বাংলার বিশিষ্ট শীতকালীন পিকনিক স্পট

আমার আগের একটি প্রবন্ধে বেশ কয়েকটি শীতকালীন পিকনিক স্পট নিয়ে কথা বলেছিলাম। তবে সেই প্রবন্ধটি কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পিকনিক স্পট সম্বন্ধে ছিল। আজকের প্রবন্ধটিতে কলকাতা শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে আমরা ঘুরে আসব বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিখ্যাত পিকনিক স্পটগুলি থেকে। শহরের ব্যস্ততা ও যান্ত্রিকতার মাঝে একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পেতে মন চায় দূরে কোথাও পাড়ি দিতে। যদিও সব সময় আমাদের লং ট্যুর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু এক বা দু'দিন হাতে নিয়ে পরিবার-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে চড়ুইভাতির মজা নিতে আমরা সহজেই ঘুরে আসতে পারি কাছেপিঠের পিকনিক স্পটগুলি থেকে। চলুন তাহলে আজকে জেনে নেওয়া যাক বাংলার কয়েকটি বিশিষ্ট শীতকালীন পিকনিক স্পট সম্বন্ধে।

রসিক বিল পাখিরালয়

আজকে প্রথমে আমার উত্তরবঙ্গের পাঠকদের জন্য সেখানকার কিছু বিখ্যাত শীতকালীন পিকনিক স্পট সম্বন্ধে আলোচনা করব। প্রথমেই আমার দ্বিতীয় হোম টাউন কোচবিহারের কথায় আসা যাক। ঐতিহ্যবাহী এই রাজকীয় শহরের আনাচে কানাচে রয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট। আজকে সেই পিকনিক স্পটগুলির মধ্যে জনপ্রিয় একটি পিকনিক স্পট রসিক বিলের কথা বলব। এই জায়গাটিকে এক কথায় বলা যেতে পারে পাখিদের স্বর্গরাজ্য। শীতকালে এই পাখিরালয়ে দেখা মেলে নানান ধরণের পরিযায়ী পাখির। যদিও শুধু পাখিৱালয় বললে ভুল হবে, রসিক বিলের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এখানকার প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র, যেটি নানান ধরণের জীবজন্তুর আশ্রয়স্থল। এছাড়াও এখানে শিশুদের জন্য একটি চিলড্রেন্স পার্কও রয়েছে। সব মিলিয়ে শীতের আমেজে পিকনিকের মজা নিতে নিতে আপনার একটি দিন বেশ ভালোই কাটবে এই জায়গাটিতে।

আদিনা ডিয়ার পার্ক

গেটওয়ে অফ নর্থ বেঙ্গল ‘মালদা' একটি ঐতিহাসিক শহর। আর এই শহরের একটি বিশিষ্ট পিকনিক স্পট আদিনা ডিয়ার পার্ক। এই ডিয়ার পার্কে রয়েছে অগুনতি চিতল হরিণের বাস। এই হরিণটি মূলত বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ছাড়াও ভারতে দেখতে পাওয়া যায়।

ডিয়ার পার্ক শুনে মনে হতে পারে এখানে আপনাদের শুধু হরিণদের সাথেই আলাপ হবে। কিন্তু হরিণ ছাড়াও এখানে দেখা মিলবে নীল গাই বা ব্লু বুল এবং অসংখ্য পরিযায়ী পাখির। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি বিশালাকৃতি পাখির খাঁচা, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন চাইনিজ গোল্ডেন ফিজেন্ট ও চাইনিজ সিলভার ফিজেন্ট থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান কাকাতুয়া, ককাটেলের মতো বহু বিদেশী পাখি। সব মিলিয়ে এই স্থানটি পিকনিক স্পট হিসাবে আদর্শ একটি জায়গা। তবে এখানকার পিকনিক স্পটটি ডিয়ার পার্কের বাইরে। ডিয়ার পার্কে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে।

জয়ন্তী

শীতকালীন পিকনিক স্পট হিসাবে আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত জয়ন্তী মোটামুটি সকলের কাছেই অতি পরিচিত একটি নাম। যদিও দক্ষিণবঙ্গবাসীদের কাছে জয়ন্তী ডুয়ার্সের একটি জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন, তবে এখানে ডুয়ার্সের স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড় লক্ষ্য করা যায় মূলত চড়ুইভাতির মজা নেওয়ার জন্য। বিশেষত শীতকালে জয়ন্তী নদীর জল প্রায় শুকিয়ে গেলে শুধু দেখা মেলে ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি পাথরের। দূর থেকে হাতছানি দেয় গগনচুম্বী পাহাড়। এই রকম একটি কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালোই জমে যায়। তবে এখানে রান্না করার অনুমতি না থাকায় বাড়ি থেকে রান্না করে এনে আপনাকে খাওয়া-দাওয়া সারতে হবে।

সিকিয়াঝোরা

আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি শান্ত স্নিগ্ধ নদী সিকিয়াঝোরা। ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আপন মনে বয়ে চলেছে এই তন্বী নদী। নিস্তরঙ্গ শান্ত এই নদীতে নৌকাবিহার আপনার বনভোজনের আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। এই অঞ্চলটি ‘ডুয়ার্সের অ্যামাজন' নামে খ্যাত। ব্রাজিলের অ্যামাজনে না হয় নাই যেতে পারলেন, তবে ডুয়ার্সের অ্যামাজনের মোহময়ী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে নদীর কলকল শব্দ আর পাখিদের কূজন শুনতে শুনতে সকলের সাথে জমিয়ে বনভোজনটা আপনি চাইলেই সেরে ফেলতে পারেন।

গনগনি

উত্তরবঙ্গ থেকে চলুন এবার কয়েকটি দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত শীতকালীন পিকনিক স্পট নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা শহরের অনতিদূরেই শিলাবতী নদীর ধারে অবস্থিত গনগনির কথায় আসি। এর আগেই আপনাদের ঘুরিয়ে এনেছি অ্যামাজন থেকে। এবার পিকনিকটা যদি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে হয় তাহলে কেমন হয়? আমেরিকার বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন' কি করে গনগনিতে চলে এলো ভেবে অবাক হচ্ছেন? ভূ-প্রাকৃতিক সাদৃশ্যের কারণে গনগনি ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন' নামে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে। নদীর পাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে রুক্ষ রাঙা মাটিতে গড়ে উঠেছে একটি ছোটোখাটো ক্যানিয়ন। পাথুরে উঁচু নিচু পথ আর মাঝে মাঝে দেখা মেলে কিছু টিলার, যা ধীরে ধীরে মিশে গেছে নদীর পাড়ে। এই রকম একটি পরিবেশে শীতের রোদ গায়ে মেখে মাংস ভাতটা রসে-বশে বেশ ভালোই জমে যেতে পারে।

গাদিয়াড়া

কলকাতা থেকে মাত্র ৮৮ কিলোমিটার দূরে হাওড়ার শ্যামপুর থানার অন্তর্গত গাদিয়াড়া হয়ে উঠেছে একটি জনপ্রিয় শীতকালীন পিকনিক স্পট। দামোদর, রূপনারায়ণ ও হুগলী এই তিন নদীর সঙ্গমস্থল গাদিয়াড়া। নদীর ধারে বসে চড়ুইভাতির এক আলাদাই আনন্দ আছে। ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সাথে শান্ত মায়াবী প্রকৃতি এই স্থানটির সৌন্দর্যে এক আলাদাই মাত্রা এনে দিয়েছে। আপনি চাইলে নদীর ধারের বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজির শীতল নিবিড় ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে এখানকার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কাটিয়ে দিতে পারেন বেশ কিছুক্ষণ সময়। এছাড়া আপনি ভেসেলে করে নদীবক্ষ থেকে ঘুরেও আসতে পারেন।

টাকি

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার এই জায়গাটিতে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তবে শীতকালে সেই ভিড় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এখানে ইছামতী নদীর পাড়ে বসে অসংখ্য মানুষ চড়ুইভাতির মজা নেয়। নদীর ঠিক অপর পাড়েই রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া এখানকার গোলপাতা ফরেস্ট পর্যটকদের আকর্ষণের আরও একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এই ফরেস্টটি মিনি সুন্দরবন নামেও পরিচিত। এই ফরেস্টে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছে নিজের সরকারি পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। আপনি যদি টাকিতে রাত্রিবাস করতে চান তাহলে ইছামতীর ধারেই রয়েছে বিশ্রাম বাগানবাড়ি। আপনি চাইলে এই বাগানবাড়ির ভিতরেও চড়ুইভাতির আসর বসাতে পারেন।

ডায়মন্ড হারবার

এবার দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডায়মন্ড হারবারের একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট সম্বন্ধে আপনাদের জানাব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ডায়মন্ড হারবারের একটি বিখ্যাত পিকনিক স্পট হল পুষ্পবন। পুষ্পবনের অনতিদূরেই রয়েছে দুটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। তারমধ্যে একটি দুর্গ পর্তুগীজদের আমলে ও অপর দুর্গটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয়েছিল। আপনি যদি একজন ইতিহাস প্রেমী হয়ে থাকেন আর তার সাথে সাথে পিকনিকের আনন্দও উপভোগ করতে চান, তাহলে ডায়মন্ড হারবারের পুষ্পবন আপনার জন্য আদর্শ একটি স্থান।

পিয়ালী দ্বীপ

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আরও একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট পিয়ালী দ্বীপ। এই দ্বীপটি ‘গেটওয়ে অফ সুন্দরবন' নামেও খ্যাত। এখানে পিয়ালী নদী এসে মিশেছে মাতলা নদীর সাথে। আপনি চাইলে পিয়ালী নদীর বুকে নৌকাবিহারের আনন্দও উপভোগ করতে পারেন। সেখানে দূর থেকে দেখা মিলবে ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের। এই দ্বীপে শীতকালে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। আপনি যদি কলকাতা নিবাসী হন তাহলে সপরিবারে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পরতে পারেন পিয়ালী দ্বীপের উদ্দেশ্যে, আর সাথে সেরে নিতে পারেন চড়ুইভাতি।

আশা করি ইতিমধ্যেই আপনারা আপনাদের পছন্দসই পিকনিক স্পটটির সন্ধান পেয়ে গেছেন। আর অবশ্যই মনে রাখবেন, প্রকৃতির সৌন্দর্য বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাই চড়ুইভাতি করতে গিয়ে আমরা সকলে আমাদের পরিবেশ সচেতন মানসিকতার সাথে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবো, এই আশা নিয়ে আজকে আমি আমার লেখায় ইতি টানলাম।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

2 thoughts on “<strong>বাংলার বিশিষ্ট শীতকালীন পিকনিক স্পট</strong>

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: