আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩

“সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

নারীর অবদান যে পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয়, নারী ও পুরুষ যে একে অপরের পরিপূরক, তারই এক অপরূপ ছবি ধরা পড়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘নারী' কবিতায়। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে সমাজ, বদলেছে মানুষের দৃষ্টিকোণ। একদা অবহেলিত ও নিপীড়িত নারী জাতি এখন সভ্যতার অভাবনীয় সাফল্যের পথে পুরুষদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে নিজেদের অবদান রেখে চলেছে। তবুও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যাঁতাকলে চিরকালই পিষে চলেছে নারী শক্তি। সেকাল হোক কি একাল, সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও লিঙ্গ বৈষম্যতার কারণে নারীকে প্রতিনিয়ত দিতে হয় তার ন্যায্য অধিকারের বলিদান। ৮ই মার্চ, এই বিশেষ দিনটিতে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আজকে আমার লেখনীতে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি সম্পর্কে রইল কিছু বিশেষ তথ্য।

নারী দিবসের ইতিহাস

ঘটনাটি ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চের। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন অসম মজুরি, মানবেতর পরিবেশ ও ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে। সেই মহিলা শ্রমিকদের উপর শুরু হয় পুলিশি নির্যাতন এবং তাদেরকে নিক্ষিপ্ত করা হয় কারাগারে। সেই আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দমানো গেলেও তার আগুন সম্পূর্ণ নেভানো যায়নি।

১৮৬০ সালের ৮ই মার্চ সেই কারখানার মহিলা শ্রমিকরা ‘মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন' গঠন করেন এবং সেই আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।

এরপর ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ শুরু হয় আরও এক আন্দোলন, নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলন। যে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন নিউইয়র্কের দরজি শ্রমিকরা। ১৯১০ সালে সেই আন্দোলনের ফলস্বরূপ নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায়।

অতঃপর এই সূত্র ধরেই কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে একটি পার্টি সম্মেলনে ঘোষণা করেন, প্রতি বছর মার্চ মাসের যেকোনো একটি দিন নারীর অধিকার রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। ১৮৫৭ এবং ১৯০৮ সালে যে দুটি যুগান্তকারী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন দুটির সূচনা দিবস ৮ই মার্চ হওয়ায় এই দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে।

১৯১০ সালের ২৭শে আগস্ট ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ও কাথে ডাঙ্কার স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। প্রায় ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য

আজকের এই বিশেষ দিনের সাথে বিশ্বের প্রত্যেক তেজস্বী নারীর সংগ্রামের কাহিনী জড়িয়ে আছে। এই সংগ্রাম লিঙ্গ বৈষম্যের, এই সংগ্রাম সমানাধিকারের, এই সংগ্রাম সমাজের বিভীষিকা থেকে নারীর আত্মরক্ষার। বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি সংগ্রামী নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে স্বীকৃত আজকের এই দিনটি। নারীত্বের এই মহান উদযাপন সমগ্র নারী সমাজকে অনুপ্রেরণা যোগায় নারী শক্তিকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

নারী জাতির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

সমাজে নারীর অবদান সূর্যের মতো। নারী শক্তির উৎস। একটি নারীই পারে নতুন প্রাণের জন্ম দিতে। সেই নারীই একটি শিশুর প্রাথমিক চরিত্র গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি আদর্শ চরিত্র গঠন করে একটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা যায় সঠিক মূল্যবোধের, যার পরিচয় পাওয়া যায় মানুষটির সততা ও দায়িত্বশীলতার মধ্যে দিয়ে। আর একজন সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষই পারে সমাজকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

আজকে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে প্রতিভা ও মেধার দিক দিয়ে নারী জাতি পুরুষদের সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে। পরিবার পরিজনদের খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অসাধারণ কর্মদক্ষতার মাধ্যমে নারী তার কৃতিত্বের চিহ্ন রেখেছে।

পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নারী। তাই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব।

এই সমস্ত কারণেই নারী জাতির উন্নয়ন সমগ্র সমাজের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

সমগ্র বিশ্বে নারীর অবস্থান

আজকের এই দিনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা প্রায় সকল নারীর হোয়াটসঅ্যাপে পৌঁছে যায় নারী ও পুরুষ সকলের তরফ থেকে। কিন্তু বহু নারীর কাছে এই শুভেচ্ছা বার্তা অর্থহীন। তাদের না আছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, না আছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার কোন উপায়।

আবার কোথাও যেন সব বাধা অতিক্রম করে আসার পরও সমাজের এক অভিশপ্ত ও অদৃশ্য বল আজও ন্যায্য অধিকার থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, বিনোদন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করা সত্ত্বেও আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কোটি কোটি নারী দারিদ্রসীমার নিচে রয়ে গেছে। আজও ঘরে ঘরে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে অসংখ্য অবলা নারী।

যদিও উন্নত দেশগুলির ছবি খানিকটা অন্যরকম, তাও সংখ্যায় কম হলেও আজও অনেক উন্নত দেশে বহু নারী বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। নারী সমাজের অগ্রগতি পুরুষ সমাজ কর্তৃক অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ এখনও হয়ে উঠতে পারেনি। কোথাও যেন লিঙ্গ বৈষম্যতা আজও নারীর সফলতার অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বঙ্গে নারীর অবস্থান

আজকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলায় নারীদের অবস্থান নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। আমি নিজে এক বঙ্গ তনয়া, তাই বাংলার সমাজব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী। উচ্চপদস্থ কর্মচারী থেকে শুরু করে সফল ব্যবসায়ী, কবি থেকে শুরু করে ক্রীড়াবিদ যেকোনো ক্ষেত্রেই বঙ্গ তনয়ারা নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে। পূর্বের তুলনায় বাংলায় নারীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবার ও সমাজের সহযোগিতায় অনেক এগিয়ে গেছে আজকের বাঙালি নারী।

তবুও সমাজে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠে ঘর সামলে কিভাবে একটি নারী বাড়ির সীমানা পেরিয়ে নিজেকে বাইরের জগতের সামনে তুলে ধরবে। কিন্তু আমাদের সমাজে সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না কোন পুরুষকে। তাই আজও বহু বাঙালি নারীর প্রতিভা রন্ধনশালার চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

আজও বাঙালি ঘরের বহু নারী অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ও পণ প্রথার শিকার হচ্ছেন। গৃহ পরিচারিকাদের উপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। খবরের কাগজের পাতায় অথবা নিউজ চ্যানেলগুলিতে নারী নির্যাতনের খবর এখনও নারী হিসেবে সমাজে নিজের সুরক্ষার নিশ্চয়তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগায়।

তাও আমরা কখনও হারতে শিখিনি, সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে শিখেছি ঘুরে দাঁড়াতে। একজন অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত নারী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, একজন অত্যাচারিত গৃহবধূ স্বামীর ঘর ত্যাগ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যায়, একজন ধর্ষিতা দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যায় ন্যায় পাওয়ার আশায়।

এইভাবেই হয়তো কেটে যাবে আরও কিছু দশক। তবুও এই আশাই রাখি যে একদিন ঠিকই বদলাবে আমাদের সমাজ। পুরুষরা হয়ে উঠবে নারীদের শক্তি এবং প্রত্যেক সফল নারীর পিছনে থাকবে একজন প্রগতিশীল পুরুষ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩-এর থিম

প্রতি বছর জাতিসংঘের নির্ধারিত থিমের ভিত্তিতে ৮ই মার্চ সমগ্র বিশ্ব জুড়ে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই বছরে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘ডিজিটঅল : লিঙ্গ সমতার জন্য উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি'।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: