৩টি ঐতিহ্যবাহী সাবেকি নিরামিষ রান্নার রেসিপি ও উপকরণ
বাড়ি থেকে ক্রোশ ক্রোশ দূরে, কর্মসূত্রে বা অন্য কোনও কারণে আমরা বাঙালিরা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে আছি, আর যে জিনিসটার অভাব আমরা সব থেকে বেশি অনুভব করি তা হল মায়ের হাতের রান্না। আগেকার দিনে মা দিদিমারা যখন রান্না করতেন,তখন হেঁশেল থেকে তার যে সুবাস নাকে ভেসে আসত, সেই স্বর্গীয় অনুভূতি আজকাল পাওয়াটা খুবই দুষ্কর।
আদা, রসুন,পেঁয়াজ কষিয়ে মাছ, মাংস মোটামুটি আমরা সকলেই রাঁধতে পারি, কিন্তু সমস্যাটা হয় নিরামিষ রান্নার ক্ষেত্রে। সপ্তাহের কিছু বিশেষ দিনে অনেক বাঙালি বাড়িতেই এখনও নিরামিষ রান্নার চল আছে। তাছাড়া মাঝেমধ্যে একটু নিরামিষ রান্নার স্বাদ নিতে আশাকরি সকলেরই বেশ ভালোই লাগে। মায়ের হাতের রান্নার সত্যি কোনও বিকল্প নেই। তাও একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা হিসেবে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করার জন্য তিনটি সুস্বাদু নিরামিষ রান্নার রেসিপি নিয়ে আজকে হাজির হয়েছি।
ধোঁকার ডালনা
নিরামিষ রান্নার কথা মনে হলেই যে নামটি সবার প্রথমে মনে পরে সেটি হল ধোঁকার ডালনা। যদিও বাজারে এখন অনেক ধরণের ধোঁকার ডালনার মিক্সচার চলে এসেছে, তবে সম্পূর্ণ ঘরের বিশুদ্ধ উপকরণ ব্যবহার করলে রান্নার স্বাদ এবং গুণমান দুটোই অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
এই অসাধারণ নিরামিষ রান্নার রেসিপি রইলো আপনাদের জন্য।
উপকরণ-
- ছোলার ডাল- ২৫ গ্রাম
- অড়হর ডাল- ২৫ গ্রাম
- কাঁচা লঙ্কা- ৮টি
- আদা- ১০ গ্রাম
- হিং- সামান্য পরিমাণ
- নুন- স্বাদ অনুযায়ী
- চিনি- স্বাদ অনুযায়ী
- হলুদ- পরিমাণ মতো
- শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো- ১ চা চামচ
- ধোনের গুঁড়ো- ৩ চা চামচ
- জিরের গুঁড়ো – ২ চা চামচ
- গরম মশলার গুঁড়ো- ১/৪ চা চামচ
- সরষের তেল- পরিমাণ মতো
- তেজপাতা- ১টি
- শুকনো লঙ্কা- ১টি
- গোটা জিরে- ১/৪ চা চামচ
- মৌরি – ১/৪ চা চামচ
- টমেটো (একটি ছোট টমেটোর অর্ধেক)
- চালমগজ- ১ টেবিল চামচ
- নারকেল কোরা- ১ টেবিল চামচ
- পোস্ত- ১/২ টেবিল চামচ
- ঘি- ১/২ চা চামচ

প্রণালী –
প্রথমে ছোলার ডাল এবং অড়হর ডাল সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখুন। এরপর ভিজিয়ে রাখা ডালের মধ্যে দুটো কাঁচা লঙ্কা ও অল্প আদা, সামান্য জল দিয়ে বেটে নিন, তবে একদম মিহি করে না বেটে অল্প দানা দানা রাখবেন, তাহলে ধোঁকাটি ভাজার পর বেশ মুচমুচে হবে।
এরপর বেটে নেওয়া ডালের মিশ্রণটির মধ্যে অল্প নুন, হলুদ, চিনি, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, ধোনের গুঁড়ো, জিরের গুঁড়ো আর গরম মশলার গুঁড়ো মিশিয়ে নিন।
কড়াইতে সামান্য পরিমাণে সরষের তেল গরম করে তারমধ্যে প্রথমে অল্প মৌরি ও একচিমটি হিং ফোড়ন দিয়ে বেটে রাখা ডালটি দিয়ে দিন এবং ততক্ষণ অবধি নাড়াচাড়া করতে থাকুন যতক্ষণ না মিশ্রণটি সম্পূর্ণ ভাবে দলা পাকিয়ে যায়।
এরপর একটি স্টিলের থালায় অল্প সরষের তেল মাখিয়ে তারমধ্যে ডালের মণ্ডটিকে হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিন এবং সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর চাকুর সাহায্যে বরফির আকারে কেটে নিন।
পুনরায় কড়াইতে সরষের তেল গরম করে কম আঁচে ধোঁকাগুলো উল্টেপাল্টে ভেজে নিন।
এবার তেলের মধ্যে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা আর গোটা জিরে ফোড়ন দিয়ে তারমধ্যে ১ টেবিল চামচ আদা বাটা, ৬ টা কাঁচা লঙ্কা বাটা, পরিমাণ মতো নুন, হলুদ, জিরের গুঁড়ো, ধোনের গুঁড়ো, সামান্য লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে ২ মিনিট মতো কষিয়ে নিন।
এরপর টমেটো, চালমগজ, নারকেল কোৱা আর পোস্ত বেটে নিয়ে বাকি মশলা গুলোর সঙ্গে মিশিয়ে ভালো করে কষিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিন। তারপর ভেজে রাখা ধোঁকাগুলো ঝোলের মধ্যে দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে ২ মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে শেষে অল্প ঘি ও গরম মশলা দিয়ে নামিয়ে নিন।
এই নিরামিষ রান্নার রেসিপিটি ভালো লাগলে অবশ্যই বানিয়ে ফেলুন এবং গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন আপনার প্রিয় মানুষটিকে।

ছানার ডালনা
আরও একটি জিভে জল আনা নিরামিষ রান্নার রেসিপি রইলো আপনাদের জন্য,যেটি বাঙালিদের অত্যন্ত প্রিয় একটি খাবার, আর সেটি হল ছানার ডালনা।সমস্ত ঘরোয়া উপকরণ দিয়ে অতি সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় এই পদটি।
উপকরণ-
- দুধ – ১ লিটার
- পাতিলেবু- অর্ধেক
- শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো- ১ চা চামচ
- ধোনের গুঁড়ো- ২ চা চামচ
- জিরের গুঁড়ো- ১ চা চামচ
- গরম মশলার গুঁড়ো- ১/২ চা চামচ
- নুন- স্বাদ অনুযায়ী
- চিনি- স্বাদ অনুযায়ী
- হলুদ – পরিমাণ মতো
- কাঁচা লঙ্কা- ৬-৭ টি
- বেসন – ২ টেবিল চামচ
- চালের গুঁড়ি- ১/২ টেবিল চামচ
- সরষের তেল- পরিমাণ মতো
- গোটা জিরে- ১/৪ চা চামচ
- শুকনো লঙ্কা -১টি
- তেজপাতা- ১টি
- টমেটো- ১টি (ছোট)
- আদা বাটা- ২ টেবিল চামচ
- কাজুবাদাম বাটা- ১ টেবিল চামচ
- পোস্ত বাটা- ১ টেবিল চামচ
- ঘি- ১/২ চা চামচ

প্রণালী –
প্রথমে দুধটাকে গরম করে তারমধ্যে লেবুর রস মিশিয়ে ছানা কাটিয়ে নিন। তারপর একটি কাপড়ের মধ্যে ছানাটিকে ঢেলে সম্পূর্ণ জল ঝরিয়ে নিন।লেবুর রস ছাড়া ভিনিগার ব্যবহার করেও ছানা কাটানো যায়, তবে লেবুর রসের আলাদাই একটি সুবাস আছে যা রান্নার স্বাদ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এরপর ছানাটির মধ্যে পরিমাণ মতো নুন, হলুদ, ধোনের গুঁড়ো, জিরের গুঁড়ো, গরম মশলার গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা কুঁচি, বেসন এবং চালের গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে মেখে একটি মণ্ড তৈরি করে নিন, তারপর ছোট ছোট গোলাকার বলের ন্যায় বানিয়ে সেগুলিকে অল্প আঁচে হালকা লাল লাল করে তেলে ভেজে তুলে নিন।
এরপর আদা, কাঁচা লঙ্কা, জিরের গুঁড়ো, ধোনের গুঁড়ো একসঙ্গে বেটে নিন। তারপর গোটা জিরে, শুকনো লঙ্কা আর তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে বেটে রাখা মশলাটি দিয়ে দিন এবং তারমধ্যে স্বাদ অনুযায়ী নুন, চিনি, পরিমাণ মতো হলুদ ও অল্প পরিমাণে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে তারপর টমেটো বাটা আর কাজুবাদাম ও পোস্ত বাটা দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিন।
সম্পূর্ণ কষানো হয়ে গেলে পরিমাণ মতো জল দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিন, তারপর ভেজে রাখা ছানার বড়াগুলো ঝোলের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ আঁচ বাড়িয়ে ২-৩ মিনিট মতো ফুটিয়ে শেষে অল্প পরিমাণে গরম মশলা আর ঘি দিয়ে নামিয়ে নিন।
এবার ছানার ডালনাটিকে সাদা ভাত অথবা পোলাও এর সাথে পরিবেশন করুন।
শুক্তো
বাড়ির প্রতিদিনের রান্না হোক কি কোনও অনুষ্ঠান বাড়ি, খাবারের পাতে আট রকম সবজির এই তিক্ত ব্যঞ্জনটি সব বাঙালিরই খুব পছন্দের। চলুন জেনে নেওয়া যাক বাঙালির এই ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ রান্নার রেসিপি।
উপকরণ-
- আলু- ১টি
- বেগুন- ১/২টি
- উচ্ছে- ২টি
- পেঁপে- ১/২টা
- কাঁচা কলা- ২টি
- সজনে ডাঁটা- ২টি
- রাঙা আলু – ১টি
- বরবটি- ৩-৪ টি
- রাঁধুনি- ১/২ চা চামচ
- পাঁচ ফোড়ন- ১/২ চা চামচ
- তেজপাতা- ১টি
- আদা- ৮ গ্রাম
- পোস্ত- ২ টেবিল চামচ
- সরষে- ১ টেবিল চামচ
- কাজু বাদাম- ১ টেবিল চামচ
- দুধ- ১ কাপ
- বড়ি- ৪-৫ টি
- ঘি- ২ টেবিল চামচ
- সরষের তেল- পরিমাণ মতো
- নুন- স্বাদ অনুযায়ী
- চিনি- স্বাদ অনুযায়ী

প্রণালী –
প্রথমে সব সবজিগুলোকে লম্বা করে কেটে নিন। তারপর শুকনো কড়াইতে ১/৪ চা চামচ করে সমপরিমাণ রাঁধুনি ও পাঁচ ফোড়ন দিয়ে একটু নেড়ে এগুলিকে বেটে নিয়ে একটি গুঁড়ো মশলা তৈরি করে রাখুন। এরপর পোস্ত, সরষে, কাজু বাদাম আলাদা করে বেটে নিন।
কড়াইতে সরষের তেল গরম করে প্রতিটা সবজি এবং বড়ি আলাদা করে ভেজে তুলে রাখুন। তারপর কড়াইতে অল্প ঘি গরম করে একটি তেজপাতা, ১/৪ চা চামচ পাঁচ ফোড়ন ও ১/৪ চা চামচ রাঁধুনি ফোড়ন দিন, এরপর আদা বাটা, পোস্ত বাটা ও কাজুবাদাম বাটা দিয়ে উচ্ছে আর বেগুন বাদে বাকি সবজিগুলো দিয়ে ভালোভাবে নাড়ুন। পরিমাণ মতো নুন দিয়ে কড়াইটাকে ৫ মিনিটের জন্য ঢেকে রাখুন। ৫ মিনিট পর কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে সবজি খানিকটা সেদ্ধ হয়ে এলে বেটে রাখা সরষে মিশিয়ে দিন।
সরষে, পোস্ত ও কাজুবাদাম বাটার সময় যে জল লেগেছিল সেটি না ফেলে দিয়ে ওই জলটি রান্নার মধ্যে ব্যবহার করুন এবং আবার ৩-৪ মিনিটের জন্য কড়াইটাকে ঢেকে রাখুন। এরপরে ভেজে রাখা বড়ি ও এক কাপ দুধ দিয়ে দিন। ভালো করে ফুটে উঠলে ভেজে রাখা উচ্ছে ও বেগুন দিয়ে দিন। শুক্তটাকে ১ মিনিট মতো ফুটিয়ে অল্প পরিমাণে আগে তৈরি করে রাখা ভাজা মশলা, স্বাদ অনুযায়ী চিনি আর সামান্য ঘি দিয়ে নামিয়ে নিন।
এরপর সময় নষ্ট না করে গরম গরম ভাতের সাথে এক বাটি শুক্তো নিয়ে জমিয়ে পেটপুজো করুন।

সাহিত্য ও শিল্পের সাথে রান্নার জন্যেও বাঙালি বিখ্যাত। আর এই তিনটি সুস্বাদু পদ অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক বাঙালির হেঁশেলে জায়গা করে নিয়েছে। আপনিও আপনার হেঁশেলে বানিয়ে ফেলুন এই তিনটি নিরামিষ রান্নার রেসিপি আর পরিবারের সকলের সাথে কব্জি ডুবিয়ে এর স্বাদ উপভোগ করুন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
That food looks so amazing! I would love to try any of it.
I’ve never tried any of these dishes but they all look delicious!
What a delicious selection of food. Reminds me of my time in Singapore when we always used to have banana leaf curry.
omg all these amazing food pics…I wannnttt…I love Indian cuisine a lot.
The presentation is very nice. Good company and good food are always nice.
This looks like a great adventure. I would love to enjoy that delicious selection of food and scenery.
Such an amazing spread of food, a cuisine which I would love to try myself