কলকাতার সেরা বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা

যদিও মা দুর্গা মর্ত্য বাসীদের বিদায় জানিয়ে কৈলাসে গমন করেছেন, তাও দুর্গাপূজার রেশ রয়ে গেছে প্রত্যেকটি বাঙালির মনে। এই বছর দুর্গাপূজায় উত্তর থেকে দক্ষিণ অথবা মধ্য কলকাতা কিংবা শহরতলী যে দিকেই চোখ গিয়েছে দেখা গেছে শুধু থিম আর থিম। থিমের ঘনঘটায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সাবেকিয়ানা।

কয়েক শতক বছর আগে কলকাতার বিভিন্ন বনেদি পরিবারগুলির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বাঙালির প্রিয় দুর্গোৎসব। সময়ের সাথে সাথে সব কিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, শুধু ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গেছে এই সমস্ত শতাব্দী প্রাচীন বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজাগুলি। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক কলকাতার এই রকমই কয়েকটি বিখ্যাত বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা সম্বন্ধে।

সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা

সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পশ্চিমবাংলার একটি সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন কলকাতার জায়গীরদার। ১৬৯৮ সালের ১০ই নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রামের প্রজাস্বত্ব এই পরিবারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিল। 

সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা কলকাতার সম্ভবত প্রথম বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার ১৬১০ সালে এই পূজা শুরু করেন। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পূজা মোট আটটি বাড়িতে হয়। বড়িশার আটচালায় প্রধান পূজাটি পালিত হয়। বড়িশার বাকি পূজাগুলি বড় বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি, মেজো বাড়ি ও কালীকিঙ্কর ভবনে পালিত হয়। এছাড়া বিরাটি ও নিমতার পাঠানপুরের বাড়িতে বাকি দু'টি পূজা উদযাপিত হয়। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী-তে লিখিত নিয়মানুযায়ী তন্ত্র মতে এই পরিবারে দেবী দুর্গা পূজিত হন। পূজায় মায়ের ভোগে ল্যাটা মাছ ও শোল মাছ নিবেদন করা হয়। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত পুকুরে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন করা হয়।

শোভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা

১৭৫৭ সালে মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই সময় লর্ড ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংস শোভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গাপূজায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা এই রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় নিজেদের চরণধূলি দিয়েছেন। তখনকার দিনে দুর্গাপূজার সময় এই রাজবাড়িতে নিধু বাবু টপ্পা গাইতেন, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বহুবার এখানে কবির লড়াই করেছেন। এইরকম বাংলার বহু ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে শোভাবাজার রাজবাড়ীর এই দুর্গাপূজার সাথে।

পারিবারিক রীতি অনুযায়ী রথযাত্রার দিন শোভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পূজা সম্পন্ন হয়। অতীতে শোভাবাজার রাজবাড়ীর সন্ধিপূজা শুরু হত কামানের তোপ দেগে এবং এর সমাপ্তিও ঘটত কামানের গোলার শব্দে। যদিও কামানের ব্যবহার এখন আর নেই, তবে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে এখনও চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বন্দুকের গুলির শব্দে শুরু হয় সন্ধিপূজা। এই রাজ পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস সন্ধিপূজার এই শুভ ক্ষণে দেবী দুর্গা তাঁর ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন। পূর্বে বিসর্জনের আগে কৈলাসে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে মা দুর্গার আগমনের বার্তা বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য নীলকণ্ঠ পাখি ছেড়ে দেওয়ার রীতি ছিল। বর্তমানে সেই নিয়ম অক্ষুণ্ণ রেখে মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সেই বার্তা বহনের উদ্দেশ্যে।

জানবাজারের রানী রাসমণির বাড়ির দুর্গাপূজা

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রানী রাসমণির জানবাজারের সাত মহলা বাড়ির দুর্গাপূজা কলকাতার বিখ্যাত বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে অন্যতম। ২৩০ বছর পুরানো এই বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা রানী রাসমণির বাড়ির দুর্গাপূজা নামেই বিখ্যাত। রানী রাসমণির শ্বশুরমশাই জমিদার প্রীতরাম দাস ১৭৯২ সালে জানবাজারের বাড়িতে প্রথম এই দুর্গাপূজা শুরু করেন। তাঁর পুত্র রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে ১১ বছর বয়সে রাসমণির বিবাহ হয়। পরবর্তীকালে রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর রানী রাসমণি এই পূজার সমস্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর সহ বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এই বাড়িতে উপস্থিত থাকতেন। কথিত আছে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নারী বেশে এই বাড়িতে দুর্গাপূজা করেছিলেন। এই বাড়ির একচালা বিশিষ্ট দেবী মূর্তিটি কোন রকম ছাঁচ ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করা হয়। রানী রাসমণির বাড়ির দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে সপ্তমী থেকে নবমী এই তিন দিনই কুমারী পূজা করা হয়। আজও এই ঐতিহ্যমণ্ডিত বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা অতীতের সব রকম পারিবারিক নিয়ম-কানুন ও আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সাবেকিয়ানা বজায় রেখেছে।

লাহা বাড়ির দুর্গাপূজা

এই বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা ঠিক কে, কবে, কোথায় শুরু করেছিলেন তার সঠিক তথ্য ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কথিত আছে এই পরিবারের কোন এক গৃহবধূ একটি অষ্টধাতুর মূর্তির স্বপ্ন পান। সেই মূর্তিকে ডাকাতরা জলে ফেলে দিয়েছিল। সেই অষ্টধাতুর মূর্তি উদ্ধার করে লাহা পরিবারে প্রথম দুর্গাপূজা করা হয়। এই মূর্তি এখনও সারা বছর এখানে পূজিত হয়। ইতিহাস ঘেঁটে যেটুকু জানা গেছে তা হল শ্রী মধুমঙ্গল লাহা ২০০ বছরেরও অধিক সময় পূর্বে চুঁচুড়ায় এই দুর্গাপূজা করতেন। পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সাল থেকে কলকাতায় এই পূজা শুরু হয়। এই দুর্গাপূজা রাজা প্রাণকৃষ্ণ লাহা, নবকৃষ্ণ লাহা ও শ্রীকৃষ্ণ লাহা এই তিনজনের বাড়িতে প্রতি বছর পালা করে উদযাপিত হয়।

লাহা বাড়িতে প্রতিবছর একই কাঠামো ব্যবহৃত হয় দেবীর মূর্তি তৈরি করার জন্য। সচরাচর  মহিষাসুরমর্দিনীর রুদ্র মূর্তি বিভিন্ন বনেদি বাড়ি ও বারোয়ারি পূজা মণ্ডপগুলিতে পূজিত হয়, কিন্তু লাহা বাড়িতে পূজিত হয় হরগৌরীর প্রতিমা। লাহা বাড়িতে মা দুর্গা শিব ঠাকুরের কোলে অবস্থান করেন এবং এই পরিবারের পূজায় মহিষাসুর থাকে না। কুলদেবী ‘জয় জয় মা'-কে দুর্গাপূজার সময় দেবী প্রতিমার সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহাষ্টমীতে এই পরিবারের বিবাহিত মহিলারা মাটির সরায় ধুনো জ্বালিয়ে দুই হাতে ও মাথার উপরে সেই সরাগুলি রেখে নিষ্ঠার সাথে দুর্গা প্রতিমার সামনে বসে প্রার্থনা করেন। আজও লাহা পরিবারের সদস্যরা তাদের এই পারিবারিক ঐতিহ্যকে একই ভাবে বজায় রেখে চলেছেন।

বদন চন্দ্র রায় বাড়ির দুর্গাপূজা

বদন চন্দ্র রায়ের পূর্বে তাঁর পিতা মদন মোহন রায় প্রায় ২৫ বছর এই পূজার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বদন চন্দ্র রায় সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন বেশ কিছু বছর এই পূজা বদন চন্দ্র রায়ের বসত বাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে জোড়াসাঁকোর অনন্ত রায়ের বাড়িতে উদযাপিত হয়েছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে এই পূজা আবার কলেজ স্ট্রিটের রায় বাড়িতে ধুমধাম করে পালিত হতে শুরু করে। ১৬৫ বছর পুরানো এই বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা এখনও রায় পরিবারের সদস্যরা সাড়ম্বরে প্রতি বছর পালন করে চলেছেন।

উল্টোরথের দিন রায় বাড়ির দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পূজা হয়। মহালয়ার পরের দিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দেবীর বোধন হয়। এই বাড়ির ঠাকুর দালানেই এখানকার প্রতিমা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। এখানে দেবী ডাকের সাজে সেজে ওঠেন। একচালা এই দুর্গা প্রতিমার সমস্ত গয়না সোনা দিয়ে তৈরি এবং অস্ত্রগুলি রুপার তৈরি। এই পরিবারের রীতি অনুযায়ী বিসর্জনের সময় দুর্গা প্রতিমাকে পালকি করে নিয়ে যাওয়া হয়।

রায় পরিবারের সমস্ত সদস্যরা দুর্গাপূজার সময় একত্রিত হন এই রায় বাড়িতে। জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্বশুরমশাই সঞ্জীব রায় এই পরিবারের একজন অন্যতম সদস্য।

ঐতিহ্যের সাথে ইতিহাসের অপরূপ মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় এই সমস্ত বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজাগুলিতে। সারা বছর এই বনেদি বাড়িগুলিতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও বছরের এই বিশেষ কয়েকটি দিনে জাতপাত নির্বিশেষে সকলের অবাধ প্রবেশের অনুমতি থাকে। তাই ষোলো আনা সাবেকিয়ানার ছোঁয়া পেতে চাইলে অতি অবশ্যই একবার হলেও এই বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজাগুলিতে সপরিবারে উপস্থিত হয়ে যাবেন।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “কলকাতার সেরা বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: