মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী
আজ মহালয়া। আর মহালয়া মানেই বাংলার এই নির্মল প্রকৃতি যেন প্রস্তুত হয়ে ওঠে মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনের মহালগ্ন অর্থাৎ মহালয়ার দিনটিকে দুর্গা পূজার সূচনাকাল হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনাকালে দেবী দুর্গার চক্ষুদান সম্পন্ন করা হয়। এই বিশেষ দিনটিতে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হয় দেবী বন্দনার সুর।
বাঙালির কাছে মহালয়ার আরও এক অর্থ হল বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠে “মহিষাসুরমর্দিনী”। এই অনুষ্ঠানটি বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহালয়ার প্রাতঃকালে এই সুপরিচিত সুর শোনার জন্য প্রত্যেক বাঙালি আজও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এই সুর মিশে গেছে সমগ্র বিশ্বের আপামর বাঙালির রক্তে রক্তে।
এতদিন আমরা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে যে মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী শুনে এসেছি, সেই কাহিনীই আজকে আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু। চলুন তাহলে আর বেশি দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী।

মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কারণ
মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী প্রসঙ্গে বলতে গেলে দৈত্যরাজ মহিষাসুরের প্রসঙ্গ সর্বপ্রথম উঠে আসে। মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন দেবী দুর্গা, তাই তাঁকে মহিষাসুরমর্দিনী বলা হয় সে কথা কারোরই অজানা নয়। মহিষাসুর ছিলেন অসীম ক্ষমতার অধিকারী। প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁকে বর প্রদান করেছিলেন যে তাঁকে ত্রিভুবনের কোনো পুরুষ কখনও হত্যা করতে পারবে না। ব্রহ্মার এই বরেই অপরাজেয় হলেন মহিষাসুর। দুর্ধর্ষ দৈত্যরাজ মহিষাসুরের পরাক্রমে স্বর্গের অধিকার হারিয়ে দেবগণ প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তখন ব্রহ্মা দেবগণের সেই বার্তা নিয়ে উপস্থিত হলেন বিষ্ণু ও মহাদেবের নিকট। মহিষাসুরের দুর্বিষহ অত্যাচারে সমগ্র দেবকুল যখন এই মহাসংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হল, সেই সময়ই আবির্ভূতা হলেন দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী, অসুরদলনী দেবী দুর্গা। তবে কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল দেবী দুর্গার এই মহিষাসুরমর্দিনী রূপ? চলুন জেনে নেওয়া যাক তারই কাহিনী।

মহিষাসুরমর্দিনীর সৃষ্টি রহস্য
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবতাদের সমষ্টিভূত তেজপুঞ্জ থেকে স্বরূপ ধারণ করলেন পরমা সুন্দরী দিব্যশ্রী শক্তিরূপিণী দেবী মূর্তি। এই মহাশক্তি হলেন স্বয়ং জগন্মাতৃকা দেবী মহামায়া। তিনিই ত্রিগুণা মহালক্ষ্মী, তিনিই আদ্যামহাশক্তি। দেবীর মুখমণ্ডল শ্বেতবর্ণ, নেত্র কৃষ্ণবর্ণ, অধরপল্লব আরক্তিম এবং করতলদ্বয় তাম্রাভ। দেবী কখনও সহস্রভুজা আবার কখনও বা অষ্টাদশভুজা রূপে প্রকাশিত হতে লাগলেন। দেবীর আবির্ভাবের এই শুভ বার্তা প্রকাশিত হল। সকল দেবদেবী গীতিমাল্যে বরণ করলেন মহাদেবীকে এবং রাগচন্দন দিয়ে তাঁর সেবা করলেন।

রণসজ্জায় দেবী দুর্গা
মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী দেবী দুর্গার রণসজ্জায় সজ্জিত রূপের বর্ণনা ব্যতীত অসম্পূর্ণ। চিরকাল আমরা মহিষাসুরমর্দিনীর যে রূপ দেখে এসেছি তার পিছনে যে কাহিনীটি রয়েছে চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনী।
দেবগণের অংশ সম্ভূতা দেবী দুর্গা দেবতাদের নানান অলংকারে অলঙ্কৃত ও বিবিধ অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিতা হলেন অপূর্ব রণচণ্ডী মূর্তিতে। তাঁকে হিমাচল বাহন হিসেবে সিংহ প্রদান করলেন, ভগবান বিষ্ণু প্রদান করলেন চক্র, দেবাদিদেব মহাদেব প্রদান করলেন ত্রিশূল, যমরাজ প্রদান করলেন কালদণ্ড, কালদেব প্রদান করলেন খড়গ, চন্দ্রদেব প্রদান করলেন অষ্টচন্দ্র শোভা চর্ম, সূর্যদেব প্রদান করলেন ধনুর্বাণ, বিশ্বকর্মা প্রদান করলেন অভেদবর্ম, প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রদান করলেন অক্ষমালা-কমণ্ডলু, কুবের প্রদান করলেন রত্নহার। দেবী দুর্গার এই অভিনব প্রকাশই মহিষাসুরমর্দিনীর উৎপত্তি রূপে খ্যাত।
ত্রিনয়নী, দশপ্রহরণধারিণী, দশভুজা, সিংহবাহিনী দেবী দুর্গাকে দেবতাগণ অসুর বিজয়ের যাত্রায় যাওয়ার জন্য প্রার্থনা জানালেন। যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে স্বর্গ ও মর্ত্যবাসী সকলেই দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর উপাসনা করলেন।

