বাংলার বিভিন্ন উপজাতি এবং তাদের জীবনধারা

ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের আশ্রয়স্থল। ভারতবর্ষের পশ্চিমবাংলায় বেশ কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বসতি গড়ে তোলে। তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। সরকারি নথি অনুযায়ী পশ্চিমবাংলায় মোট চল্লিশটি উপজাতিগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপজাতিগোষ্ঠী ও তাদের জীবনধারা আজকের প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু।

মূল প্রসঙ্গে আসার আগে উপজাতি বলতে কি বোঝায় সেটা জেনে নেওয়া যাক। যদিও উপজাতির কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, তবে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীদের ভাষায় উপজাতি বলতে বোঝানো হয়েছে যারা একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক এবং যাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে। যদিও বর্তমানে প্রয়োজনের তাগিদে তারা দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে কিছুটা হলেও সম্পর্কযুক্ত হয়ে পরেছে, যার ফলস্বরূপ এদের জীবনধারায়ও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তবে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে এখনও তারা নিষ্ঠার সাথে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে বহন করে নিয়ে চলেছে।

সাঁওতাল

  • বাংলার অতি পরিচিত উপজাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি হল সাঁওতাল উপজাতি। এদের মধ্যম গড়ন, গাঢ় বর্ণ, পুরু ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক ও কোঁকড়ানো চুল থেকে অনুমান করা হয় এরা অস্ট্রেলিয়া ও তার নিকটবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল। বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার বিচারে বৃহত্তম উপজাতি হল সাঁওতাল উপজাতি।
  • দক্ষিণ এশিয়ার অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত সাঁওতালি ভাষা এই উপজাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা।
  • সাঁওতালরা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনুগামী।
  • প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজই এদের প্রধান জীবিকা।
  • এদের প্রধান খাদ্য ভাত। এছাড়া মাছ, শুকর, মোরগ ও খরগোশের মাংস এদের প্রিয় খাদ্যের তালিকায় পরে।
  • সাঁওতালি পুরুষরা পোশাক হিসাবে পাঞ্চি, ধুতি, গামছা ব্যবহার করে। মহিলারা ফতা নামক দুই খণ্ডের কাপড় পরে এবং বিভিন্ন ধরণের অলংকার পরতে ও খোঁপায় ফুল লাগাতে খুবই পছন্দ করে।
  • সাঁওতালরা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে কিছু শতাংশ মানুষ সরনা ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী। এদের প্রধান দেবতা ‘চান্দোবোঙা' অর্থাৎ সূর্যদেব। এছাড়া এরা দেবতা মারাং বুরুকে খুবই বিশ্বাস করে।
  • এদের প্রধান উৎসব সোহরাই। এছাড়াও বাহা, করম, রুন্দো, মাহমোর ইত্যাদি উৎসবগুলিও এরা মহাসমারোহে পালন করে।
  • বাপলা, সরহায়, বারনি মেলা এদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
  • এদের মাটির ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরণের নকশা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি চিত্রিত থাকে। ঢোল, দোতারা, বাঁশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে এবং বাজাতে এরা যথেষ্ট পারদর্শী।

ভূমিজ

  • ‘ভূমিজ' শব্দের অর্থ ভূমিপুত্র। বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মতোই ভূমির সন্ধানে নিজেদের আদি নিবাস ছেড়ে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে ভূমিজ উপজাতিগোষ্ঠী বসতি গড়ে তোলে।
  • সাঁওতালদের মতো ভূমিজরাও অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এরা নিজেদের মধ্যে সাধারণত ভূমিজ ভাষায় কথোপকথন করে থাকে।
  • ভূমিজরা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনুগামী।
  • এদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ।
  • ভাত, মাছ, মাংস, বিভিন্ন ধরণের ফল ও শাক-সবজি এদের প্রিয় খাদ্য।
  • বর্তমানে ভূমিজ উপজাতির লোকেরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও, তারা তাদের আদি ধর্মের কিছু ঐতিহ্যকেও এখনও বহন করে চলেছে। এরা মূলত সিংবোঙা, জাহুবোড়া, বরম দেওতা ও ধরম দেওতার উপাসনা করে থাকে।
  • সারা পৌষ মাস যাবৎ এরা মহাসমারোহে টুসু উৎসব পালন করে। এছাড়াও এদের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য উৎসবের নাম হল কারাম ও বাঁধনা পরব।

লোধা

  • পশ্চিমবঙ্গের মূলত ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় নিজেদের বসতি গড়ে তোলে এই আদিম জনগোষ্ঠী।
  • ব্রিটিশদের দ্বারা নিপীড়িত এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ায় এরা অপরাধপ্রবণ উপজাতি হিসেবেই পরিচিত ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে এই উপজাতিগোষ্ঠী এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়।
  • এই জাতিসত্তার মাতৃভাষা লোধি।
  • লোধা জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। 
  • লোধাদের জীবন প্রণালী অত্যন্ত সহজসরল ও অনুন্নত। মূলত শিকার ও সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
  • সাপ, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদি শিকার করে ও পুকুর বা নদী থেকে মাছ ধরে এরা খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া পচানো ভাত থেকে তৈরি হাঁড়িয়া এদের প্রিয় পানীয়।
  • লোধা সম্প্রদায়ের মানুষেরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এরা বনদেবতা বারাম ও বনদেবী চন্ডীর উপাসনা করে। তবে এই সম্প্রদায়ের কিছু সংখ্যক মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং ‘লোধা মুসলিম' নামক একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেছে।
  • এই উপজাতির লোকেরা তাদের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী বাল্যবিবাহ করে থাকে এবং এদের মধ্যে গন্ধর্ব বিবাহেরও প্রচলন আছে।

টোটো

  • বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী টোটো। এরা ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর একটি বিচ্ছিন্ন শাখা।
  • আলিপুরদুয়ার জেলায় তোর্ষা নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত টোটোপাড়া নামক গ্রামে এই বিলুপ্তপ্রায় উপজাতি নিজেদের জনবসতি গড়ে তুলেছে।
  • টোটোদের সমাজব্যবস্থা মূলত পিতৃতান্ত্রিক।
  • ভোট-বার্মা ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত টোটো ভাষা এই সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা।
  • কৃষিকাজই টোটোদের প্রধান জীবিকা। এছাড়া এরা পশুপালনও করে থাকে।
  • টোটোরা খাদ্য সংগ্রহের জন্য অরণ্যের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। ভাত, ভুট্টা, কাউন ইত্যাদি এদের প্রধান খাদ্যের তালিকায় পরে।
  • এই উপজাতি গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে। এদের ধর্মীয় দেবতা হলেন ইশপা।

বেদিয়া

  • অনুমান করা হয় বেদিয়ারা রাজা বেদরাজের বংশধর। বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বেদিয়াদের আধিক্য অনেক বেশি।
  • পশ্চিমবাংলায় এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে।
  • পূর্বে বেদিয়া উপজাতির লোকেরা সাপুড়ে ছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে কৃষিকাজকে এরা প্রধান জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বেদিয়া সমাজে মহিলাদের বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়। মহিলারা গৃহকর্মের সাথে সাথে বাইরের কাজেও পুরুষদের সহায়তা করে।
  • ভাত, রুটি, শাক-সবজি, মাছ, মাংস এদের প্রিয় খাদের তালিকার মধ্যে পরে।
  • বেদিয়া উপজাতির লোকেরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
  • এই উপজাতির লোকেরা ফাগুয়া, রথযাত্রা, মান্ডা পূজা প্রভৃতি উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলি মহাসমারোহে পালন করে।

রাভা

  • রাভা উপজাতিগোষ্ঠী ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বড়ো, গারো, কাছারী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে এই উপজাতির নৃতাত্ত্বিক সংযোগ রয়েছে।
  • পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি জেলায় রাভা উপজাতিগোষ্ঠী নিজেদের জনবসতি গড়ে তুলেছে। বাংলার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হল এই রাভা উপজাতি।
  • রাভাদের সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক।
  • এই জাতিসত্তার মাতৃভাষা রাভা।
  • এই উপজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা মূলত মৎস্যজীবী, কৃষক ও বনকর্মী।
  • ভাত, মাছ, মাংস ইত্যাদি এদের প্রিয় খাদ্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
  • এদের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে, তবে মূল ধর্মের সাথে সাথে এরা হিন্দুধর্মের বিভিন্ন রীতি-নীতিও পালন করে থাকে। বর্তমানে বহু রাভা সম্প্রদায়ের মানুষ খ্রিস্টধর্মও গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে মূর্তিপূজার প্রচলন নেই। রাভাদের ধর্মীয় দেবতা হলেন ‘ঋষি' বা ‘মহাকাল'। এছাড়া মহাকালের কন্যা রঙ্গতুক ও বসেক-এর উপাসনাও এরা করে থাকেন।

মাহালী

  • মাহালী উপজাতি বাংলার একটি অতি প্রাচীন জনগোষ্ঠী। অস্ট্রোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই উপজাতিটি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিবাসী। সাঁওতালদের সাথে এদের নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য থাকলেও এদের সম্পূর্ণ পৃথক একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে।
  • এই সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের জন্য মাহালী ভাষা ব্যবহার করেন।
  • বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন ধরণের শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা এদের প্রধান ও জাতিগত পেশা।
  • ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, শাক-সবজি ইত্যাদি এদের দৈনন্দিন খাদ্যের তালিকার মধ্যে পরে।
  • ধুতি এই জাতিগোষ্ঠীর পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। আর মহিলারা পাঞ্চি পারহাট নামক পোশাক এবং বিভিন্ন ধরণের রূপার তৈরি গহনা পরতে ভালোবাসে।
  • পূর্বে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে।
  • মাহালীদের সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে লুবান ও জিতিয়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এছাড়া এরা সনাতনী প্রকৃতি পূজাও করে থাকে।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “বাংলার বিভিন্ন উপজাতি এবং তাদের জীবনধারা

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: