আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩
‘আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই'
সৃজনশীল শিল্পী ও গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই গানটির মাধ্যমে নিজের মাতৃভাষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অপরূপ ভাব প্রকাশ পায়, যা প্রতিটি আদর্শ বাঙালির অন্তরের কথা।
আজকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি', এই দিনটি সারা বিশ্ব জুড়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটির পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক কাহিনী, যে কাহিনী একদিকে যেমন বেদনাদায়ক অপর দিকে তেমনই গৌরবের। ২৪তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আমার লেখনীতে আপনাদের জন্য রইল সেই ঐতিহাসিক কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
মাতৃভাষা
মূল প্রসঙ্গে আসার আগে মাতৃভাষা সম্বন্ধে দু'চার কথা বলে নেওয়া যাক।
মনের ভাব প্রকাশের জন্য আমরা ভাষার ব্যবহার করে থাকি। আর মাতৃভাষার মাধ্যমে সেই ভাব প্রকাশ যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা সম্ভব এবং ইহা যা সন্তুষ্টি প্রদান করে সেই উপলব্ধি অন্য কোন ভাষার দ্বারা কখনই সম্ভব নয়।
মা যেমন একটি শিশুর জন্ম দিয়ে তাকে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দেয়, ঠিক তেমন ভাবেই একটি ভাষা ভাব বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে তাকে সুযোগ করে দেয় তার ছোট্ট পৃথিবীর আপন মানুষগুলির কাছে পৌঁছে যাবার। তাই একটি শিশু সর্বপ্রথম যে ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষা মায়ের মতোই আপন, যাকে আমরা ‘মাতৃভাষা' হিসেবে সম্বোধন করি।
২১শে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য
‘একুশে ফেব্রুয়ারি' সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে একটি গৌরবময় দিন। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, বাঙালি তার মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে জীবন দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আমরা প্রত্যেকটি বাঙালি সেই ভাষা শহীদদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব, সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ববঙ্গ থেকে সেই প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেন। তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।
অবহেলিত বাংলা ভাষা
দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। এই রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশে সূচনা হয় এক তুমুল আন্দোলনের। পাকিস্তানের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া স্বত্বেও উর্দুকে তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত চলতে থাকে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স উদ্যানে উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। তার কিছুদিন পর তিনি আবারও একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। এই ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা সহ্য করতে না পেরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান।
৫২-র ভাষা আন্দোলন
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া আন্দোলনের জোরদার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালে। এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে মূলত দেশের ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে সমগ্র দেশবাসী এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ডিরেক্টরগণ যতই বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে থাকে, ততই এই আন্দোলনের আগুন তীব্র হয়ে ওঠে। সমগ্র দেশবাসীর সমর্থনে ছাত্রদের মনোবল ও দৃঢ়তা বহুগুণ বেড়ে যায়।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে সমগ্র দেশবাসী জোরদার আন্দোলন শুরু করেন। ঢাকায় একমাসের জন্য জারি হয় ১৪৪ ধারা। সমস্ত মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারপর তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তায় মিছিল বের করে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' এই স্লোগান ছিল প্রতিটি ছাত্রের মুখে। পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে সালাম, জব্বার ও রফির মতো বহু ছাত্রের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে রাজপথের বুকে। এই ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও বলিদান এই আন্দোলনের বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। মাতৃভাষার প্রতি এই অনাচার দেখে আলোড়িত হয়ে ওঠে কবি সমাজ। তাদের কলম হয়ে ওঠে এই আন্দোলনের আরও এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রাপ্তি
কোন বাধাই ভাষা আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি, পারেনি বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসাকে কমাতে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সমগ্র দেশবাসীর অন্তরে জ্বালিয়ে তোলে বিক্ষোভের আগুন। সারা দেশে এই হত্যাযজ্ঞের খবর দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণের বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তান সরকার তাদের সমস্ত রকম দমননীতি বন্ধ করতে বাধ্য হয়, আর বাধ্য হয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে। অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।
শহীদ দিবস পালন
ভাষা শহীদদের স্মরণে অধুনা বাংলাদেশে ১৯৫৩ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটি ‘শহীদ দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সর্বস্তরের মানুষ এই দিনটিতে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করেন। শোকের চিহ্ন স্বরূপ প্রত্যেকে সারাদিন কালো ব্যাজ পড়ে থাকেন। ভাষা শহীদদের রক্তস্মৃতি বিজড়িত স্থানে নির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে বাঙালির আত্মত্যাগের ও জাগরণের গৌরবময় দিন হিসেবে পালিত হয় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি'।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তি
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশ সহ ২৭টি দেশের সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে যা বলা হয়েছিল সেটি খানিকটা এইরূপ- “১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশে এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে উদযাপিত হবে।”
ইউনেস্কোর এই ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা সম্মানিত হয়েছিল এবং প্রথমবার ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'।
৫২-র ভাষা আন্দোলনে প্রত্যেকটি শহীদ আত্মত্যাগের যে বীজ বপন করেছিলেন, এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তারই সোনার ফসল। এর আগে অবধি যে মাতৃভাষা দিবস শুধু বাঙালিরাই উদযাপন করতেন, তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর এখন সমগ্র বিশ্ব জুড়ে উদযাপিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
কোন দেশের সংস্কৃতির ধারা বিকাশের জন্য সেই দেশের মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে, দিতে হবে যথাযোগ্য মর্যাদা, মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হবে বিলুপ্তির হাত থেকে।
কোন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মাতৃভাষার উপর প্রভুত্ব আরোপের মাধ্যমে সেই ভাষাকে গ্রাস করার মতো ঘৃণ্য অপরাধ কোন মতেই হতে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীর ছোট বড় প্রতিটি জাতিসত্তার মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
বাঙালি গোটা বিশ্বকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে কিভাবে নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে, দেশের সংস্কৃতিকে এবং নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে হয়।
আজ এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমার সকল বাঙালি পাঠকদের কাছে একটাই অনুরোধ, আপনারা আমাদের মাতৃভাষাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করে যান। তাদের হাত ধরেই আমাদের মাতৃভাষা জীবিত থাকবে প্রত্যেকটি বাঙালির মধ্যে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.