গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা
গ্রীষ্মের দাবদাহে এবারে সকলেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই প্রখর তাপে ভ্রমণের ইচ্ছাও যেন অনেকটাই কমে গেছে। তবে ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে এসি-র শীতল হাওয়ায় ভ্রমণপিপাসু বাঙালিকে কি আটকে রাখা সম্ভব? তাই অনেকেই হয়তো খুঁজছেন কিছু শান্ত, শীতল জায়গা, যেখানে এই গ্রীষ্মের কয়েকটি দিন বেশ আরামে কাটানো যেতে পারে। আর এখন মানুষ কোলাহল বিহীন নিরিবিলি অফবিট জায়গাগুলিকেই বেশি পছন্দ করেন। তাই শীতলতার ছোঁয়ায় কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য আজকে আমি চলে এসেছি বেশ কয়েকটি অফবিট জায়গার সন্ধান নিয়ে। চলুন তাহলে, গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গাগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ইয়েলবং
গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গার কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পরে নর্থ বেঙ্গলের কথা। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে যে জায়গাগুলিকে প্রকৃতি যেন তার সবটুকু উজাড় করে সাজিয়ে তুলেছে। বিশেষত এই গরমের সময় দক্ষিণবঙ্গের লোকেরা দল বেঁধে উত্তরবঙ্গে পাড়ি দেয় গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে কয়েক দিনের জন্য রেহাই পেতে।
এই উত্তরবঙ্গেরই কালিম্পং জেলায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম ইয়েলবং। এই গ্রামের প্রধান আকর্ষণ এখানকার রিভার ক্যানিয়ন। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা এই রিভার ক্যানিয়নে ট্রেক করার অভিজ্ঞতা কখনই হাতছাড়া করবেন না। পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ২ কিলোমিটার লম্বা নদীপথ প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি যা আপনাকে আপ্লুত করে তুলবে।
ফ্রাঞ্চিস নামক ইয়েলবং গ্রামের এক স্থানীয় বাসিন্দা এই ক্যানিয়নটি আবিষ্কার করেন। এর পেছনে আছে একটি ছোট্ট গল্প। ইয়েলবং-এ রয়েছে কয়লার খনি, ফলে এখানে হীরে পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আর সেই হীরের সন্ধান করতে গিয়ে ফ্রাঞ্চিস খোঁজ পায় এই রিভার ক্যানিয়নের।
এই রিভার ক্যানিয়নের ভিতরে নদীর জলের তাপমাত্রা কম থাকায় গ্রীষ্মকালে এখানে ট্রেকিং করলে তা খুবই আরামদায়ক হয়। এর সাথে আপনি রিভার সাইড নাইট ক্যাম্পিং করতে পারেন, যা আপনার এই অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রিপটিতে এক আলাদাই মাত্রা এনে দেবে। এছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি হোম স্টে-ও রয়েছে।
ট্রেকিং ছাড়াও এখানে রয়েছে ছোট বড় বহু পাহাড়ি ঝর্ণা, এর মধ্যে এখানকার বিখ্যাত রেইনবো ওয়াটার ঝর্ণাটির বিশেষত্ব হল এই যে এই ঝর্ণার জলে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে রামধনু সৃষ্টি করে যা আপনার দু'চোখে এনে দেবে এক প্রশান্তির অনুভূতি। পাহাড়ে ঘেরা শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য ইয়েলবং আদর্শ একটি জায়গা।
তোদে তাংতা
পশ্চিমবঙ্গ ও ভুটান সীমান্তে কালিম্পং জেলার একেবারে উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শেষ গ্রামটি হল তোদে। আর তার ঠিক পাশেই রয়েছে আরও এক পাহাড়ি গ্রাম তাংতা।
পাশাপাশি অবস্থিত এই দুই গ্রাম থেকে আপনার চোখে পড়বে ভুটানের তুষারাবৃত পাহাড়ের দৃশ্য। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে এলাচের চাষ হয়, সেই কারণে এলাচের গন্ধে ম ম করে চারপাশ। অনতি দূরেই রয়েছে নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ফলে এই জনপদ দুটিকে দেখে মনে হয় যেন কেউ সবুজ চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে।
পাহাড়ের রহস্যময় সৌন্দর্য হাতছানি দেয় রাতের নিস্তব্ধতায়, যদিও সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেও প্রকৃতি কিন্তু চুপ থাকে না। এই গ্রাম দুটির মধ্যে দিয়ে আপন মনে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী, আর তারই স্রোতের কলকল ধ্বনি প্রতি নিয়ত পাহাড়ের নীরবতা ভঙ্গ করে চলেছে। যদিও সেই শব্দ খুবই মনোটোনাস, তাও যেন তার প্রত্যেকটি তরঙ্গে রয়েছে এক আলাদাই মাধুর্য।
এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ডোম ক্যাম্পিং টেন্ট। এই টেন্টের জানালা দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়া চাঁদের তরল আলো আর মেঘেদের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো অসাধারণ অভিজ্ঞতা আপনার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর নির্মল, স্নিগ্ধ, ছোট্ট এই জনপদ দুটি গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গার তালিকায় নিজেদের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।
ধোত্রে
অফবিট দার্জিলিং-এর ধোত্রে নামটি হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। কিন্তু গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গাগুলির মধ্যে বর্তমানে ধোত্রে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা সান্দাকফু ট্রেক করতে যান তাদের মানেভঞ্জন নামটির সাথে বেশ পরিচিতি রয়েছে, আর এই মানেভঞ্জন থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার গেলেই সিঙ্গালীলা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ছোট্ট, অনাঘ্রাত একটি গ্রাম এই ধোত্রে। এখানে জনবসতি খুবই কম, সাকুল্যে তিরিশটি পরিবার হবে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে সাজানো প্রতিটি বাড়ির চালের রং সবুজ হওয়ায় এই গ্রামের আরেক নাম ‘গ্রিন ভিলেজ'। এখানে যতদূর চোখ যায় শুধু দেখা মেলে ঘন পাইন বন ও পাহাড়ের গা বেয়ে সবুজ ফার্ন গাছ আর নানান রঙের ডেইজি, রডোডেনড্রন, অর্কিডের। তবে এখানে সব থেকে বড় পাওনা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। আর ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতে পারে সিঙ্গালীলা ন্যাশনাল পার্কের স্থায়ী বাসিন্দা রেড পান্ডা বা লেপার্ডের সাথে।
এই জায়গাটির উচ্চতা প্রায় ৮,৩৪০ ফিট, ফলে এখানে প্রায় সারা বছর শীত স্বমহিমায় বিরাজমান। তাহলে আর দেরি কিসের, শীতল হওয়ার নেশায় মেতে উঠতে তাড়াতাড়ি চলে আসুন এই শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামটিতে।
টংলু
সান্দাকফুতে ট্রেক করতে গেলে যেমন ধোত্রেতে একটি রাত কাটানো অত্যাবশ্যক, সেইরকমই ধোত্রে থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে ট্রেক করে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন আরও এক অনাঘ্রাত গ্রাম টংলুতে। সিঙ্গালীলা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত একটি ছোট্ট জনবসতি টংলু, যেটি সিঙ্গালীলা পর্বতশ্রেণীর উচ্চ শৃঙ্গগুলির মধ্যে একটি। যদিও আগে টংলু মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত ট্রেকিং-এর মাঝে বিশ্রামস্থল হিসেবেই পরিচিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে ট্রেকাররা ছাড়াও বহু পর্যটক ভিড় জমায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তাই আপনার যদি ট্রেকিং-এর প্ল্যান না থাকে, তাহলে আপনি সরাসরি গাড়ি করে পৌঁছে যেতে পারেন টংলুতে। শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঝকঝকে নীল আকাশ ও রহস্যে মোড়া পাহাড়ি রাস্তা সব মিলিয়ে এখানে কাটানো কয়েকটি দিন আপনার হৃদয়ের ক্যানভাসে বন্দী হয়ে থাকবে।
এই গ্রামে বেশ কয়েকটি হোম স্টে আছে, তাই থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যাই আপনার হবে না।
দার্জিলিং-এর সবচেয়ে উঁচু গ্রাম এই টংলু, তাই বলাই বাহুল্য যে এই গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে এই পাহাড়ি গ্রামটিকে আপনার সামার হলিডে ডেস্টিনেশন হিসাবে নিঃসন্দেহে বেছে নিতে পারেন।
সিটং
গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গাগুলির মধ্যে দার্জিলিং-এর আরও একটি জায়গা পর্যটকদের মন কেড়েছে, আর সেটি হল পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে ঢাকা সাজানো এক লেপচা জনপদ সিটং। কার্শিয়াং সাবডিভিশনে অবস্থিত এই জনপদটি কমলালেবুর গ্রাম নামেই বেশি পরিচিত। দার্জিলিং-এর কমলালেবুর বেশির ভাগই সিটং-এ উৎপন্ন হয়, তাই এই গ্রামটিকে দার্জিলিং-এর কমলালেবুর হৃদয় বলা হয়। আর এই কমলালেবুর বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে তন্বী নদী রিয়াং। এখানে পাহাড়ি সৌন্দর্যের সাথে মেঘেদের আনাগোনা দেখে মনে হয় যেন কোনো চিত্রকর তার নিখুঁত তুলির টানে এক অপরূপ ছবি এঁকেছেন। সিটং থেকে আপনি চাইলে লাটপাঞ্চার, অহলদাড়া, শেলপু-ও ঘুরে আসতে পারেন।
তাবাকশি
দার্জিলিং-এর পর্যটন মানচিত্রের নতুন এক আকর্ষণ তাবাকশি। দার্জিলিং বলুন কিংবা মিরিক, এখন এই দুই জায়গাই হয়ে উঠছে ঘিঞ্জি এবং ব্যস্ত। তাই মিরিক থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, পূর্ব হিমালয়ের কোলে রাংভাং নদীর উপর অবস্থিত এক ঘুমন্ত গ্রাম তাবাকশি বর্তমানে হয়ে উঠেছে শান্তিপ্রিয় পর্যটকদের মূল আকর্ষণ।
তাবাকশির বিশেষত্ব হল এই যে, এখানে শীতে না পড়ে বেশি ঠাণ্ডা, আবার গরমও এখানে বিশেষ পড়ে না বললেই চলে। ১৭-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, আশা করি এটা শুনে আপনাদের মন চাইছে কলকাতার ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমের হাত থেকে বাঁচতে এই শান্ত শীতল জায়গাটিতে ছুটে চলে আসতে।
গোপালধারা টি এস্টেটের লাগোয়া অঞ্চলে অবস্থিত উত্তরকন্যার কোলে লুকিয়ে থাকা এই পাহাড়ি গ্রামটির মূল আকর্ষণ এখানকার চা বাগান। চা বাগানের স্নিগ্ধ মাধুর্য, নাম না জানা পাখিদের কলকাকলি, নদীর অবিশ্রান্ত জলধারার মন মাতানো শব্দ, তার সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি, সব মিলিয়ে এই অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই পর্যটকেরা বার বার ফিরে আসেন এই পাহাড়ি গ্রামটিতে।
সমস্ত হিসেবে নিকেশ ভুলে সরলতাকে আঁকড়ে বাঁচার মজাটাই আলাদা, আর এই পাহাড়ি গ্রামগুলিতে সেই সরলতার কোনো অভাব নেই। প্রকৃতি অতি যত্নের সাথে এই জায়গাগুলিকে সাজিয়ে তুলছে, আর তার সাথে সাথে এই পাহাড়ি গ্রামগুলির শোভা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে এখানকার লোকেদের আতিথেয়তা। এই গরমে কংক্রিটের শহর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কোলে কয়েকটি দিন কাটাতে গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার এই সেরা জায়গাগুলির মধ্যে যেকোনো একটি জায়গাকে আপনি বেছে নিতে পারেন আপনার গন্তব্য হিসেবে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.