২০২৩ সালের কলকাতার সেরা দুর্গা পূজা প্যান্ডেল
আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা, শুরু হয়ে গেছে দুর্গা পূজার ফাইনাল কাউন্টডাউন। প্যান্ডেল হপিং-এর প্ল্যানিং এখন চূড়ান্ত পর্যায়। শহর কলকাতার অলিতে গলিতে সেজে উঠেছে সমস্ত দুর্গা পূজা প্যান্ডেল। আগের বছরের মতো এই বছরও আমি চলে এসেছি কলকাতার সেরার সেরা দুর্গা পূজা প্যান্ডেলগুলির সন্ধান নিয়ে। চলুন তাহলে আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক এই বছর কলকাতার কোন কোন পূজা মণ্ডপ কি কি চমক নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের জন্য।
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব মানেই প্যান্ডেলে থাকবে বিশেষ চমক সেটা আর আলাদা করে বলার কিছু নেই। আর সেই বিশেষ চমক দেখতে প্রতিবারের মতো এবারেও দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছে এই পূজা মণ্ডপটিতে। ২০২১ সালে বুর্জ খলিফা ও গতবছর ভ্যাটিকান সিটির আদলে তৈরি হয়েছিল শ্রীভূমির প্যান্ডেল। আর এবার ডিজনিল্যান্ড চলে এসেছে কলকাতায়। ৫১তম বর্ষ উপলক্ষ্যে এবারে শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের থিম “ডিজনিল্যান্ড”। ডিজনিল্যান্ডের আদলে তৈরি মণ্ডপ ও নজরকাড়া আলোকসজ্জার জন্য প্রতিবারের মতো এবারেও এই জনপ্রিয় দুর্গা পূজা প্যান্ডেল সেরার তালিকায় নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।
তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীন
পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা দিয়ে এবারে শিল্পী গোপাল পোদ্দারের হাত ধরে কাগজের ঠোঙায় সেজে উঠেছে উত্তর কলকাতার তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীনের দুর্গা পূজা প্যান্ডেল। সামান্য ঠোঙা দিয়ে যে কত সুন্দর মণ্ডপ তৈরি করা যায় তা এই পূজা মণ্ডপটি না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। এবারে ৫৮ বছরে পা রাখল তেলেঙ্গাবাগানের দুর্গোৎসব, আর এই বছর এখানকার থিম “প্রান্তজনের আত্মকথন”। রাঢ় বাংলার ঘরের মেয়েদের জীবন সংগ্রামের কাহিনীই তুলে ধরা হয়েছে এবারে তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীনের পূজায়। টুসু পরবকে ভাবনায় রেখে এখানকার সম্পূর্ণ মণ্ডপসজ্জা পরিকল্পনা করা হয়েছে।
যেখানে অন্যান্য পূজা মণ্ডপগুলিতে থার্মোকল ও প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেখানেই তেলেঙ্গাবাগান মণ্ডপসজ্জায় পরিবেশবান্ধব জিনিসের ব্যবহার করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে।
পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লি
এই বছর উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লির দুর্গোৎসব ৮৪তম বর্ষে পদার্পণ করল। আমাদের সমাজ যতই উন্নত হোক না কেন তবুও এই সমাজে বসবাসকারী কিছু মানুষের চেতনার বিকাশ কিন্তু এখনও ঘটেনি। তাই এই বছর পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লি এমন একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে যা নিয়ে সমাজে এখনও নতুন করে ভাবনার অবকাশ রয়ে গিয়েছে। এবারে এই দুর্গোৎসব কমিটি নিজেদের থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে মেয়েদের ঋতুচক্রকে। থিমের ক্যাচলাইন “ঋতুমতী”।
ঋতুচক্র ও ঋতুস্রাব নিয়ে আমাদের সমাজে রয়ে গেছে বহু কুসংস্কার। ঋতুচক্রের কয়েকটি দিন এখনও মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। মেয়েদের এই ঋতুচক্র নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটানোর একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই টিকে রয়েছে সম্পূর্ণ মানব সভ্যতা। এই কুসংস্কারমুক্ত সচেতনতামূলক বার্তাই প্রতিটি মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে চায় পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লির পূজা উদ্যোক্তারা। মণ্ডপসজ্জায় ঋতুচক্র বিষয়ক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে, আর এই সম্পূর্ণ মণ্ডপসজ্জার পরিকল্পনায় রয়েছেন শিল্পী মানস রায়।
কুমারটুলি পার্ক
এবার ৩১ বছরে পা রাখল উত্তর কলকাতার কুমারটুলি পার্কের পূজা। এই বছর এখানকার থিম “অ্যাম্বিশন”। জীবনে সকলেরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। আর বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি শিশুর জীবনের লক্ষ্য স্থির করে দেয় তার মা-বাবা আবার কোনো সময় সে নিজেই। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য কেউ বেছে নেয় সঠিক পথ আবার কেউ ভুল পথকে করে তোলে লক্ষ্যে পৌঁছাবার হাতিয়ার। কেউ কঠিন পরিশ্রমের বলে আবার কেউ কৌশল অবলম্বন করে পৌঁছে যেতে চায় তার লক্ষ্যে। শিল্পী তরুণ ঘোষের হাতের ছোঁয়ায় সমাজের ভালো ও খারাপ এই দুই দিকই ফুটে উঠেছে এবারের কুমারটুলি পার্কের মণ্ডপসজ্জায়।
টালা প্রত্যয়
প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও উত্তর কলকাতার টালা প্রত্যয় সেরার সেরা দুর্গা পূজার তালিকায় স্বমহিমায় অবস্থান করছে। এই বছর টালা প্রত্যয় ৯৮তম বর্ষে পদার্পণ করেছে এবং এখানকার এবারের থিম “কহন”। মণ্ডপসজ্জার ভাবনায় রয়েছেন শিল্পী সুশান্ত পাল। তার ২৫ বছরের শিল্প জীবনের এটি ৫০তম উপস্থাপনা। তার শিল্প যাপন বা দুর্গা যাপনের দীর্ঘ কাহিনীই তিনি এই মণ্ডপের আনাচে কানাচে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানকার মণ্ডপসজ্জা থেকে শুরু করে আলোকসজ্জা, আবহ সঙ্গীত সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের। পুরনো দিনের বনেদি বাড়ির রহস্যময় পরিবেশে হারিয়ে যেতে চাইলে আপনাদের পৌঁছে যেতে হবে টালা প্রত্যয়ের এই পূজা মণ্ডপে।
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার
কলকাতার সেরা দুর্গা পূজার তালিকায় সব সময়ই যে নামটি নিজের জায়গা করে নিয়েছে সেটি হল লেবুতলা পার্ক বা সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। আগের বছর দিল্লির লালকেল্লাকে অনুকরণ করে তৈরি হয়েছিল এখানকার প্যান্ডেল আর সাথে ছিল লাইট ও সাউন্ড শো-এর বিশেষ আকর্ষণ, দেখা গিয়েছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। এই বছরেও দর্শনার্থীদের জন্য সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে রয়েছে চোখ ধাঁধানো মণ্ডপসজ্জা। ৮৮তম দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে এইবার এখানকার থিম “অযোধ্যার রাম মন্দির”।
কলেজ স্কোয়ার
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পরই যে দুর্গা পূজা প্যান্ডেলের কথা না বললেই নয় সেটি হল কলেজ স্কোয়ারের দুর্গা পূজা প্যান্ডেল। এই বছর কলেজ স্কোয়ারের পূজা ৭৬তম বর্ষে পদার্পণ করল এবং এবার এই দুর্গা পূজা প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে কর্ণাটকের মহীশুর প্যালেসের আদলে। কলকাতার সর্বত্র যখন থিম পূজার ঘনঘটা তখন এখানকার প্রতিমা হোক অথবা আলোকসজ্জা সবকিছুতেই থাকে ষোলোআনা সাবেকিয়ানা। তাই থিমের ভিড়ে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া পেতে অবশ্যই আসতে হবে এই পূজা মণ্ডপে।
বেহালা নূতন দল
