বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান

ভারতবর্ষের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের নামের সাথে জড়িয়ে আছে এক বিশেষ ঐতিহ্য। এখানকার ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে জানা যায় প্রাচীন মল্ল রাজাদের কাহিনী। তাঁদের তৈরি মন্দিরগুলি এখনও এখানকার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সাথে সাথে তৎকালীন অপরূপ স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই মন্দিরগুলি। বিষ্ণুপুরে রয়েছে এই রকম অগুনতি মন্দির, যার জন্য এই শহরটি মন্দির শহর নামেও পরিচিত। বাঁকুড়ার বিখ্যাত টেরাকোটা শিল্পের কথা কারোরই অজানা নয়। আর বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ মন্দিরগুলিই সেই অসাধারণ শিল্পশৈলীর অপরূপ নিদর্শন। বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে বলতে গেলে মূলত এখানকার এই মন্দিরগুলির কথাই উঠে আসে। তবে এই মন্দিরগুলি ছাড়াও এইখানে আরও বেশ কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আজকে আমার লেখনীতে রইল বাছাই করা কয়েকটি বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তথ্য।

মৃন্ময়ী মন্দির

৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা জগৎ মল্ল মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিষ্ণুপুরে অবস্থিত মন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দিরটি প্রাচীনতম। বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে জানা যায় রাজা জগৎ মল্ল মা মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী মা মৃন্ময়ীর ইচ্ছানুসারে বিষ্ণুপুরে তিনি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবী দুর্গা এই মন্দিরে মা মৃন্ময়ী রূপে পূজিত হন। সময়ের সাথে সাথে এই মন্দিরটির বিভিন্ন অংশ নষ্ট হতে শুরু করেছিল, তাই এই মন্দিরটিকে পুনরায় নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। তবে এই মন্দিরে গঙ্গা মাটির তৈরি সেই পুরানো দেবীর বিগ্রহটিই এখনও পূজিত হয়।

বাংলার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব, যেটি প্রায় ১০২১ বছর পূর্বের দুর্গা পূজা, সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দুর্গা  পূজা আজও এই মন্দিরে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। ঘট স্থাপনের পরে প্রথমে বড় ঠাকুরানী, তারপর মেজো ঠাকুরানী এবং সব শেষে ছোট ঠাকুরানীর উপাসনার মধ্যে দিয়ে এই উৎসবের সূচনা হয়। এখনও এখানে মহাষ্টমীর দিনে কামানের তোপ দেগে শুরু হয় সন্ধি পূজা। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই দুর্গোৎসবকে স্বচক্ষে দর্শন করতে চাইলে অতি অবশ্যই আপনাকে দুর্গা পূজার সময় পৌঁছে যেতে হবে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শহরে। 

শ্যামরাই মন্দির

বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসাবে যে সমস্ত শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরগুলি নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে তাদের মধ্যে শ্যামরাই মন্দির অন্যতম। ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। পাঁচটি চূড়া বিশিষ্ট এই মন্দির ‘পঞ্চ চূড়া' মন্দির নামেও খ্যাত। ঐরাবতে বসে ইন্দ্রের লড়াই, রাম ও রাবণের কাহিনী, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি ধর্মীয় কাহিনীর দৃশ্য মন্দিরের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে পোড়ামাটির ভাস্কর্য দ্বারা চিত্রিত আছে। এছাড়া এই মন্দিরে রয়েছে এক বিশালাকৃতি রাসচক্র যার মধ্যে গোপিনীদের সহিত রাধা কৃষ্ণের লীলার বিভিন্ন রূপ চিত্রিত আছে। এরূপ পোড়ামাটির অসাধারণ শিল্পশৈলী বিষ্ণুপুরের এই মন্দিরগুলির প্রধান আকর্ষণ।

জোড়বাংলা মন্দির

জোড়বাংলা মন্দির একটি বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান। ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন, যা মন্দিরের সম্মুখভাগে খোদাই করা একটি শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয়। এই মন্দিরটি কেষ্ট রাই মন্দির নামেও পরিচিত। গ্রাম বাংলায় আমরা যে দোচালা মাটির ঘর দেখতে পাই তারই অনুকরণে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দুটি দোচালা ঘরকে পাশাপাশি যোগ করলে যেরূপ দেখতে লাগে, এই মন্দিরটি সেই রকমই দেখতে। ইহার সংযোগস্থলে রয়েছে একটি চারচালা শিখর। মন্দিরের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে ও ছাদে রয়েছে অসাধারণ পোড়ামাটির কারুকার্য। এই কারুকার্যের মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক জীবনযাত্রা, বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনী ইত্যাদির দৃশ্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চমৎকার পোড়ামাটির অলঙ্করণের জন্য এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা পোড়ামাটির মন্দিরের স্বীকৃতি লাভ করেছে।

রাসমঞ্চ

বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রথমেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে রাসমঞ্চ। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ বীর হাম্বীর বিষ্ণুপুরে এই রাসমঞ্চটি নির্মাণ করেছিলেন। এই রাসমঞ্চ তৎকালীন স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। বাংলার সনাতন মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর সাথে মিশরীয় পিরামিড ও ইসলামিক স্থাপত্যকলার এক অসাধারণ সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায় এই প্রাচীন স্থাপত্যটির মধ্যে। এই ধরণের অভূতপূর্ব স্থাপত্যকলা সমগ্র বাংলা সহ গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে অনন্য।

চলুন জেনে নেওয়া যাক এই রাসমঞ্চটির নির্মাণের ইতিহাস। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক ছিলেন রাজা বীর হাম্বীর। মুঘল এবং পাঠানদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালীন তিনি মুঘল বাহিনীর অন্যতম সহায়ক ছিলেন। সেই সময়ের দক্ষ মল্লযোদ্ধা হিসাবে তিনি খ্যাত ছিলেন। এই বীর মল্লযোদ্ধাই পরবর্তীকালে শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছে বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা নেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি নির্মাণ করেন এই বিখ্যাত রাসমঞ্চ। 

মল্ল রাজবংশে পূজিত রাধা কৃষ্ণের মূর্তিগুলি প্রতি বছর রাস উৎসবের সময় এই রাসমঞ্চে নিয়ে আসা হত। এই রাসমঞ্চটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে শুরু করে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহাসমারোহে এখানে রাস উৎসব পালিত হত। যদিও তা এখন ইতিহাস তবুও সেই ইতিহাসের কাহিনী এই রাসমঞ্চের ইঁট কাঠ পাথরের পাঁজরে কোথায় যেন আজও লুকিয়ে আছে।

লালবাঁধ

১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ বীরসিংহ বিষ্ণুপুরে পোকাবাঁধ, শ্যামবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, যমুনাবাঁধ, গনতাতবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ এবং লালবাঁধ নামক সাতটি হ্রদ খনন করিয়েছিলেন। এই হ্রদগুলির জল সেই সময় পানীয় জল হিসাবে ব্যবহৃত হত, এছাড়াও মূলত বিষ্ণুপুর শহরকে শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই হ্রদগুলি খনন করানো হয়েছিল। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসাবে লালবাঁধ পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। 

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে গোটা বাংলার শোচনীয় অবস্থা হলেও, বিষ্ণুপুরে তার কোন প্রভাব পড়েনি। এখানকার সেচ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত ছিল যে কৃষিকাজে কোন রকম বাধা আসেনি। পরবর্তীকালে এই লালবাঁধের সংস্করণ করা হয়।

জনশ্রুতি রয়েছে যে সেই সময়ের বিখ্যাত নর্তকী লালবাঈকে এই লালবাঁধে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই কারণেই এই বাঁধের এরূপ নামকরণ করা হয়। যদিও তার কোন অকাট্য প্রমাণ নেই। মল্লভূমের এই রকম বহু জানা অজানা কাহিনী জড়িয়ে আছে এই লালবাঁধের সাথে। 

আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম

মিউজিয়াম মানেই খানিকটা টাইম মেশিনের অনুভূতি আসে। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে অতীতের কাহিনী জানতে হলে এই মিউজিয়ামগুলি আপনাকে দেবে তার সমস্ত তথ্য। আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন নামে সেই রকমই একটি আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম রয়েছে বিষ্ণুপুরে, যেখানে সংরক্ষিত আছে দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে নির্মিত ১০০টির কাছাকাছি মূর্তি, প্রায় ৫০০০ পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ধরণের লোকশিল্প, কিছু দুষ্প্রাপ্য ফটোগ্রাফ সহ আরও বহু প্রাচীন বস্তু।

গড় দরজা

বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গ এলাকায় প্রবেশের জন্য দুটি মাকড়া পাথরের তৈরি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার আছে, তারমধ্যে একটি ক্ষুদ্র প্রবেশ তোরণ আছে যা ছোট পাথর দরজা নামে পরিচিত। এই ছোট পাথর দরজা অতিক্রম করলে দেখতে পাওয়া যায় অপর আরেকটি প্রবেশদ্বার যা বড় পাথর দরজা বা গড় দরজা নামে পরিচিত। সম্ভবত মল্লরাজ বীরসিংহ সপ্তদশ শতকে ইহা নির্মাণ করেছিলেন। রাজ্যকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই প্রবেশদ্বারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। গড় দরজায় বেশ কয়েকটি গোপন কক্ষ আছে। এই গোপন কক্ষগুলি থেকে সৈন্যরা রাজ্যের উপর নজর রাখত, যদি কোন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে রাজ্যে প্রবেশ করতে দেখা যেত সেক্ষেত্রে সৈন্যরা সন্তর্পণে শত্রুর উপর আক্রমণ করত। কয়েক শতক ধরে বিষ্ণুপুর রাজ্যের সুরক্ষার দায়ভার ছিল এই প্রাচীন স্থাপত্যটির উপর। এখন যদিও নেই সেই রাজত্ব, তবে রয়ে গেছে এই শতাব্দী প্রাচীন গড় দরজা।

উল্লিখিত স্থানগুলি ছাড়াও বিষ্ণুপুরে রয়েছে আরও অনেক পোড়ামাটি ও পাথরের তৈরি মন্দির সহ বহু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হল- পাথরের রথ, দলমাদল কামান, মদনমোহন মন্দির, ষাঁড়েশ্বর এবং শৈলেশ্বর মন্দির ইত্যাদি।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “বিষ্ণুপুরের সেরা দর্শনীয় স্থান

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: