন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.