বেহালা নূতন দলের দুর্গোৎসব এই বছর ৫৮তম বর্ষে পদার্পণ করল আর এবার এখানকার থিম “তুষ্টি”। দুর্গা পূজার সাথে খাওয়া-দাওয়ার একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে। প্যান্ডেল হপিং করতে করতে রাস্তার ধারের খাবারের স্টল থেকে রোল বা ফুচকা খাওয়ার মজাটা কিন্তু একদমই আলাদা। কী ভাবছেন? হঠাৎ পূজা প্যান্ডেল বাদ দিয়ে খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গে কেন ঢুকে পরলাম? তার কারণ এবারে বেহালা নূতন দলের দুর্গা পূজা প্যান্ডেল শিল্পী অয়ন সাহার হাত ধরে সেজে উঠেছে এক অভিনব সাজে। আর অয়ন সাহার সহকারী হিসেবে এবার কাজ করেছেন দু'জন ওলন্দাজ শিল্পী মার্টিনা পেকালা এবং বেনজামিন পম্পে। এখানকার মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে বাঙালির প্রিয় ফুচকা এবং ফুচকার সাথে রিলেটেড যাবতীয় জিনিসপত্র। মণ্ডপসজ্জায় এই অভিনবত্ব দেখার জন্য দর্শনার্থীরা বহু আগে থেকেই পৌঁছে গেছেন এই পূজা মণ্ডপটিতে। আপনারাও অতি অবশ্যই একবার ঢুঁ মেরে আসুন এই ফুচকার প্যান্ডেলে।
মুদিয়ালি ক্লাব
৮৯তম বর্ষে শিল্পী বিমান সাহার হাতের ছোঁয়ায় চোখ ধাঁধানো এক চিত্রে সেজে উঠেছে দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালি ক্লাব। প্রদীপ, কাজললতা, ঘণ্টা, বেলপাতা ও পূজায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর সমাহারে সাজিয়ে তোলা হয়েছে এই মণ্ডপটিকে। মণ্ডপে প্রবেশ করলে আপনি হারিয়ে যাবেন এক অপার বিস্ময়ে। আর তাই দর্শনার্থীদের গন্তব্য তালিকায় বরাবরের মতোই এবারেও অন্যতম মুদিয়ালি ক্লাব। প্রায় প্রতি বছরই তাদের ভাবনায় নয়া চমক টেনে আনে উপচে পড়া ভিড়। এখানকার এই বছরের থিম “সমাহারে সমারোহ”। মণ্ডপে প্রবেশ করলেই প্রথমে চোখ যাবে মণ্ডপের উপরিভাগে বেলপাতা দিয়ে তৈরি বিশালাকার মহাজাগতিক মায়ের মুখের দিকে। এরপর চোখ নিচে নামলেই দেখা যাবে একের পর এক দেবদেবীর বিশাল মূর্তি, যার ঠিক মাঝখানে বিরাজমান মা দুর্গা। এছাড়াও এই বছর আলোকসজ্জায় যে অভিনবত্ব দেখা যাবে তা সত্যিই নজরকাড়ার মতো। প্রকৃত দুর্গা পূজার যে অন্তরাত্মা, সেই অন্তরাত্মার ছোঁয়াই মুদিয়ালির এই মণ্ডপের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে।
সুরুচি সংঘ
কলকাতার দুর্গা পূজাগুলির মধ্যে অন্যতম সেরা পূজা হল নিউ আলিপুর সুরুচি সংঘের দুর্গা পূজা। এবারে ৭০ বছরে পা রাখল দক্ষিণ কলকাতার এই বিখ্যাত পূজা। প্রত্যেকবারের মতো এবারেও তাদের থিমে রয়েছে অভিনবত্ব। থিমের ক্যাচলাইন “মা তোর একই অঙ্গে এত রূপ”। এবারে সুরুচি সংঘের ব্যানারে দেখা গিয়েছে পরিবেশ সচেতনতার বার্তা, যেখানে তারা পরিবেশকে বাঁচাতে সকলকে প্লাস্টিক বর্জন করার অনুরোধ জানিয়েছে। এই বছর তাদের পূজার সমস্ত ব্যানারই তৈরি হয়েছে কাপড় দিয়ে এবং ব্যবহার করা হয়েছে লেড ফ্রি কালার। শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলার হাতের ছোঁয়ায় এবারেও মণ্ডপসজ্জায় রয়েছে বিশেষ চমক।
চেতলা অগ্রণী
দক্ষিণ কলকাতার প্রথম সারির পূজাগুলির অন্যতম একটি পূজা হল চেতলা অগ্রণীর দুর্গা পূজা। চেতলা অগ্রণীর পূজা এইবার ৩১তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এখানকার পূজা মণ্ডপ এইবার সেজে উঠেছে শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনায়। এই বছর চেতলা অগ্রণীর থিম “যে যেখানে দাঁড়িয়ে”। এখানকার পূজায় এবারে দেখা মিলবে শ্রেণী বৈষম্যের চালচিত্র। এক দিকে রয়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের চিত্র আর অপরদিকে রয়েছে তাদেরই রক্ত শোষণকারী শাসকশ্রেণীর চিত্র। আমরা জীবন যুদ্ধে প্রতি নিয়ত লড়াই করে চলেছি। আর সেই লড়াই যদি সৎ পথে হয় তাহলে আমাদের জন্য রয়েছে মায়ের বিশেষ কৃপা, নচেৎ মহাশক্তির হাতেই হবে আমাদের বিনাশ। এই বার্তাই রয়েছে এই বছরে চেতলা অগ্রণীর থিমে। এই পূজায় অসুরকে দেখা যাবে ভিন্ন রূপে। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে দেবী দুর্গার কাছে সমর্পণ করতে দেখা যাবে অসুরকে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.