দুর্গা পূজার সময় কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন

দুর্গা পূজা এখন প্রায় দরজায় এসে কড়া নাড়ছে, আর তার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেছে বাঙালির পূজার প্ল্যানিং। ষষ্ঠী থেকে দশমী কোন দিন কি জামাকাপড় পরা হবে, কবে কোন রেস্তোরাঁয় কি খাওয়া-দাওয়া হবে, রাত জেগে কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখা হবে, এই সমস্ত কিছুরই ছক ইতিমধ্যেই কষে ফেলেছে প্রত্যেকটি বাঙালি। দুর্গা পূজা নিয়ে বাঙালির এই উত্তেজনা, উন্মাদনা সব সময়ই তুঙ্গে থাকে। খাওয়া-দাওয়া বা প্যান্ডেল হপিং-এর প্ল্যানটা তাও বা অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায়, তবে সাজগোজের ব্যাপারটা কিন্তু একান্তই ব্যক্তিগত। তাই পূজার শপিং শুরুর আগেই মাথায় ঘুরতে থাকে কোন দিন কীভাবে সাজবো। ছেলেদের ক্ষেত্রে যদিও এই চিন্তাটা একটু হলেও কম, কিন্তু মেয়েরা এই ব্যাপারে খুবই সজাগ। তাই পূজার কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে কোন জিনিসটা এইবার ফ্যাশনে ইন বা কোনটা আউট অফ ফ্যাশন সেটা জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। তবে শুধুমাত্র ফ্যাশন নয়, দুর্গা পূজার সাজ মানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন। সারা বছর যেমন তেমন ভাবে সাজলেও পূজার পাঁচটা দিন নিজেকে সেরা সাজে সাজিয়ে তুলতে চায় প্রত্যেকটি বাঙালি। সে হোক ষষ্ঠীর বোধন অথবা সপ্তমীর প্যান্ডেল হপিং কিংবা অষ্টমীর অঞ্জলি বা নবমীর আড্ডা অথবা দশমীর সিঁদুর খেলা। এই প্রত্যেকটা দিনের জন্য কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন তার একটা প্ল্যানিং অবশ্যই করতে হবে। এখনও ভাবছেন? কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না? এই সমস্যার সমাধান করতে বিশেষ কিছু টিপস নিয়ে আজকে আমি হাজির হয়েছি আপনাদের জন্য।

নারীরা কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন

বাঙালি নারীর সৌন্দর্য বিকশিত হয় শাড়িতে। শাড়ি শুধুমাত্র বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাকই নয় এটি বাঙালি নারীদের অহংকারের একটি বিষয়। তাঁত থেকে শুরু করে সিল্ক, জামদানি, তসর অথবা গরদ, পূজার কয়েকটি দিন আপনি নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পারেন এই সমস্ত শাড়িতে। এই শাড়িগুলি কখনই আউট অফ ফ্যাশন হয় না। আর শাড়ির সাথে চোখে কাজল বা আইলাইনার মাস্ট। তাছাড়া বাঙালিদের সাজে এক অন্য মাত্রা যোগ করে কপালের একটি ছোট্ট টিপ। পোশাক থেকে শুরু করে জুয়েলারি অথবা জুতো, টপ টু বটম কীভাবে এই পূজায় ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন চলুন সেই নিয়েই আলোচনা করা যাক।

ষষ্ঠীর সাজ

ষষ্ঠীতে আপনি বেছে নিতে পারেন হালকা হ্যান্ডলুমের শাড়ি। বর্তমানে হ্যান্ডলুম শাড়ির জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। তাই পূজার শুরুটা হ্যান্ডলুমের হাত ধরেই করা উচিত। সঙ্গে স্লিভলেস অথবা শর্টস্লিভ ব্লাউজ আপনাকে দেবে একটি ট্রেন্ডি লুক। হ্যান্ডলুম শাড়ির সাথে সিলভার অক্সিডাইজড জুয়েলারির জুটি চিরকালই সবার নজর কেড়েছে। এছাড়াও এই ধরনের শাড়ির সাথে টেরাকোটা বা ফ্যাব্রিক জুয়েলারিও অসাধারণ লাগে। সাথে খোলা চুল আর হালকা মেকআপে আপনি হয়ে উঠতে পারেন অনন্যা।

সপ্তমীর সাজ

সপ্তমীতে আপনি নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পারেন ট্র্যাডিশনাল ঢাকাই জামদানিতে। তার সাথে হাকোবা অথবা সার্টিনের লম্বাহাতা ব্লাউজে আপনি হয়ে উঠুন ফ্যাশনিস্তা। আপনার শাড়ির ডিজাইন এবং ব্লাউজের সিলেকশনের উপর নির্ভর করে বেছে নিতে পারেন গোল্ড জুয়েলারি অথবা সিলভার অক্সিডাইজড জুয়েলারি। আমাদের এখানকার আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সকালের দিকে হালকা মেকআপ করাটাই শ্রেয়। তবে রাতের মেকআপ হবে কিন্তু ঠিক এর বিপরীত। বিকেলের পর আপনি চাইলে অনায়াসেই হেভি মেকআপ করতে পারেন।

অষ্টমীর সাজ

দুর্গা পূজার বাকি দিনগুলির থেকে অষ্টমীর দিনটি বাঙালির কাছে একটু বেশিই স্পেশাল, তাই এই দিনটিতে সাজগোজের ব্যাপারটাও একটু বেশিই স্পেশাল হয়। অষ্টমীর সকালের অঞ্জলিই হোক অথবা সন্ধ্যার আড্ডা আট থেকে আশি সেজে ওঠে জমকালো সাজে। এই বিশেষ দিনটিতে কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন চলুন জেনে নেওয়া যাক তারই খুঁটিনাটি।

অষ্টমীর সকালের সাজ মানেই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, যেটি ছাড়া দুর্গা পূজা এক কথায় অসম্পূর্ণ। অষ্টমীর দিন আটপৌরে করে লাল পাড় সাদা জামদানি বা তাঁতের শাড়ির সাথে লাল রঙের পাফ-স্লিভ ব্লাউজ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, কপালে লাল টিপ, নাকে বড় নথ, গলা ভর্তি গয়না, হাতে বালা ও কানে কানবালা বা বড় ঝুমকো আপনাকে সাজিয়ে তুলবে সম্পূর্ণ সাবেকি সাজে। ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য সবার কাছে সমপরিমাণ সোনার গয়না নাও থাকতে পারে। তাই পূজার ক'টা দিন সিটি গোল্ডের গয়না দিয়ে আপনি নিজেকে ঐতিহ্যবাহী করে তুলতে পারেন অনায়াসেই। আর বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সাজ মানেই চুলে নিচু করে খোঁপা। তাতে জুঁই বা বেল ফুলের মালা আপনার সাজে নিয়ে আসবে এক অপরূপ স্নিগ্ধতা। তবে খোলা চুলেও এই সাজ কিন্তু বেশ ভালো লাগে। আপনি চাইলে পায়ে সুন্দর করে আলতাও পরতে পারেন। এই সব কিছুর সাথে একটি কোমরবন্ধনী বা চাবির গোছা আপনার অষ্টমীর অঞ্জলির সাজকে সম্পূর্ণ করে তুলবে।

নবমীর সাজ

নবমী মানে পূজার শেষ দিন। তাই এই দিনটিতে নিজেকে মনের মতো করে সাজিয়ে তুলুন। বাংলার বিভিন্ন ধরণের ঐতিহ্যবাহী সিল্কের শাড়ি যেমন বালুচরি বা কাঁথাস্টিচ আপনার নবমীর সাজে এনে দেবে এক আলাদাই মাত্রা। এছাড়াও রয়েছে কাঞ্জিভরম, ইক্কত, গাদোয়াল শাড়ির মতো নানান ধরনের সিল্কের শাড়ি। আকর্ষণীয় ব্লাউজের সাথে ঐতিহ্যগত শাড়ির মেলবন্ধন বাঙালি পোশাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জমকালো সিল্কের শাড়ির সাথে আপনি মটকা ব্লাউজ পরতে পারেন। আর এই দিনটা যেহেতু মনের মতো করে সাজার দিন তাই আপনার পছন্দসই ও মানানসই মেকআপ আর গোল্ড বা পার্ল জুয়েলারিতে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলুন। ব্যাস আর কি! জমে যাবে আপনার নবমীর লুক।

দশমীর সাজ

দশমী মানেই মা-কে বিদায় জানাবার পালা, আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার শুরু। তবে এই বিদায় জানানোর সময়ও বাঙালি মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। মা-কে মিষ্টি মুখ করিয়ে সিঁদুর লাগিয়ে বিদায় জানাতে জড়ো হয় প্রতিটি বাঙালি বধূ। আর তার সাথে সিঁদুরের রাঙা রঙে নিজেদেরও রাঙিয়ে তোলে বাঙালি নারীরা। লাল পেড়ে সাদা গরদের শাড়ি বা সম্পূর্ণ লাল রঙা শাড়িতে আপনি নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পারেন এই বিশেষ দিনটিতে। সঙ্গে নকশা করা লাল ব্লাউজ আর ট্র্যাডিশনাল জুয়েলারি আপনার দশমীর সাজকে করে তুলবে অতুলনীয়। 

জুতো

পূজায় হাই হিল বা শুধুমাত্র ফ্যাশনেবল জুতো এড়িয়ে চলাই ভালো। পূজার সময় ফ্যাশনের সাথে সাথে কমফোর্টের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে। তবে যারা হিল পরতে পছন্দ করেন তারা বেছে নিতে পারেন সামান্য উচ্চতার প্লাটফর্ম হিল। এছাড়া বিভিন্ন ট্র্যাডিশনাল ডিজাইনের ফ্ল্যাট স্যান্ডেল আপনাকে কমফোর্টের সাথে দেবে এক অসাধারণ লুক। তবে নতুন জুতো পরার আগে পায়ে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে একদমই ভুলবেন না।

পুরুষেরা কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন

বাঙালি পুরুষের ঐতিহ্যগত পোশাক

বাঙালি পুরুষের পোশাক মানেই আমাদের ধুতি ও পাঞ্জাবীর চিরন্তন জুটির কথা মনে পড়ে। দুর্গা পূজার বিশেষ কয়েকটি দিন তাই পুরুষেরা বেছে নিতে পারেন উজ্জ্বল বর্ণের ডিজাইনার ধুতি সঙ্গে এমব্রয়ডারি করা তসর অথবা সুতির পাঞ্জাবী বা ফ্যাশনেবল কুর্তা। বর্তমানে ধুতি পরতে কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীনই হতে হয় না কারণ আপনারা মোটামুটি সব দোকানেই পেয়ে যাবেন রেডি টু ওয়্যার ধুতি। এছাড়াও পায়জামার সাথে মাঝারি লেন্থের কুর্তা এই পূজায় ফ্যাশনে ইন। আর পাঞ্জাবী বা কুর্তার সৌন্দর্যে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে নেহরু জ্যাকেট। তাই এইবারের পূজায় নিজের ওয়ারড্রবে একটি নেহরু জ্যাকেটের কালেকশন রাখতে একদমই ভুলবেন না।

জুতো

বাঙালি পোশাকের সাথে কোলাপুরি অথবা নাগরা জুতোর জুটি সর্বকালের সেরা। এছাড়াও নিজেকে বাঙালি সাজে সাজিয়ে তুলতে লেদারের কমফোর্টেবল স্যান্ডেলও আপনি বেছে নিতে পারেন। 

আশা করি এইবারের দুর্গা পূজায় কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন তার মুশকিল আসান আমি কিছুটা হলেও করতে পেরেছি। সবাইকে শারদীয়ার অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি আমার এই প্রবন্ধটিতে এখানেই ইতি টানলাম।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “দুর্গা পূজার সময় কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে সাজবেন

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: