দুর্গা পূজার সময় কীভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নামো নমঃ।।

সনাতন ধর্মানুসারে দেবী দুর্গা হলেন মহাশক্তি। সৃষ্টির আদি থেকে এই চৈতন্যময় মহাশক্তিই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে। যখনই ত্রিভুবন সংকটের সম্মুখীন হয়েছে তখনই মর্ত্যে দুর্গতিনাশিনী রূপে আবির্ভূতা হয়েছেন দেবী দুর্গা।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসানুসারে ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজিত। অতএব, মূর্তি বা প্রতিমার মধ্যেও ঈশ্বর বিরাজমান। তাই দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে সেই মূর্তিকে পূজা করার রীতি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আমাদের বাংলার এই পবিত্র ভূমিতে অনন্তকাল ধরে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা।

প্রচলিত ধ্যানমন্ত্রে দেবী দুর্গার রূপের যে বর্ণনা মেলে তা হল- দেবীর জটাযুক্ত কেশে শোভিত অর্ধচন্দ্র, পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় মুখে ত্রিনয়ন বিরাজমান, গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের ন্যায় হলুদাভ। নবযৌবনসম্পন্না, দশবাহু সমন্বিতা, সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা নানা অলংকারে ভূষিতা। ক্রোধে রক্তিম তাঁর চক্ষু। দশবাহুতে নানান অস্ত্র-শস্ত্রে রণসজ্জায় সজ্জিত দেবী দুর্গার পদতলে রয়েছে ছিন্ন মস্তক মহিষ এবং সেই মহিষের স্কন্ধদেশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে খড়গধারী মহিষাসুর, যাঁর হৃদয় দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ।

শৈশবকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি দেবী দুর্গার এই রূপ। চক্ষুদানের মাধ্যমে মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় দেবী দুর্গা। আজকে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু সেই সমস্ত নিয়মাচার যার মাধ্যমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর। তবে কীভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর সেই প্রসঙ্গে আসার পূর্বে আমরা জেনে নেব দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণের পদ্ধতি ও সেই সংক্রান্ত নিয়মাচার।

মহিষাসুরমর্দিনীর মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ পদ্ধতি ও নিয়মাচার

পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনের মহালগ্ন অর্থাৎ মহালয়ার দিনটিকে দুর্গা পূজার সূচনাকাল হিসেবে নির্ধারিত করা হলেও দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় তারও বহু পূর্বে। যে মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর, সেই মূর্তি নির্মাণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে কুমোরটুলির প্রতিটি মৃৎশিল্পী, যদিও বিভিন্ন জমিদার বা বনেদি বাড়িতে মূর্তি নির্মাণের কাজ হয় তাদের ঠাকুর দালানেই। বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীরা এই সমস্ত বনেদি বাড়ির দেবী মূর্তি নির্মাণ করে চলেছেন। দেবীর এই মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণের রয়েছে বিশেষ কিছু পদ্ধতি ও নিয়মাচার। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে নির্মিত হয় মহিষাসুরমর্দিনীর মৃন্ময়ী মূর্তি।

কাঠামো পূজা

শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিবস অর্থাৎ জন্মাষ্টমীর পুণ্য তিথিতে সম্পন্ন হয় দেবী দুর্গার কাঠামো পূজা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী জন্মাষ্টমীর দিন দেবকীর অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সাথে জন্ম হয়েছিল কাত্যায়নী বা মহামায়ার, যাঁকে কংস দেবকীর অষ্টম গর্ভ ভেবে আছড়ে মারতে চেয়েছিলেন। তাই জন্মাষ্টমীর এই বিশেষ দিনে দেবী দুর্গার কাঠামো পূজা করা হয়।

এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় রথযাত্রার পুণ্য তিথিতে এই কাঠামো পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ হয় দেবী দুর্গার এই কাঠামো। 

দেবী প্রতিমা নির্মাণ

প্রথমে সমগ্র দেবী মূর্তির কাঠামো যে কাঠের তক্তার উপরে থাকে সেটি নির্মাণ করা হয়। এরপর খড় ও বাঁশ দিয়ে দেবী মূর্তির কাঠামোর রূপ দেওয়া হয়। এই কাঠামোর উপর প্রথমে ধানের তুষ মিশ্রিত এঁটেল মাটির প্রলেপ লাগানো হয়। মাটির এই প্রথম প্রলেপকে বলা হয় একমেটে। এরপর বেলে মাটি দিয়ে তৈরি হয় দ্বিতীয় প্রলেপ, যাকে বলা হয় দোমেটে। দোমেটের পূর্বে এঁটেল ও বেলে মাটি মিশিয়ে নির্মাণ করা হয় দেবী প্রতিমার মুখ। এরপর রোদে শোকানো হয় এই মৃন্ময়ী মূর্তি। তারপর কাদায় ভেজানো সুতির কাপড় দিয়ে শুকিয়ে আসা দেবী মূর্তির ফাটলগুলিকে বুজিয়ে সম্পূর্ণ মসৃণ করে তোলা হয়। এরপর একে একে গড়ে তোলা হয় প্রতিমার হাত ও পায়ের পাতা। সেগুলিকে জুড়ে দেওয়া হয় মূর্তির সঙ্গে। সম্পূর্ণ দেবী মূর্তি শুকিয়ে গেলে খড়ি মাটি দিয়ে সাদা রং করা হয় মূর্তির উপর। এরপর দেবী মূর্তিকে নানান রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়। সবশেষে আঁকা হয় মায়ের চোখ। তারপর একে একে বস্ত্র পরিধান করানো হয় ও অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপ। মৃৎশিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ধৈর্য ও নিপুণতায় এইভাবে ধাপে ধাপে মৃণ্ময়ী রূপে জেগে ওঠেন মা দুর্গা।

কীভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর

নবপত্রিকা স্থাপন

বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী এবং হিন্দু শাস্ত্রে আমরা নবপত্রিকা স্থাপনের উল্লেখ পাই। মহাসপ্তমীর দিন বিশেষ ধর্মীয় রীতিতে সম্পন্ন হয় নবপত্রিকা স্নান। কোনো নিকটস্থ নদী বা জলাশয়ে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। এই বিশেষ রীতির অপর নাম হল কলাবৌ স্নান। এরপর দেবী প্রতিমার দক্ষিণ দিকে এই নবপত্রিকা স্থাপন করা হয়।

নবপত্রিকার অর্থ নয়টি উদ্ভিদ। এই নয়টি উদ্ভিদ হল দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ। নবপত্রিকা স্থাপনে যে নয়টি উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় সেইগুলি হল- কলাগাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচু গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা, হরিদ্রা গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী, বেল গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা, ডালিম গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা ও ধান গাছ; যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

এই নয়টি উদ্ভিদকে অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর রূপ দেওয়া হয়। বেল-তুলসী, চন্দন, পুষ্পমাল্য, বস্ত্রসহ মোট ষোলটি উপাচারে দেবীর এই নয়টি রূপকে নবদুর্গা রূপে পূজা করা হয়। 

মহাস্নান

নবপত্রিকা স্থাপনের পর সম্পন্ন হয় দেবী দুর্গার মহাস্নান। তবে শুধুমাত্র মহাসপ্তমীতেই নয়, মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠানের পূর্বে দেবীর মহাস্নান সম্পন্ন করা হয়। দর্পণে প্রতিফলিত দেবী প্রতিমার প্রতিবিম্বে গঙ্গাজল, সরস্বতী নদীর জল, শঙ্খজল, উষ্ণোদক (উষ্ণ জল), গন্ধোদক, কুশোদক, পুষ্পোদক, ফলোদক, শিশিরোদক, সাগরোদক, ঔষধি মিশ্রিত জল, বৃষ্টির জল, পদ্মরেণু মিশ্রিত জল, আখের রস, মধু, দুধ, পঞ্চগব্য, তিলতেল, বিষ্ণুতেল, রাজদ্বারের মাটি, চতুষ্পথ মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, গঙ্গামৃত্তিকা, সর্বতীর্থের মৃত্তিকা সহ মোট ছত্রিশ রকমের দ্রব্য দিয়ে সম্পন্ন হয় এই মহাস্নান।

মহিষাসুরমর্দিনীর চক্ষুদান

এরপর ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান পর্ব শুরু হয়। এই চক্ষুদানের পরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী মহাসপ্তমীর সকালেই এই রীতি সম্পন্ন করতে হয়। শাস্ত্রানুসারে দেবী দুর্গার চক্ষুদানের সময় কাপড় দিয়ে দেবী প্রতিমাকে ঢেকে ফেলা হয় এবং পুরোহিত ও তান্ত্রিকদের উপস্থিতিতে লেলিহান মুদ্রায় মোট একশত আট বার জপ করা হয় বীজমন্ত্র। তারপর শুদ্ধাচারে দক্ষিণ হস্তে মৃৎশিল্পীরা কুশের অগ্রভাগ দিয়ে দেবীকে কাজল পরান। তবে চক্ষুদানের রয়েছে কিছু বিশেষ বিধান। সর্বপ্রথম দেবী দুর্গার ত্রিনয়ন অর্থাৎ ঊর্ধ্বনয়নে চক্ষুদান করা হয়। তারপর প্রথমে বাম নেত্র ও পরে দক্ষিণ নেত্রে চক্ষুদান করতে হয়। প্রতিটি নেত্রে চক্ষুদানের সময় বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তা আঁকা হয়।

দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিক এমনকি তাঁদের বাহন ও  মহিষাসুরেরও ভিন্ন উপাচার এবং মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেবতাদের ক্ষেত্রে প্রথমে দক্ষিণ নেত্র ও পরে বাম নেত্রে চক্ষুদান করা হয়। যদিও বেশিরভাগ স্থানেই মহালয়ার দিনই দেবীপক্ষের সূচনাকালে চক্ষুদান সম্পন্ন করা হয়।

পূর্বে শুধুমাত্র রাজ-রাজাদের মহলেই পূজিত হতেন দেবী দুর্গা। তবে বর্তমানে বনেদি বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে দেবী পূজিত হন বিভিন্ন বারোয়ারি মণ্ডপে, এমনকি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দেবী প্রতিমা পাড়ি দেয় বিদেশেও। তাই দেবী মূর্তির চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে বহু পূর্বেই তুলি ধরতে হয় মৃৎশিল্পীদের এবং মহালয়ার পূর্বেই সেরে ফেলতে হয় চক্ষুদান পর্ব। তবে প্রচলিত রীতি মেনেই এখনও মহাসপ্তমীর দিন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর।

Picture Courtesy: Gouri Banerjee (Mother of Admin and Owner Kuntala Bhattacharya)

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “দুর্গা পূজার সময় কীভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: