৫টি বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা

বৃষ্টির কোমল স্পর্শে প্রকৃতি যেন তার প্রাণ ফিরে পায় ও সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নিজের পেখম মেলে ধরে। শ্রাবণের অঝোর ধারার শব্দ আর বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, তার সাথে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আমাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। তবে বর্ষায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় সেই নিয়ে ভারী সমস্যায় পড়তে হয়। এই মুশকিল আসান করার জন্য আজকে বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা ও সেই জায়গাগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিয়ে চলে এসেছি প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের জন্য।

মুকুটমণিপুর

বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা মানেই প্রথমে যে জায়গাটির কথা মনে পড়ে তা হল বাঁকুড়া জেলার মুকুটমণিপুর। সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই জায়গাটিতে কংসাবতী বাঁধ অবস্থিত, যেটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ। এই বাঁধটি মুকুটের ন্যায় অসংখ্য টিলা দ্বারা বেষ্টিত। ঋতুরানী বর্ষার সাজে এই বাঁধের সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। আপনি অনায়াসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে। আর যদি ছবি তোলা আপনার প্যাশন হয়, তাহলে বর্ষার দিনে মুকুটমণিপুরের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যগুলিকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারেন। কখনও কালো মেঘের সাথে কখনও বা বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সবুজ-কমলা ল্যান্ডস্কেপের ছবিগুলি স্মৃতিচারণের জন্য একদম আদর্শ।

এখানে থাকার জন্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সোনাঝুরি রিসোর্টটি বেশ ভালো।  

মুকুটমণিপুরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল মুসাফিরানা ভিউপয়েন্ট, পরেশনাথ শিব মন্দির, বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক, নোয়াডিহি সানসেট পয়েন্ট, অম্বিকানগর রাজবাড়ি ও অম্বিকা মন্দির।

কিভাবে যাবেন

কলকাতা-বাঁকুড়াগামী ট্রেনগুলি নিয়মিত ভিত্তিতে উপলভ্য। বাঁকুড়ায় পৌঁছে সেখান থেকে ক্যাবে বা বাসে করে মুকুটমণিপুর যেতে হবে।

বাঁকুড়া জেলার সাথে কলকাতা ও তার আশেপাশের শহর সহ রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলগুলিও সড়কপথে সংযুক্ত হওয়ায় বাসে অথবা নিজস্ব গাড়ি করেও আপনি পৌঁছে যেতে পারেন এই জায়গাটিতে।

গড়পঞ্চকোট

বৃষ্টিস্নাত শাল, পিয়াল আর ঘন মহুয়ার জঙ্গল, পাহাড় ও পুরানো দিনের অপূর্ব স্থাপত্যকলা সব মিলিয়ে এই লাল মাটির দেশ বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা হিসেবে পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

৯০ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচজন আদিবাসী সর্দারের সহায়তায় রাজা দামোদর শেখর এখানে নিজের রাজত্ব গড়ে তোলেন। তারপর থেকেই ইতিহাসের পাতায় এই জায়গাটির নাম হয় “গড়পঞ্চকোট”। অতীতে এখানে প্রচুর পোড়ামাটি ও পাথরের মন্দির গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে তারমধ্যে শুধুমাত্র দু-একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনদপ্তরের বাংলোগুলি থেকে আপনি এখানকার গহীন জঙ্গলের সৌন্দর্যকে আরও কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন।

এখানে বড়ন্তি হ্রদ, পাঞ্চেত বাঁধ, মাইথন বাঁধ, জয়চন্ডী পাহাড়, পঞ্চরত্ন মন্দির, কঙ্কালী মাতার মন্দির, আদি কল্যাণেশ্বরী দেবী মন্দির, রানিমহল সহ আরও অনেকে দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

কিভাবে যাবেন

রেলপথে বরাকর স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি করে কিছু দূর গেলেই গড়পঞ্চকোট।

সড়কপথে প্রথমে বাসে করে আসানসোল আর সেখান থেকে গাড়ি করে আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্যে। 

বেলপাহাড়ি-কাঁকড়াঝোড়

বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা হিসেবে বেলপাহাড়ি পর্যটকদের বেশ আকর্ষণ করে। বৃষ্টিকে সঙ্গী করে নির্জনতার সাথে বন্ধুত্ব করতে আপনি চলে আসতে পারেন এই জায়গাটিতে। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরে বেলপাহাড়ি অবস্থিত। বেলপাহাড়ির জঙ্গলে দেখা মিলবে শাল, পিয়াল, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাস সহ আরও নানা ধরনের গাছ গাছড়ার।

বেলপাহাড়ি থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার গেলেই কাকঁড়াঝোড়। শাল, সেগুন, মহুয়া, কুসুম, আকাশমণি গাছের সাথে সাথে আপনি এখানে কফি, কাজুবাদাম, কমলালেবুর গাছও দেখতে পাবেন।

এছাড়া ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, ঘাঘরা, গাডরাসিনী পাহাড়, লালজল গুহা, গোপীবল্লভপুর ইকো ট্যুরিজম পার্ক, চিল্কিগর রাজবাড়ি, রামেশ্বর মন্দির, ঝিল্লির হ্রদ, চিল্কিগড়ের কনকদূর্গা, ডিয়ার পার্ক সহ আশেপাশে আরও অনেক টুরিস্ট স্পট আছে।

রাজকীয় পরিবেশে কয়েকটা দিন কাটাতে চাইলে আপনি ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে রুম বুক করতে পারেন।

কিভাবে যাবেন

হাওড়া অথবা টাটানগর থেকে এক্সপ্রেস বা লোকাল ট্রেন ধরে আপনি পৌঁছে যাবেন ঝাড়গ্রামে। জাতীয় সড়ক ৬ (মুম্বাই-কলকাতা মহাসড়ক) দ্বারা কলকাতার সাথে ঝাড়গ্রাম সংযুক্ত। সড়কপথে মাত্র ৪ ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন ঝাড়গ্রাম।

মন্দারমনি

পূর্ব মেদিনীপুরের অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এই সমুদ্র সৈকতটি দীঘা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে বছরের সব সময়ই পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে, তবে বৃষ্টিস্নাত মন্দারমনি আপনাকে দেবে এক আলাদা অনুভূতি। নির্জনতার মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ আর সাথে মাছ ভাজা আর কাঁকড়া সব মিলিয়ে সপ্তাহান্তের দুটি দিন বেশ জমে যেতে পারে এই সমুদ্র সৈকতটিতে।

মন্দারমনির রিসোর্টগুলি সমুদ্র সৈকতের খুবই কাছে, তাই এই রিসোর্টগুলি থেকে সমুদ্রের সম্পূর্ণ সৌন্দর্যকে আপনি উপভোগ করতে পারবেন।

মন্দারমনি থেকে আপনি চলে যেতে পারেন তাজপুর, দীঘা, শঙ্করপুর, উদয়পুর, তালসারি ও  চাঁদপুর সমুদ্র সৈকতে।

কিভাবে যাবেন

রেলপথে হাওড়া স্টেশন থেকে রামনগর বা কাঁথি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে ভ্যান রিকশা করে চলে  যাবেন সোজা মন্দারমনি।

সড়কপথে দীঘাগামী বাসে করে চাউলখোলায় নেমে সেখান থেকে ভ্যান রিকশা করে পৌঁছে যাবেন এই সমুদ্র সৈকতটিতে।

তবে নিজস্ব গাড়ি করে গেলে আপনি আশেপাশের জায়গাগুলিও অনায়াসে ঘুরে আসতে পারবেন।

লেপচাজগত

বাংলার সেরা বর্ষার জায়গা আর যদি সেটা পাহাড় হয় তাহলে এই অফবিট জায়গাটির কোন তুলনা হয় না। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের সৌন্দর্য কোন রাজকন্যার থেকে কম নয়। চারিদিকে সবুজ কার্পেটে মোড়া পাহাড় ঘেরা এই নির্জন ছোট্ট গ্রামটিতে বর্ষার দিনে চলে মেঘ ও কাঞ্চনজঙ্ঘার লুকোচুরি খেলা। এই গ্রামটি বিখ্যাত হিল স্টেশন দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে “লেপচা” উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করেন, সেখান থেকেই এই জায়গাটির নাম হয়েছে লেপচাজগত।

এই গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দুধারে দেখতে পাবেন পাইন, ওক ও রডোডেনড্রনের সারি আর বিশাল বিশাল চা বাগান। বিরল প্রজাতির অর্কিড ছাড়াও প্রচুর বাহারি ফুল ও পাখির সমাহার দেখতে পাবেন এই ছোট্ট গ্রামটিতে। এখানে ঘুরতে এলে ক্যামেরা ও বাইনোকুলারকে নিজের সব সময়ের সাথী বানিয়ে নেবেন। গাছের পাতায় বৃষ্টির কনসার্ট আর সাথে এক কাপ দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতির কোলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে আড্ডাটা কিন্তু বেশ ভালোই জমে উঠবে।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের রিসোর্টগুলি আপনি বুক করতে পারেন, তাছাড়া এখানে অনেক হোমস্টের ব্যবস্থাও রয়েছে।   

হাতে যদি একটু বেশি সময় নিয়ে আসেন তাহলে একইসাথে ঘুরে নিতে পারেন কালিম্পং, কার্শিয়াং, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম, মিরিকের মতো জায়গাগুলি।  

কিভাবে যাবেন

রেলপথে উত্তরবঙ্গগামী যেকোনো ট্রেন ধরে প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি (এনজিপি) স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি করে আপনি সোজা পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্যে। এছাড়া সড়কপথে নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসে করেও এনজিপি পর্যন্ত আসতে পারেন।

কর্মব্যস্ততার ফাঁকে কিছুটা প্রশান্তির খোঁজে এই বর্ষার দিনেও মন চায় কংক্রিটের শহর থেকে বহুদূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। কিন্তু কয়েকটা জিনিস অতি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে ঘুরতে যাওয়ার সময়। প্রথমত, সাথে অবশ্যই একটা ছাতা ও বর্ষাতি রাখবেন। হিল জুতো নৈব নৈব চ। ওয়াটারপ্রুফ স্নিকার্সকে বেছে নিতে পারেন আপনার চলার সঙ্গী হিসেবে আর সাথে যে ব্যাগ ক্যারি করবেন সেটাও যেন ওয়াটারপ্রুফ হয়। বৃষ্টির দিনে সুতির বদলে সিন্থেটিকের জামাকাপড় পড়া উচিত, কারণ তা ভিজে গেলেও খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। যদি আপনার গন্তব্য পাহাড় হয়, তাহলে অতি অবশ্যই ধ্বসপ্রবণ এলাকাগুলিকে এড়িয়ে চলুন।

আশা করি এই বর্ষায় আপনি আর নিজেকে গৃহবন্দী করে না রেখে মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিজের ডানা মেলে দেবেন।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: