বাংলার সেরা হানিমুন গন্তব্য

গুটি গুটি পায়ে, হাতে হাত রেখে, অজানা পথ ধরে প্রথমবার নিজের মনের মানুষের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত আমাদের জীবনের সেরা মূর্তিগুলির মধ্যে একটি। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আমরা অনেক জায়গায়ই ঘুরে থাকি। কিন্তু মনের মানুষটির সাথে নিরিবিলিতে কাটানো কয়েকটি দিন, তাও আবার সেটা যদি হয় হানিমুন, তাহলে জায়গাটাও হতে হবে একটু স্পেশাল।

কিন্তু বর্তমানে কর্মব্যস্ততার যুগে বিয়ের জন্য বেশকিছু দিন ছুটি নেওয়ার পর অনেকেই হানিমুনের জন্য আর লম্বা ছুটি পায়না। তাহলে কি হানিমুন ক্যান্সেল? একদমই না। সপ্তাহান্তের দু'টো দিনের সাথে আরও দু'একটা দিন কোন মতে ছুটি নিয়ে কাছেপিঠের কোন রোম্যান্টিক জায়গা থেকে আপনি অল্প সময়ের মধ্যেই সেরে আসতে পারেন আপনার স্বপ্নের হানিমুন। তাই আমার সকল নবদম্পতি পাঠক পাঠিকাদের জন্য বাংলার সেরা কয়েকটি হানিমুন গন্তব্য নিয়ে আজকের প্রবন্ধে আলোচনা করব।

লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ

পশ্চিমবাংলার কালিম্পং জেলায় অবস্থিত লাভা, লোলেগাঁও ও রিশপ রোম্যান্টিক হানিমুন অবকাশের জন্য আদর্শ। লাভা থেকে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে লোলেগাঁও পৌঁছাতে। তাই অতি সহজেই শীতল মনোরম পরিবেশে আচ্ছাদিত এই দুটি হিল স্টেশনকে আপনি একটি ট্রিপের মধ্যেই কভার করতে পারবেন। একান্তে কটেজের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অদূরে কালিম্পং শহরের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখলে আপনার দু'চোখের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে যাবে। লাভা ও লোলেগাঁও থেকে অনতি দূরেই অবস্থিত ছবির মতো সাজানো আরও একটি পাহাড়ি গ্রাম রিশপ। নেওড়া ভ্যালির একটি অংশ এই রিশপ, তাই এই গ্রামের সবটুকুই যেন সবুজে মোড়া।

ঘন কুয়াশায় প্রিয় সঙ্গীর হাত ধরে সারি সারি গাছের ভিতর দিয়ে হেটে যাওয়ার রোম্যান্টিক মুহূর্তগুলি আপনি সারা জীবন মনে রাখবেন। নানান পর্বত শৃঙ্গের মাঝে এই গ্রামটিতে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা বিরাজমান। এখানে দূর দেশ থেকে ভেসে আসা মেঘেদের শীতল চুম্বন আপনাদের দেবে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। রিশপে অবস্থিত টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট থেকে আপনার মনের মানুষটির সাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য মন ভরে উপভোগ করুন। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে পাহাড় সেজে ওঠে এক অন্যরকম সাজে, দেখে মনে হয় যেন অগুনতি জোনাকি পোকা দ্বীপ জ্বালিয়ে রেখেছে সমগ্র পাহাড় জুড়ে। শহুরে যান্ত্রিক জীবন থেকে দূরে পাহাড়ের এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য আপনার হানিমুনের কয়েকটি দিন করে তুলবে অতীব মধুর। পাহাড়ি গ্রামের নির্মল পরিবেশ ও তুষারাবৃত হিমালয়ের হাতছানি সব মিলিয়ে আপনার স্বপ্নের হানিমুন গন্তব্য হয়ে উঠবে কালিম্পং-এর এই সুন্দর গ্রামগুলি।

শ্রীখোলা

ইন্টারনেট আর মোবাইলের যুগে আমাদের কাছে একে অপরের জন্য সময় দিন দিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু হানিমুনের কয়েকটি দিন আপনি যদি আপনার মনের মানুষের সাথে একান্ত নিভৃতে কাটাতে চান, তাহলে শ্রীখোলা আপনার জন্য আদর্শ একটি হানিমুন গন্তব্য হয়ে উঠবে। দার্জিলিং-এর ছোট্ট একটি সাজানো গ্রাম শ্রীখোলা, যা আর পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে না আছে মোবাইলের টাওয়ার, না আছে ইলেক্ট্রিসিটি। তাই আপনার বস অথবা বন্ধু-বান্ধব চাইলেও আপনাকে বিরক্ত করতে পারবে না। আপনাদের স্বাগত জানাবার জন্য এখানে রয়েছে নিস্তরঙ্গ শান্ত তন্বী নদী শ্রীখোলা, যার উপরেই রয়েছে দুশো বছরেরও বেশি পুরনো ঝুলন্ত একটি ব্রিজ। আপনি যদি খাদ্যরসিক হন তাহলে এখানে এসে ইয়াকের মাংস আর এখানকার স্পেশাল রডোডেনড্রন ওয়াইন ট্রাই করতে একদমই ভুলবেন না। রিম্বিক থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা পেরলেই শ্রীখোলা, তাই এই ট্যুরে রিম্বিকেও কাটিয়ে আসতে পারেন একটি দিন।

সভ্যতার ছোঁয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এই জগতে কাটানো কয়েকটি দিন আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জীবন বন্দী হয়ে থাকবে।

মিরিক

দার্জিলিং-এ অবস্থিত এই রূপকথার দেশটি হানিমুন গন্তব্য হিসেবে নবদম্পতিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি হিল স্টেশন। কুয়াশা ভেজা মিষ্টি সকালে পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্যোদয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে থাকার অসাধারণ অনুভূতি আপনার হানিমুনের প্রথম দিনটিকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। প্রিয় সঙ্গীর হাত ধরে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন পাইন ও রডোডেনড্রনের গহীন অরণ্যে, মিরিকের সুমেন্দু লেকে বোটিং করতে করতে উপভোগ করতে পারেন পাহাড়ের স্নিগ্ধ মায়াবী সৌন্দর্যকে। এখানকার সবুজ কার্পেটে মোড়া চা বাগানে অথবা কমলালেবুর বাগিচায় একান্ত নিভৃতে কেটে যাবে আপনাদের বেশ কিছু সময়। তাছাড়াও এখানে রয়েছে রং-বেরঙের অর্কিডের বিশাল বাগান যা দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। এছাড়াও মিরিকের বুঙ্কুলুং, রামেটায় ধারা, বোকার মনেস্ট্রি, টিংলিং ভিউপয়েন্টের মতো বিখ্যাত জায়গাগুলি অবশ্যই ঘুরে আসবেন।

চিলাপাতা

নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে অরণ্য যেন নানা ভাষায় আমাদের সাথে কথা বলে, কখনও ঝি ঝি-র ডাক, তো কখনও কোনও অজানা পাখির কলকাকলি, আবার কখনও বন্য জীব-জন্তুর উপস্থিতির এক অদ্ভুত শব্দ। সব মিলিয়ে অরণ্যের মায়াবী পরিবেশের পরতে পরতে রয়েছে রহস্যের গন্ধ। এইরকম এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দম্পতিরা হানিমুনের কয়েকটি দিন নির্জনতাকে সঙ্গী করে কাটিয়ে আসতে পারেন চিলাপাতায়।

আলিপুরদুয়ার জেলায় তোর্সা নদীর পাড়েই অবস্থিত ডুয়ার্সের অন্যতম বৃহৎ বনাঞ্চল চিলাপাতা। তোর্সা ছাড়াও আরও অনেক ছোট বড় নদী বয়ে গেছে এই অঞ্চল দিয়ে। এখানে জঙ্গল সাফারির একটি ট্যুর অরণ্যের আদিম রূপের সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটাবে। আর রাতের অরণ্যের অপরূপ মায়াবী সৌন্দর্যের সাক্ষী থাকতে হলে বুক করে ফেলতে হবে জঙ্গলের ভেতরের একটি সরকারি লজ।

মুরুগুমা

সবুজ চাদরে মোড়া পাহাড়ের বেষ্টনে কুয়াশাচ্ছন্ন মুরুগুমা ড্যাম আপনার আর আপনার সঙ্গীর একান্ত নিভৃতে কাটানো মুহূর্তগুলি আরও স্পেশাল করে তুলবে। পুরুলিয়ার এই ড্যামটি বর্তমানে হানিমুন গন্তব্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই ড্যামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ইকো ফ্রেন্ডলি কটেজ, যেখানে আপনি প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন। প্রকৃতি যেন অতি যত্নের সাথে সাজিয়ে তুলেছে এই ছোট্ট জায়গাটিকে। আর এখনকার গ্রাম্য পরিবেশে রয়েছে সরলতার ছোঁয়া। আপনি চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন এখানকার আদিবাসী গ্রাম থেকে। আঁধার ঘনিয়ে এলে চাঁদের আলোয় মাদলের তালে আপনার সঙ্গীকে নিয়ে মেতে উঠতে পারেন আদিবাসী নৃত্যে। সব মিলিয়ে সপ্তাহান্তের দু'একটি দিন মনের মানুষের সাথে কাটানোর জন্য মুরুগুমা আদর্শ একটি জায়গা।

জুনপুট-বাঁকিপুট

সমুদ্র মানেই আমাদের কাছে দীঘা, মন্দারমণি বা তাজপুর। আর সেই কারণেই এই জায়গাগুলিতে মানুষের ভিড় প্রায় সারা বছরই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সবাই হানিমুনের জন্য খোঁজে নিরিবিলি ও কোলাহলমুক্ত জায়গা। তাই আজকে একটি অফবিট সমুদ্র সৈকত জুনপুটের সন্ধান নিয়ে হাজির হয়েছি নবদম্পতিদের জন্য। ঝাউ, ইউক্যালিপটাস, পাম ও সারি সারি নারকেল গাছে ঘেরা পূর্ব-মেদিনীপুরের এই নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতটিকে আপনি বেছে নিতে পারেন আপনার হানিমুন গন্তব্য হিসেবে। সীমাহীন দিগন্তবিস্তৃত নীল সমুদ্রের শান্ত ঢেউ আপনার এবং আপনার সঙ্গীর মনে জাগিয়ে তুলবে এক অপার শান্তির অনুভূতি। এই সমুদ্র সৈকতে আপনার মনের মানুষটির হাত ধরে লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে সূর্যাস্তের শেষ লালিমাটুকু গায়ে মেখে কাটিয়ে দিতে পারেন বেশ কিছু সময়।

আর জুনপুট থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পথ গেলেই পড়বে বাঁকিপুট। এই জায়গাগুলিতে রয়েছে বেশ কয়েটি হোম স্টে, যেখানে আপনি পেয়ে যাবেন গ্রাম্য পরিবেশের ছোঁয়া। এছাড়া শহুরে কায়দায় বানানো কিছু হোটেলও এখানে আপনি পেয়ে যাবেন। তাহলে আর দেরী না করে চটপট ব্যাগ গুছিয়ে ফেলুন এই সমুদ্র সৈকত দুটির উদ্দেশ্যে।

এছাড়াও বাংলার আনাচে কানাচে রয়েছে বহু হিল স্টেশন, মনোরম সমুদ্র সৈকত এবং সবুজে মোড়া গহীন অরণ্য। এই সমস্ত জায়গাগুলিতে প্রকৃতি যেন রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাই আপনার স্বপ্নের হানিমুন গন্তব্য খোঁজার জন্য বাংলার সীমানা পেরোনোর কোন প্রয়োজনই নেই।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

2 thoughts on “<strong>বাংলার সেরা হানিমুন গন্তব্য</strong>

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d