রণক্ষেত্রে দেবী দুর্গা
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র খ্যাত “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠানে আমরা রণক্ষেত্রে দেবী দুর্গার সহিত মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রামের যে কাহিনীটি প্রতি বছরই মহালয়ার এই শুভদিনে শুনে থাকি, সেই কাহিনীরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রইল আপনাদের জন্য।
দেবী শঙ্খ বাজিয়ে মহাবলশালী মহিষাসুরকে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন। দেবীর আহ্বানে সসৈন্যে মহিষাসুর যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করলেন। দেবী মহালক্ষ্মীর তেজপ্রভায় ত্রিলোক জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল, বিশালাকার দেবী মূর্তির মুকুট গগন স্পর্শ করেছে, তাঁর পদভারে পৃথিবী অবনত। দেবী সমস্ত দৈত্য সেনাকে তাঁর প্রবল অস্ত্র প্রহারের মাধ্যমে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। তাঁর বাহন সিংহরাজ দাবাগ্নির মতো সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু নিধনে দুর্নিবার হয়ে উঠল। যুদ্ধ চলাকালীন মহিষাসুর মায়াবলে ক্ষণে ক্ষণে তাঁর রূপ পরিবর্তন করতে থাকল। মহিষ থেকে কখনও হস্তীরূপ আবার কখনও বা সিংঘরূপী দৈত্যে পরিণত হয়ে দেবীকে ভীত ও বিমোহিত করার চেষ্টা করলেন মহিষাসুর, কিন্তু দেবী তাঁর সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। পুনরায় মহিষাসুর তাঁর স্বরূপে ফিরে এলেন। দেবী যুদ্ধক্ষেত্রে মধুপান করতে শুরু করলেন এবং মহিষাসুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন- “রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি ততক্ষণ তুই গর্জন কর। আমি তোকে বধ করিলে ইন্দ্রাদি দেবগণ এই স্থানে শীঘ্রই আনন্দধ্বনি করিবেন।” দেবীর মধুপান সমাপ্ত হলে সেই শুভক্ষণ এসে উপস্থিত হল। সমস্ত দেবগণ সাক্ষী থাকল এই চরম মুহূর্তের। মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করলেন দেবী দুর্গা, খড়গের প্রহারে তাঁর মস্তক হল ভূলুণ্ঠিত। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড। এই ছিল প্রতিটি বাঙালির অন্তরে গেঁথে থাকা সেই মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী।
তবে এই মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাবের কাহিনী ছাড়াও আরও একটি সুপরিচিত কাহিনী আমরা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠানটিতে শুনে থাকি। সেটি হল মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের কাহিনী। এই কাহিনী সম্পর্কেও আমি সামান্য আলোকপাত করলাম।

মধু ও কৈটভের কাহিনী
প্রলয়কালে সমগ্র জগৎ যখন কারণ-সলিলে পরিণত হয়েছিল তখন ভগবান বিষ্ণু সেই সলিলের উপর অনন্ত নাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হয়েছিলেন। বিষ্ণুর এই যোগনিদ্রার সময় তাঁর কর্ণমল থেকে উদ্ভূত হল দুই অসুর, মধু ও কৈটভ। এই অসুরদ্বয় বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মার কর্ম ও অস্তিত্ব বিনাশে উদ্যত হলে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করার জন্য বিষ্ণুর নয়নাশ্রিত নিরুপমা ভগবতীর স্তব করতে শুরু করলেন। ইনি বিষ্ণুনিদ্রারূপা মহারাত্রি যোগনিদ্রা দেবী।
ব্রহ্মার স্তবে জাগ্রত হয়ে বিষ্ণুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হতে বাহির হলেন প্রলয়ান্ধকাররূপিণী তামসী দেবী। দেবীর আবির্ভাবে বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভঙ্গ হল। তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্রের দ্বারা মধু ও কৈটভের শিরশ্ছেদ করে তাঁদের নাশ করলেন।
এইভাবে যখনই ত্রিভুবন সংকটের সম্মুখীন হয়েছে তখনই ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূতা হয়েছেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। সেই প্রসঙ্গে একটি শ্লোকের উল্লেখও রয়েছে এই অনুষ্ঠানটির প্রারম্ভে।
“যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।।”


Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.