বাঙালির পোশাকের বিবর্তনের কাহিনী

মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘পোশাক'-এর আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এক অনন্য কৃতিত্ব। প্রাচীন গুহামানব থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্য সমাজের আধুনিক মানুষ, সকলের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পোশাক। তবে পোশাক যে শুধুমাত্র লজ্জা নিবারণের বস্তু তা কিন্তু একদমই নয়, পোশাক যেমন মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিচয় তুলে ধরে, তেমনি ধারণ করে কোনো দেশ বা অঞ্চল ও তার সংস্কৃতিকে, পাশাপাশি বর্তমান সময়কেও সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্ব করে চলে মানুষের এই পোশাক।

প্রাচীনকালে মানুষ নিজ দেশের আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এবং প্রাত্যহিক জীবনের নানান কাজের সুবিধার কথা মাথায় রেখে পোশাক নির্বাচন করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় পোশাক নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে আরও অন্যান্য বিষয়। পোশাক নির্বাচনের মানদণ্ড হিসেবে সৌন্দর্যবোধ যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারসাথে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় কোনো দেশ বা জাতির পোশাকে। স্বভাবতই সেই প্রভাব বাঙালির পোশাকেও লক্ষণীয়। কিভাবে বা ঠিক কি কারণে প্রাচীনযুগের বাঙালির পোশাকের সাথে আধুনিক যুগের বাঙালির পোশাকের এই বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে তারই কাহিনী আজকে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

প্রাচীনযুগের বাঙালির পোশাক

বিগত কয়েক শতাব্দীতে বাঙালির পোশাকের বিবর্তনের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও তার পূর্ববর্তী সময় বাঙালি কি ধরণের পোশাক পরত সেইভাবে তার কোনো প্রমাণ নেই। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। তবে চর্যাপদ থেকে সমসাময়িক কালের নারী ও পুরুষের পোশাক সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কিছু ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক এবং পাণ্ডুলিপির চিত্র থেকে সে যুগের বাঙালির পোশাকের ধরন সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায় মাত্র।

অনুমান করা হয় ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের পূর্বে “শাটি” শব্দটির প্রচলন ছিল, যার অর্থ শাড়ি। সেই অনুমান থেকেই আমরা বলতে পারি শাড়ি পরার প্রচলন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বা তারও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। গুপ্ত যুগের স্বনামধন্য কবি কালিদাসের “কুমারসম্ভব” কাব্যেও শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।

যদিও সেই সময় নারী ও পুরুষের পোশাকের মধ্যে সেইভাবে কোনো অন্তর ছিল না। নারী ও পুরুষ উভয়ই একটি মাত্র বস্ত্র পরতেন, যেটি ছিল ধুতি বা শাড়ি।

অভিজাত পরিবারের পুরুষেরা হাঁটুর নিচ অবধি ও সাধারণ পুরুষেরা অত্যন্ত খাটো ধুতি পরতেন।

নারীরা পায়ের কব্জি পর্যন্ত শাড়ি পরতেন। নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ঊর্ধ্বাঙ্গে অলংকার ব্যতীত কোনো ধরনের বস্ত্র পরার চল ছিল না। যদিও বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে অভিজাত পরিবারের নারীরা ঊর্ধ্বাঙ্গে ওড়নার ব্যবহার করতেন।

মধ্যযুগের বাঙালির পোশাক

বাঙালিদের মধ্যে প্রাচীনযুগের মত মধ্যযুগেও শাড়ি ও ধুতি পরার বহুল প্রচলন ছিল। তবে মধ্যযুগে শাড়ি ও ধুতি পরার ধরণের মধ্যে কিছু বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

পুরুষদের পোশাক

বাঙালি পুরুষেরা সেই সময় ধুতির সাথে এক খণ্ড লম্বা বস্ত্র কটি বেষ্টন করে বাহুর নিচ দিয়ে ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গে পেঁচিয়ে ডান দিকে ঝুলিয়ে পরতেন।

নারীদের পোশাক

সেই সময় বাঙালি নারীরা নিম্নাঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে এবং এর বর্ধিত অংশ কোমর পেঁচিয়ে বক্ষকে আবৃত করে কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে পরতেন। মধ্যযুগে ঘোমটার কোনো রেওয়াজ ছিল না। অভিজাত পরিবারের নারীরা শাড়ি ছাড়াও ঊর্ধ্বাঙ্গে বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করতেন। সেই আমলে শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল চওড়া ও নকশাযুক্ত কাঁচুলি। 

বঙ্গদেশে ইসলামী পোশাকের আবির্ভাব

মধ্যযুগে বাঙালির পোশাকের এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মূলত ১২০৫ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির গৌড়ে আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে। সেই আমল থেকেই বঙ্গদেশে ইসলামী পোশাকের প্রচলন শুরু হয়। এই পোশাকের বিশেষত্ব হল যে কাপড়কে সেলাই করে এই বস্ত্র বানানো হত। তবে সেলাই করা পোশাকের ব্যবহার যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল তা নয়। বঙ্গদেশে ইসলামী পোশাকের প্রচলন শুরু হয় বাদশাহের দরবার থেকে। ক্রমে তা অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে এবং পরবর্তীতে গ্রামের ধনী পরিবারের মধ্যে প্রচলিত হয়।

পুরুষদের পোশাক

সেই সময় পুরুষদের মধ্যে মূলত ঊর্ধ্বাঙ্গ, নিম্নাঙ্গ ও মাথায় মোট তিনটি বস্ত্র পরার প্রচলন ছিল। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “কবিকঙ্কণ চণ্ডী” কাব্যগ্রন্থে আমরা মাথায় পাগড়ি পরার প্রচলনের উল্লেখ পাই।

তবে সেই সময় সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের মধ্যে সেলাই করা পোশাক পরা নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গদেশে অভিজাত পুরুষদের মধ্যে তিন টুকরো কাপড় ব্যবহারের চল ছিল। মাথায় বাঁধার জন্য কাপড় দিয়ে পাগড়ি তৈরি করা হত। গায়ে ব্যবহৃত কাপড়কে বলা হত চাদর আর নিম্নাঙ্গে ধুতি জাতীয় কৌপীন পরার প্রচলন ছিল। যদিও সময়ের সাথে সাথে কৌপীন লম্বা করে পরার রীতি চালু হয়। তার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে কোঁচার ঝুলও বৃদ্ধি পায়।

মুসলমানরা বঙ্গদেশে প্রথম লুঙ্গি পরার প্রচলন শুরু করেন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখায় ষষ্ঠদশ শতাব্দীর অন্তিম পর্যায় অভিজাত ও ধনী শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে ইজার অর্থাৎ পায়জামা পরার উল্লেখ পাওয়া যায়। মুসলমানদের প্রভাবে যদিও পরবর্তীতে হিন্দুদের মধ্যেও ইজার পরার প্রচলন শুরু হয়।

ব্রিটিশদের আগমন ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরেও এদেশে দীর্ঘ দিন যাবৎ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই মুঘল পোশাক পরার চল ছিল। ১৮৩৫ সালের সমাচার দর্পণ পত্রিকায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে অভিজাত, ধনী ও শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে জামা, নিমা, কোর্তা ইত্যাদি পোশাক পরার কথা উল্লেখ আছে। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ অভিজাত ব্যক্তিদের চিত্রে আমরা তাঁদের এই ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখতে পাই। এছাড়াও সেই সময় অভিজাতদের মধ্যে যে পাগড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল তার প্রমাণ মেলে রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ সহ বহু অভিজাত ব্যক্তিদের চিত্র থেকে।

শেখ জয়নুদ্দীনের আঁকা চিত্রে দেখা যায় অভিজাতদের সাথে সাথে ভৃত্যরাও পাগড়ি পরে আছে। তা থেকে সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব যে সেই সময় বাদশাহ ও অভিজাতদের চৌহদ্দি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইসলামী পোশাক নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।

সম্ভবত কামিজ, রামজামা থেকেই পরবর্তীতে উদ্ভব হয়েছিল বর্তমান বাঙালি পুরুষদের প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি।

নারীদের পোশাক

বঙ্গদেশে সেই সময় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যেই কঠোর পর্দা প্ৰথার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন সময় পুরুষদের পোশাকের পরিবর্তন ঘটলেও রক্ষণশীলতার কারণে নারীরা সর্বদা একই পোশাক পরেছেন, আর তা হল শাড়ি। এই শাড়ি শুধু বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাকই নয়, এটি বাংলার নারীদের অহংকারের একটি জায়গা।

আর বাঙালির পোশাকের ইতিহাসে যে নামটি স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে সেটি হল মসলিন। বাংলার সুপ্রাচীনকালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্মারক হল এই মসলিন। এছাড়াও ঢাকাই জামদানি, তাঁত, বালুচরির মতো শাড়ি বিশ্বের দরবারে বাংলার পোশাককে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে।

ব্রিটিশ আমল ও আধুনিক যুগের বাঙালির পোশাক

বঙ্গদেশে ব্রিটিশদের আগমনের বহু পরেও এখানকার মানুষ তাদের পোশাক গ্রহণ করেননি। তবে চিরকালই বঙ্গে শাসকদের ধারা বজায় রেখেছে এখানকার অভিজাত শ্রেণী। যদিও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইংরেজদের অনুকরণে পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়।

বিশেষ করে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু কলেজ সহ বিভিন্ন অফিস বা দপ্তরে মানুষের মধ্যে বিলেতি পোশাক পরার চল শুরু হয়। যার সব থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে নাম নেওয়া যেতে পারে মাইকেল মধুসূদন দত্তের।

পুরুষদের পোশাক

ব্রিটিশ আমলের অভিজাত বাঙালি সমাজের পুরুষদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পোশাক ছিল গলাবন্ধ কোট। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সমসাময়িক কালের প্রায় সমস্ত অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্যেই গলাবন্ধ কোট বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখনকার দিনে অভিজাত পরিবারের বিলেত ফেরত বাঙালিরা বঙ্গে ইংরেজদের পোশাকে নিজেদের পাকাপাকিভাবে সাজিয়ে তোলেন। এনাদের অনুসরণ করে বাঙালি সমাজ বিলেতি পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই সময় অনেক বাঙালি পুরুষদের মধ্যে কোট ও ধুতি পরার চলও ছিল। 

তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলেতি পোশাক সেইভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অভিজাত শ্রেণি ছাড়া হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তখনও ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর, লুঙ্গি ইত্যাদি পোশাক পরতেন।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে পোশাক। সেই সময় বিদেশী পোশাক বর্জন করে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে চরকা ও খাদিবস্ত্র হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের মধ্যেও সেই জাতীয়তাবাদ সঞ্চারিত হয়েছিল।

বিশ শতকের প্রথম দিকে গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের মধ্যে ধুতির পরিবর্তে লুঙ্গি পরার প্রচলন শুরু হয়, যা আজকের বর্তমান সমাজেও লক্ষণীয়। তবে বিভিন্ন উৎসবে ও বিশেষ অনুষ্ঠানে আজও বাঙালি পুরুষদের মধ্যে ধুতি পরার রেওয়াজ আছে।

বিশ শতকের শেষার্ধে বাঙালি পুরুষের পোশাকের তালিকায় শার্ট একটি বিশেষ জায়গা করে নেয়। এছাড়াও এই তালিকায় বর্তমানে জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট, বারমুডা ইত্যাদির জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী।

নারীদের পোশাক

ব্রিটিশ আমলে বাঙালি পরিবারের গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা মূলত শাড়িই পরতেন। তবে সেই সময় শাড়ির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছিল ব্লাউজ ও পেটিকোট।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর হাত ধরেই প্রথমে বাঙালি অভিজাত পরিবারের নারীদের মধ্যে এবং পরবর্তীতে সাধারণ পরিবারের নারীদের মধ্যেও ব্লাউজ পরার প্রচলন শুরু হয়। ফুল হাতা গলাবন্ধ ব্লাউজ থেকে এই পোশাকের সূত্রপাত হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের ব্লাউজ তৈরি হতে শুরু করে।

সেই সময় অভিজাত ও ধনী শ্রেণীর অনেক পুরুষ ব্রিটিশ সমাজে তাদের স্ত্রীদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বিলেতি পোশাকও তৈরি করিয়ে নিতেন।

অভিজাত শ্রেণীর মুসলিম সম্প্রদায়ের উর্দুভাষী নারীদের মধ্যে সালোয়ার কামিজ পরার রেওয়াজ থাকলেও বাঙালি মুসলিম নারীরা সেই সময় সালোয়ার কামিজ পরতেন না। পরবর্তীতে যদিও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীরা এই পোশাক পরতে শুরু করে।

সাম্প্রতিক কালে পোশাকের যে বিশ্বায়ন ঘটেছে তার ফলস্বরূপ বাঙালি নারীর পোশাকেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। যুগের সাথে তালে তাল মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন ধরনের বাহারি পোশাক।

তবে আজও সাবেকি বাঙালি পোশাক বহন করে চলেছে বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি। নতুন ধরনের বাহারি পোশাকের পাশাপাশি খাঁটি বাঙালি পোশাকের কদর আজও কিছু কম নয়।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: