চন্দননগরের শীর্ষ জগদ্ধাত্রী পূজা প্যান্ডেল

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিছু দিন আগেই শেষ হল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা, তারপর লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা, ভাইফোঁটা, আর এখন শুরু হয়ে গেছে জগদ্ধাত্রী পূজা। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা বাঙালি দল বেঁধে আবার বেড়িয়ে পড়েছে প্যান্ডেল হপিং- এ।

কলকাতার দুর্গা পূজা যেমন জগদ্বিখ্যাত, ঠিক সেই রকমই চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজারও জগৎ জোড়া খ্যাতি আছে। চন্দননগরবাসীদের কাছে এই উৎসব দুর্গা পূজার থেকে কিছু কম নয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরেও ধূমধাম করে পালিত হয় জগদ্ধাত্রী পূজা। তবে হুগলী জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা মানুষের মনে এক আলাদাই জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার লাইটিং দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় জমা হয়। এছাড়া এখানকার প্যান্ডেল থেকে শুরু করে অপরূপ সুন্দর মাতৃ প্রতিমাগুলি দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে।

আজকে আমার লেখনীতে রইল এই বছরের চন্দননগরের কয়েকটি সেরা জগদ্ধাত্রী পূজার প্যান্ডেল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তথ্য।

রথেরসড়ক

রথেরসড়কের জগদ্ধাত্রী পূজা এই বছর ৫২তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। তবে করোনার জন্য যেহেতু দুই বছর এই পূজা সেই রকম জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়নি, তাই এই বছর এখানে পঞ্চাশ বছর পূর্তির মতো করে উদযাপিত হচ্ছে জগদ্ধাত্রী পূজা। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত মণ্ডপ শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলার নিখুঁত শিল্পকর্মে সেজে উঠেছে এখানকার মণ্ডপ। এই বছরে এখানকার থিম ‘ঐক্যতান'। পঞ্চমী থেকেই শুরু হয়ে গেছে দর্শনার্থীদের আগমন। এই বছর রথেরসড়ক সেরার সেরা তালিকায় তার অসাধারণ মণ্ডপসজ্জা ও চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জার জন্য নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

কৃষ্ণপট্টি সার্বজনীন

কৃষ্ণপট্টি সার্বজনীনের জগদ্ধাত্রী পূজা এই বছর ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষ্যে এই বছরে এখনকার থিম ‘মহেঞ্জোদারো'। মহেঞ্জোদারো শহরের অনুকরণে তৈরি হয়েছে এখানকার মণ্ডপটি। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহাসিক শহরের একটা ছোট্ট ট্যুর করার আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে কৃষ্ণপট্টি সার্বজনীন। এই মণ্ডপের সাজসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক রঙ্গাজীব রায়। চন্দননগরের শীর্ষ জগদ্ধাত্রী পূজার প্যান্ডেলগুলির মধ্যে কৃষ্ণপট্টি সার্বজনীন অন্যতম।

বড়বাজার সার্বজনীন

এই বছর ৬০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে চন্দননগরের বড়বাজার সার্বজনীনের পূজা। এই বছর এখানকার থিম ‘সিটি অফ জয়'। পুরানো শহর কলকাতার রূপকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই থিমের মাধ্যমে। এইবার কলকাতা হেঁটে দেখার জন্য আর কোলকাতায় যেতে হবে না। বড়বাজার সার্বজনীন এইবার কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে নিয়ে এসেছে চন্দননগরে। অপরূপ মণ্ডপসজ্জার সাথে চন্দননগরের বিখ্যাত আলোকসজ্জা এবং মনোমুগ্ধকর দেবী প্রতিমা দর্শন করতে মানুষের ভিড় জমেছে এই পূজা মণ্ডপে।

উর্দ্দিবাজার সার্বজনীন

উর্দ্দিবাজার সার্বজনীনের পূজা এই বছর ৬০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। হীরক জয়ন্তী বর্ষে এইবারে এখানকার থিম ‘সমষ্টি'। বাংলার বিখ্যাত তাঁত শিল্পকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই থিমের মাধ্যমে। তাঁত বোনার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস দিয়ে এই মণ্ডপটিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। এই মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী অভিজিৎ ঘটক।

সরিষা পাড়া সার্বজনীন

৫১তম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে এই বছর সরিষা পাড়া সার্বজনীনের জগদ্ধাত্রী পূজার থিম ‘তাড়িতী'। আলোর শহর মানেই চন্দননগর, আর এই অসাধারণ আলোকসজ্জার পিছনে রয়েছে বহু দক্ষ শিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রম। সেই সমস্ত বিখ্যাত শিল্পীদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে এই বছরে এই থিমটি বেছে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির মডেল তৈরি করে সেইগুলি ব্যবহার করা  হয়েছে এই মণ্ডপসজ্জার কাজে। এই মণ্ডপের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা এবং সজ্জার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী বিমান সাহা। স্বল্প পরিসর জায়গার মধ্যে এই অপূর্ব মণ্ডপটি দর্শনার্থীদের বেশ আকর্ষণ করেছে।

নিয়োগী বাগান

এই বছর ৩৪তম বর্ষে পদার্পণ করল নিয়োগী বাগানের পূজা। এখানকার পূজা কমিটি এই বছরের থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘রাজস্থান'। রাজস্থানের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি কে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই থিমের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ মণ্ডপসজ্জায় রয়েছে এক রাজকীয় ব্যাপার। নিয়োগী বাগান জগদ্ধাত্রী পূজার মণ্ডপ শিল্পী হলেন গৌরাঙ্গ কুইলা। চন্দননগরের শীর্ষ স্থানীয় মণ্ডপগুলির মধ্যে এই মণ্ডপটি অন্যতম।

উত্তরাঞ্চল সার্বজনীন

উত্তরাঞ্চল সার্বজনীনের পূজা এই বছর ৭৬তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই বছরে এখানকার থিম ‘অশনি সংকেত'। সবুজ অরণ্য কেটে তৈরি হচ্ছে গগনচুম্বী অট্টালিকা। মাল্টিপ্লেক্স, বড় বড় ফ্ল্যাট তৈরি করার জন্য বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে বহু জলাশয়। সৌন্দর্যায়নের যুগে কোথায় যেন ধীরে ধীরে প্রাণ হারাচ্ছে প্রকৃতি। আমাদের অবহেলায় এবং অনাচারে ধ্বংসের মুখে পৃথিবী। সমগ্র জীব জগৎ এক ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন হতে চলেছে যা এখানকার থিমের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই মণ্ডপের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা এবং সজ্জার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী মলয় ও শুভময়। এই থিমের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে যে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তা এই মণ্ডপটিকে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার সেরা মণ্ডপগুলির তালিকায় জায়গা করে দিয়েছে।

সার্কাস মাঠ

এই বছর ৫২তম বর্ষে পদার্পণ করল সার্কাস মাঠের পূজা। এই বছরে এখানকার থিম ‘রাজমহল'। শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলার পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ মণ্ডপটি সেজে উঠেছে একটি রাজবাড়ীর সাজে। মণ্ডপসজ্জা থেকে শুরু করে আলোকসজ্জা, মাতৃ প্রতিমা সবেতেই আর পাঁচটি সাধারণ মণ্ডপকে ছাপিয়ে গেছে সার্কাস মাঠের এই পূজা মণ্ডপটি। এছাড়া মণ্ডপের সামনে এখানে প্রতি বছরই মেলা বসে, যা বিশেষ করে শিশুদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে।

খলিসানী সার্বজনীন

খলিসানী সার্বজনীনের পূজা এই বছর ৭৪তম বর্ষে পদার্পণ করল। আমাদের গোটা সমাজ কৃষকদের উপর নির্ভরশীল এবং তাদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকব। খলিসানী সার্বজনীনের এই বছরের থিম সেই কৃষকদেরকেই উৎসর্গ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ গ্রাম্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে এই পূজা মণ্ডপটিতে। কোদাল, কাস্তে, বেতের ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে মণ্ডপসজ্জার কাজে। সমগ্র ভাবনাটি  যার মস্তিষ্ক প্রসূত, তিনি হলেন শিল্পী প্রশান্ত পাল।

হেলাপুকুর সার্বজনীন

এই বছর ৫৩তম বর্ষে পদার্পণ করল চন্দননগরের হেলাপুকুর সার্বজনীনের পূজা। এই বছর হেলাপুকুরের নিবেদন ‘আলপনা'। বাংলার একটি প্রাচীন লোকচিত্র আলপনা এবং সেই আলপনাকেই কেন্দ্র করে এই সমগ্র মণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছে। শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলার আরও একটি নিপুণ শিল্পকর্মের নিদর্শন এই পূজা মণ্ডপ।

বোড় তালডাঙ্গা

বোড় তালডাঙ্গার পূজা এই বছর ৫৩তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এখানকার এই বছরের থিম ‘আকাশবাণী'। ঠিকই ধরেছেন, এই বছরের কলকাতার আহিরীটোলা সার্বজনীনের দুর্গা পূজার সম্পূর্ণ মণ্ডপটি উঠে এসেছে চন্দননগরের বোড় তালডাঙ্গায়। স্বর্ণযুগের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের স্মরণে এই পূজা মণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভাবনাটি শিল্পী দেবজ্যোতি জানার মস্তিষ্ক প্রসূত।

গ্রামোফোন, টেপ রেকর্ডার, রেডিও এইসবের ব্যবহার এখন হয়না বললেই চলে। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে এই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামোফোন, রেডিও ইত্যাদির মডেল।

নতুনপাড়া

চন্দননগরের নতুনপাড়ার পূজা এই বছর ৪৮তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই বছরে এখানকার থিম ‘ছৌ নহে সামান্যা, ছৌ অনন্যা'। এই মণ্ডপটির মূল ভাবনায় রয়েছে বাংলার বিখ্যাত লোকনৃত্য ছৌ নাচ। ধামসা, মাদল, ছৌ মুখোশ ইত্যাদির মডেল তৈরি করে ব্যবহার করা হয়েছে মণ্ডপসজ্জায়। এই মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী পুলক ঘোষাল। তার নিপুণ শিল্পকর্মে এই পূজা মণ্ডপটি এক অসাধারণ রূপ পেয়েছে।

উল্লিখিত পূজা মণ্ডপগুলি ছাড়াও অগুনতি মণ্ডপ রয়েছে যেগুলি সেরার তালিকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মণ্ডপ হল-  বোড় পঞ্চাননতলা, কলপুকুর ধার, কানাইলাল পল্লী, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, মরান রোড, সুরের পুকুর, দৈবকপাড়া, বৈদ্যপোঁতা ইত্যাদি। এছাড়া চন্দননগরের তেমাথা সার্বজনীন তাদের উচ্চতম জগদ্ধাত্রী প্রতিমার জন্য সেরার তালিকায় নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “চন্দননগরের শীর্ষ জগদ্ধাত্রী পূজা প্যান্ডেল

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: