বাংলার ১০টি বিশিষ্ট লোকচিত্র
ভারতীয় চিত্রকলায় বঙ্গীয় লোকচিত্রের অবদান অনস্বীকার্য। পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের গায়ে অঙ্কিত নানান নকশাধর্মী অলঙ্করণ বঙ্গীয় অঞ্চলের প্রাচীনকালের মানুষের চিত্রাঙ্কন দক্ষতার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন হিসাবে গণ্য করা হয়।
আজও গ্রাম বাংলার বহু চিত্রশিল্পীরা প্রতিনিয়ত স্বদেশের প্রত্যন্ত ও অবহেলিত লোকসংস্কৃতির অস্তিত্ব বজায় রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীরা তাঁদের বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে দেশীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছেন। আজ সেই সমস্ত বাংলার বিশিষ্ট লোকচিত্র সম্বন্ধে কিছু বিশেষ তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছি আপনাদের জন্য।
বাংলার লোকচিত্র নিয়ে এই প্রবন্ধটি লেখার সময় বিস্তারিত তথ্যের অভাবে আমায় বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখনই মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার এক বন্ধুর কথা, শুভঙ্কর সিংহ রায়, আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। ওর সাহায্য ছাড়া এই প্রবন্ধটি লেখা দুষ্কর হয়ে যেত। ধন্যবাদ জানিয়ে ওকে ছোট করব না। চিত্রশিল্পী হিসেবে যেন ও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে এটাই কামনা করি।
পালচিত্র
বঙ্গীয় চিত্রকলার সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক নিদর্শন হল পাল আমলের তালপাতার পুঁথিতে এবং কাঠের প্রচ্ছদে অঙ্কিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুচিত্রগুলি। এই লোকচিত্রটি ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে ‘পালচিত্র' নামে পরিচিত। এই পালচিত্রের হাত ধরেই ভারতবর্ষে মিনিয়েচার বা অনুচিত্র যুগের সূচনা হয়। এই বিশিষ্ট লোকচিত্র মূলত বৌদ্ধ ধর্মের দেবদেবীর প্রতিমূর্তিগুলির চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে পুঁথিকে দৈব গুণসম্পন্ন করার প্রয়োজনে অঙ্কিত হয়েছিল। দশম শতকের শেষ পর্যায় থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতকের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত এই পাল পুঁথিচিত্রের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে বাংলায় মোঘল সম্রাটরা সাম্রাজ্য বিস্তার করলে বঙ্গীয় চিত্রকলায় নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে।
মুর্শিদাবাদ চিত্ররীতি
আলীবর্দী খানের শাসন আমলে মুঘল চিত্রশৈলী দ্বারা প্রভাবিত মুর্শিদাবাদ চিত্ররীতি নামে একটি স্বতন্ত্র চিত্রকলার সৃষ্টি হয়েছিল। মুঘল চিত্রশৈলী ছাড়াও এই চিত্রকলায় রাজপুতানা এবং বাংলার পটচিত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সুশৃঙ্খল ও সংযত অঙ্কনশৈলী বঙ্গীয় লোকচিত্রে নিজের এক উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে।
দেওয়াল চিত্র
এই বিশিষ্ট লোকচিত্র একটি নিছক গ্রাম্য চিত্রকলা। পল্লীবাসীরাই এই লোকশিল্পটির স্রষ্টা। পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও পুরুলিয়া জেলার বহু স্থানে মাটির ঘরের দেওয়ালে মূলত আদিবাসী পল্লীরমণীরা তাদের নিপুণ হাতের দক্ষতায় চিত্র শোভিত করে। এই চিত্রে চিত্রশিল্পীর দক্ষতার থেকেও বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষণীয়। বিশেষত সাঁওতাল আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা কালীপূজার সময় বাঁধনা পরব উপলক্ষ্যে প্রতি বছর নতুন করে মাটির ঘরের দেওয়াল গাত্রে এই চিত্রণের কাজ করে থাকেন।
এই দেওয়াল চিত্রগুলি তাদের গ্রাম্য বলিষ্ঠতা ও সরলতার জন্য বঙ্গীয় লোকচিত্রে নিজের এক উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিলেও এর সঠিক মূল্যায়ন আজও অবধি হয়নি। অথচ বিহারের গ্রামাঞ্চলে অনুরূপ দেওয়ালে অঙ্কিত মধুবনী চিত্রকলার উপর অনেক সচিত্র প্রবন্ধ ও গ্রন্থাবলী রচিত হয়েছে, যার মাধ্যমে এই চিত্রকলাটি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
পটচিত্র
পটচিত্র বাংলার একটি প্রাচীন বিশিষ্ট লোকচিত্র। সংস্কৃত ‘পট্ট' শব্দটি থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘পট' শব্দটির, যার অর্থ কাপড়। কাপড়ের উপরে এই চিত্রাঙ্কন করা হয়ে থাকে। মূলত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এই চিত্রগুলি অঙ্কন করা হয় এবং পটুয়ারা গানের মাধ্যমে সেই কাহিনীর বর্ণনা করে থাকেন। বর্তমানে পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুর ও বীরভূম জেলায় পটুয়া চিত্রকর গোষ্ঠীর বসবাস।
এই বিশিষ্ট লোকচিত্র প্রধানত দুই প্রকারের, যথা জড়ানো পট এবং চৌকো পট। জড়ানো পট লম্বায় প্রায় ১৫-৩০ ফুট এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়, আর চৌকো পট আকারে ক্ষুদ্র ও বর্গাকার অথবা আয়তাকার হয়।
কালীঘাট পটচিত্র চৌকো পটের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। উনিশ শতকে কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে কালী মন্দিরের কাছে এই পটচিত্রের বিকাশ ঘটে। হিন্দু দেবদেবী ও পৌরাণিক চরিত্র ছাড়াও তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে এই পটচিত্রের চিত্রাঙ্কন করা হত। কালীঘাট পটচিত্র বর্তমানে ভারতীয় চিত্রকলার একটি স্বতন্ত্র ঘরানায় পরিণত হয়েছে।
এছাড়া পটচিত্রের আরেকটি ধারা হল দুর্গা প্রতিমার চালচিত্র। সাবেকি এক চালার দুর্গাপ্রতিমার উপরিভাগে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে এই চালচিত্র অঙ্কনের রেওয়াজ দেখা যায়। মূলত শিব-দুর্গা, শিব অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গী, মহিষাসুর যুদ্ধ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে চালচিত্রে চিত্রণ করা হয়।
চালচিত্রের মতোই কাঠের রথের গায়েও এই চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। এই রথচিত্রগুলিতে মূলত মোটা কাপড়ের উপরে চিত্রাঙ্কন করে রথের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হত। হাওড়ার আনন্দনিকেতন কীর্তিশালায় এই ধরণের রথচিত্রের নিদর্শন রয়েছে।
দশাবতার তাস
বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর নির্দেশে শিল্পী কার্ত্তিক ফৌজদার প্রথম দশাবতার তাস তৈরি করেছিলেন। মল্লরাজারা চিত্তবিনোদনের জন্য তাদের অবসর সময় এই তাস খেলতেন। গোলাকৃতি এই তাসে বিষ্ণুর দশ অবতারের চিত্রাঙ্কন করা আছে। মোট ১২০টি তাস লাগে এই খেলায়, তার মধ্যে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের দশটি তাসের প্রতিটির অধীনে মোট ১২টি তাস থাকে। এই তাসগুলি কাপড়, তেঁতুল বীজের আঠা, খড়ি ধুলা, রঙ, সিঁদুর এবং লাক্ষা দিয়ে তৈরি করা হয়। এখনও বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবার এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছেন। বর্তমানে বাংলার এই বিশিষ্ট লোকচিত্র দেশ বিদেশের সংগ্রহশালায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
চিত্রিত পুঁথির পাটা
বঙ্গসংস্কৃতির আরও একটি অমূল্য সম্পদ হল চিত্রিত পুঁথির পাটা। প্রাচীনকালে রচিত পুঁথিগুলির মলাট হিসেবে ব্যবহৃত হত এই চিত্রিত কাঠের পাটা। পশ্চিমবাংলায় যে সমস্ত পাটাচিত্রগুলি পাওয়া গেছে সেইগুলির অঙ্কনশৈলীকে তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে এবং এই ধারাগুলি যথাক্রমে রাজস্থানি ও পাহাড়ি শিল্পশৈলী, ওড়িশা শিল্পশৈলী এবং বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের লোকশিল্পশৈলীর দ্বারা প্রভাবিত। এই পাটাচিত্রগুলি মূলত রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতা, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র ও কাহিনী অবলম্বনে চিত্রণ করা হত।
রামায়ণ পুঁথিচিত্র
বঙ্গীয় লোকচিত্রে খুবই কমসংখ্যক পুঁথিচিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তার মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল রাজবাড়ী থেকে প্রাপ্ত রামচরিত মানসের অবলম্বনে রচিত চিত্রিত পুঁথিটি উল্লেখযোগ্য। পুঁথিটির মধ্যে রামচরিত মানসের বর্ণনার সাথে সাথে আয়তক্ষেত্রাকৃতি এবং কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ পাতা জুড়ে চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে। মহিষাদলের রানী জানকীর পঠনপাঠনের জন্য এই পুঁথিটি খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের শেষ পর্যায় রচিত হয়েছিল। এই পুঁথিচিত্রে ওড়িশার শিল্পশৈলীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে এই পুঁথিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে।
আলপনা
বঙ্গীয় লোকচিত্রের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল আলপনা। হিন্দু শাস্ত্রে পরিবারের মঙ্গল কামনার জন্য নানান ধরণের ব্রত পালনের প্রচলন আছে। এই ব্রতগুলি পালনের উদ্দেশ্যে রচনা হয়েছে নানাবিধ ছড়া এবং অন্যদিকে এর প্রধান অঙ্গ হিসেবে সংযোজিত হয়েছে আলপনা চিত্রণ। ব্রত পালনের সময় বা কোন উৎসবে এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে পিটালি গোলা জলের ব্যবহার করে আঙুলের মাধ্যমে আলপনার নকশাগুলি করা হয়। প্রাচীনকালে পল্লীরমণীরা তাদের মনস্কামনার প্রতিচ্ছবি এই আলপনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন, এবং তারা মনে করতেন সেই আলপনার উপর ফুল ধরে প্রার্থনা করলে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব। বঙ্গসংস্কৃতির এই লৌকিক শিল্পকলাটি পশ্চিমবাংলার প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।
পিঁড়ি-কুলো চিত্র
বঙ্গসংস্কৃতিতে বিবাহ সভায় বর ও কনের বসার জন্য যে পিঁড়ি ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে আলপনা চিত্রণের রীতি রয়েছে। এছাড়া বিবাহে ব্যবহৃত কুলো, বরণডালা, এয়োসরা ইত্যাদির মধ্যেও অনুরূপ নকশাধর্মী অলঙ্করণ করা হয়, যার মাধ্যমে গ্রাম্য নারীদের শিল্পী সত্তার প্রকাশ ঘটে। সাধারণত আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে চিত্রকলায় পটু রমণীরা বিবাহ সম্বন্ধীয় এই সমস্ত সরঞ্জামের উপর চিত্রণের কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সরাচিত্র
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষ্যে ছোট বড় নানান আকারের সরার উপরে দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর বাহন পেঁচা, ধানের শিস, কড়ি ইত্যাদির চিত্র অঙ্কন করা হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মে দেবী লক্ষ্মীর উপাসনার জন্য ব্যবহৃত এই বিশেষ সরাগুলি লক্ষ্মীসরা নামে পরিচিত।
পূর্ববাংলার ঢাকা, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলায় এই লক্ষ্মীসরার বিশেষ প্রচলন ছিল। দেশ ভাগের পর সরা শিল্পীরা পশ্চিমবাংলার নদীয়া ও চব্বিশ পরগনা জেলায় বসবাস শুরু করেন। প্রাচীনকালে এই চিত্রণের কাজে আচার্য ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা নিযুক্ত থাকতেন। বর্তমানে কুম্ভকার, সূত্রধর ও পটুয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাও লক্ষ্মীসরা চিত্রণের কাজ করে থাকেন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Pingback: বাংলার বিভিন্ন উপজাতি এবং তাদের জীবনধারা - Kuntala's Travel Blog