মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান

ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ। স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক কাহিনী। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র নামানুসারে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘মুর্শিদাবাদ'। ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বতন্ত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে সংঘটিত ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধের সাক্ষী এই স্থান।

কলকাতা শহরের কোলাহল থেকে অল্প দূরেই রয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থান। সপ্তাহান্তে আপনি চাইলেই অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন এই জায়গাটি থেকে। মুর্শিদাবাদে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান যেগুলি আজও তৎকালীন নবাবদের জীবনধারার ছবি আমাদের কাছে তুলে ধরে। এছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ স্থান।

আজকে আমার লেখনীতে রইল সেই রকমই কয়েকটি মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে কিছু বিশেষ তথ্য।

হাজারদুয়ারি

মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান বলতে প্রথমেই যে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের কথা মনে পরে সেটি হল হাজারদুয়ারি প্যালেস। নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের আদেশে ডানকান ম্যাকলিয়ডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এই প্রাসাদটি। মোট ১০০০টি দরজা থাকায় এই প্রাসাদের নামকরণ করা হয় হাজারদুয়ারি প্যালেস। তবে এই ১০০০টি দরজার মধ্যে ৯০০টি আসল ও বাকি ১০০টি নকল দরজা। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই নকল দরজাগুলি তৈরি করা হয়েছিল। পূর্বে এই প্রাসাদটি বড় কোঠি নামে পরিচিত ছিল।

এই প্রাসাদটি বর্তমানে প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এই প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই মিউজিয়ামের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি গ্যালারি যেগুলির মধ্যে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য শিল্প বস্তু, বহু দুর্মূল্য অয়েল পেন্টিং, শ্বেত পাথরের মূর্তি, রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, অমূল্য পুঁথিপত্র, লুকোচুরি আয়না, নানান ধরণের মূল্যবান ধাতব ও হাতির দাঁতের তৈরি বস্তু ইত্যাদি সংরক্ষণ করা আছে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতকে এত কাছ থেকে দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে এই হাজারদুয়ারি প্যালেসে।

কাটরা মসজিদ

হাজারদুয়ারির পরেই  মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে কাটরা মসজিদ। ১৭২৩-১৭২৪ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। যদিও বর্তমানে এই মসজিদটির কিছু অংশ ভূমিকম্পের জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তবে একসময়ে এই মসজিদেই প্রায় ২০০০ জন ব্যক্তি একসাথে প্রার্থনা করতে পারতেন। কাটরা মসজিদেই নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ-র ইচ্ছা অনুসারে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সাথে তৎকালীন স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এই কাটরা মসজিদ।

নিজামত ইমামবাড়া

আরও একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান হল নিজামত ইমামবাড়া। এই ইমামবাড়াটি শিয়া মুসলিমদের একটি পবিত্র জমায়েত স্থল। হাজারদুয়ারি প্যালেসের ঠিক বিপরীতে এটি অবস্থিত। পুরাতন ইমামবাড়াটি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৪০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৪২ সালে প্রথমবার এই ইমামবাড়াটিতে আগুন লেগে এর কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল। পরে ১৮৪৬ সালে পুনরায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ইমামবাড়াটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে যে ইমামবাড়াটি আমরা দেখতে পাই সেটি ১৮৪৭ সালে নবাব মনসুর আলী খান পুনরায় নির্মাণ করেছিলেন। সেই সময় প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচা করে তিনি এই ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেছিলেন। নিজামত ইমামবাড়া পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে সর্ব বৃহৎ ইমামবাড়া।

মতিঝিল

মতিঝিলের নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নবাব আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটি বেগমের নাম। ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান এই ঝিলটি তাঁর জন্য খনন  করিয়েছিলেন। এই ঝিলটির আকৃতি অনেকটা অশ্বক্ষুরের মত। সেই সময় এই ঝিলটিতে মুক্তা চাষ করা হত বলে জানা যায় এবং এই কারণেই এই ঝিলটির নামকরণ করা হয় ‘মতিঝিল'। এছাড়াও ঘসেটি বেগমের জন্য তাঁর স্বামী মতিঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, যদিও সেই প্রাসাদের কোনও চিহ্ন এখন আর নেই।

এই মতিঝিলের কাছেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার মতিঝিল পার্ক তৈরি করেছে, যা মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

কাঠগোলা বাগান

মুর্শিদাবাদের প্রধান আকর্ষণ হাজারদুয়ারি প্যালেস থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত কাঠগোলা বাগান। জিয়াগঞ্জের রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগর এই বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। এই বাগানবাড়িটি তৎকালীন স্থাপত্যকলার এক অন্যতম নিদর্শন।

কাঠগোলা বাগানবাড়ির নামকরণ নিয়ে বহু মতভেদ আছে। তবে লোকমুখে প্রচলিত যে এখানকার  বাগানে প্রচুর কাঠগোলাপ ফুলের গাছ ছিল। এই কাঠগোলাপ থেকেই এর নামকরণ হয় কাঠগোলা বাগান। আবার অনেকের মতে সেই সময় এখানে প্রচুর কাঠের গোলা ছিল, সেই কারণেই এই বাগানবাড়িটির এরূপ নামকরণ করা হয়।

এই বাগানবাড়ির ভিতরে একটি সুড়ঙ্গ আছে যেটি সরাসরি ভাগীরথী নদীর সাথে মিশেছে। এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে জগৎ শেঠের বাড়িতে যাওয়া যেত। যদিও বর্তমানে এই সুড়ঙ্গটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য। এছাড়া এখানকার সংগ্রহশালা, আদিনাথ মন্দির, চিড়িয়াখানা, শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো পুকুর দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক ভিড় করে।

নশিপুর রাজবাড়ি

মুর্শিদাবাদের নশিপুর রাজবাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে এক অত্যাচারী কুখ্যাত রাজার কাহিনী। আমরা এই রকম বহু রাজা মহারাজাদের কথা শুনেছি যারা কর আদায় করার জন্য প্রজাদের প্রতি নৃশংস অত্যাচার করতেন। সেই রকমই একজন অত্যাচারী রাজা ছিলেন রাজা দেবী সিংহ। ব্রিটিশদের তোষামোদকারী এই রাজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কঠোর রাজস্ব সংগ্রাহক হিসাবে খ্যাত ছিলেন। রাজা দেবী সিংহের দরবার ছিল এই নশিপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির অভ্যন্তরে একটি রাম মন্দির রয়েছে যেটি মুর্শিদাবাদের বৃহৎ মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম।

বর্তমানে এই রাজবাড়িটি একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে বহু মূল্যবান জিনিসপত্র  সংরক্ষিত আছে।

আজিমুন্নিসা বেগমের জীবন্ত সমাধি

জীবন্ত সমাধি কথাটা শুনেই নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে এর ইতিহাস। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই আজিমুন্নিসা বেগমের জীবন্ত সমাধির ইতিহাস। আজিমুন্নিসা বেগম ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র কন্যা। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই ব্যাধি নির্মূল করার জন্য এক নবাবী হাকিম তাঁকে প্রতিদিন একটি মানব শিশুর কলিজা দিয়ে ওষুধ তৈরি করে সেবন করাতেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পরও প্রতিদিন একটি করে শিশুর কলিজা খাওয়া তাঁর নেশায় পরিণত হয়। এরফলে নেশাগ্রস্থ আজিমুন্নিসা বেগম প্রতিদিন একটি করে শিশুর হত্যা করতে শুরু করেন। সম্পূর্ণ ঘটনাটি যখন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ জানতে পারেন তখন তিনি তাঁর কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন।

কিরীটেশ্বরী মন্দির

মুর্শিদাবাদ জেলার কিরীটকণা গ্রামে কিরীটেশ্বরী মন্দির অবস্থিত। হিন্দু শাস্ত্র মতে এই স্থানে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর কিরীট অর্থাৎ মাথার মুকুটের একটি কণা পতিত হয়েছিল। এই স্থানটি ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে একটি শক্তিপীঠ, তবে এই নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। যেহেতু দেবী সতীর শরীরের কোন অঙ্গ এই স্থানে পতিত হয়নি তাই অনেক তান্ত্রিক এই স্থানটিকে পূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে গণ্য করেন না, তাঁরা এই স্থানটিকে উপপীঠ বলেন।

এখানকার বর্তমান মন্দিরটি খুব বেশি প্রাচীন নয়। এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ পূজিত হয় না। এখানে একটি উঁচু পাথরের উপর বেদী তৈরি করা আছে, সেই বেদীর উপরে আরও একটি ছোট বেদী আছে, যা দেবীর কিরীট রূপে পূজিত হয়।

ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে কিরীটেশ্বরী মন্দির যথেষ্ট বিখ্যাত।

উল্লিখিত স্থানগুলি ছাড়াও এই ঐতিহাসিক শহরে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান যা হাতে গুনে শেষ করা যায় না। সেই দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানের নাম হল – সিরাজউদ্দৌলার সমাধি, জাফরাগঞ্জ কবরস্থান, ডাচ কবরস্থান, কর্ণসুবর্ণ, আর্মেনিয়ান চার্চ, জগৎ শেঠের বাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, জাহানকোশা কামান, ওয়াসেফ মঞ্জিল, সোনারুন্দি রাজবাড়ি, ফুটি মসজিদ, চার বাংলা মন্দির।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “মুর্শিদাবাদের সেরা দর্শনীয় স্থান

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: