পূর্ব ভারতে মহালয়ার তাৎপর্য
মহালয়ার এই পুণ্য থিতিতে সকলকে জানাই শারদীয় দুর্গোৎসবের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। শারদীয়ার উপহার হিসেবে এই প্রবন্ধটি আমার সকল পাঠক পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলাম।
‘মহালয়া'র অর্থ
পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনের মহালগ্নটি মহালয়ার বার্তা বহন করে আনে। ‘মহালয়' শব্দটি থেকে ‘মহালয়া' কথাটি এসেছে, যার অর্থ ‘মহান আলয়'। এই মহান আলয় হলেন স্বয়ং দেবী। আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনাকালে যে অমাবস্যা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত, সেই দিনটিই পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন।
হিন্দু শাস্ত্র মতে মহালয়ার তাৎপর্য
মহালয়ার তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে রাম-রাবণের যুদ্ধের প্রাক্কালে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে শ্রীরামচন্দ্র ত্রেতা যুগে লঙ্কেশ্বর রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণেই শরৎকালের এই দুর্গা পূজাকে অকাল বোধন বলা হয়। তবে মহর্ষি বাল্মীকির রচিত পুরাতন রামায়ণে রামচন্দ্রের দ্বারা শরৎকালে দেবীর আরাধনার কোন রকম উল্লেখ নেই। আসলে বসন্তকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়ে থাকে, যাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়।
তর্পণের তাৎপর্য এবং মহালয়ার সাথে সম্পর্ক
‘তর্পণ' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘তৃপ' শব্দ থেকে, যার অর্থ সন্তুষ্ট করা। প্রকৃত মহালয়ার তাৎপর্য বলতে যা বোঝায় তা হল “ব্রহ্ম হইতে তৃণ পর্যন্ত জগৎ তৃপ্ত হোক”। সনাতন ধর্ম অনুসারে যেকোনো শুভ কর্মের পূর্বে প্রত্যেক হিন্দুকে তাদের পূর্বপুরুষ সহ সমগ্র জীব জগতের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কাধিপতি রাবণের সাথে যুদ্ধের পূর্বে মহালয়ার দিনে তর্পণ করেছিলেন। ইহাকে অনুসরণ করেই মহালয়ার এই শুভ তিথিতে সকল পিতৃ-মাতৃহীন হিন্দুরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনার উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে মহালয়ার এই তিথিতে প্রয়াত আত্মাদের মর্তে আগমন ঘটে। পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণের জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ এবং মহালয়া এই পিতৃপক্ষের অন্তিম দিন।
দেবীর চক্ষুদান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবাংলায় দুর্গা পূজার সূচনা হয় এই মহালয়ার দিন থেকেই। মানুষের বিশ্বাস এই দিনেই দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। হিন্দু শাস্ত্র মতে মহালয়ার দিন ভোরবেলায় চণ্ডীপাঠ করার রীতি প্রচলিত আছে। এছাড়াও মহালয়ার তাৎপর্য সম্বন্ধে বলতে গেলে যে রীতিটির কথা না বললেই নয় সেটি হল দেবী দুর্গার চক্ষুদান রীতি। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনাকালে দেবী দুর্গার চক্ষুদান সম্পন্ন করা হয় এবং এরই সাথে সম্পন্ন হয় ঘট পূজা। আগেকার দিনে কেবলমাত্র রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িতেই দুর্গা পূজা প্রচলিত ছিল। রথের দিনে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পূজা হত এবং মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা প্রবেশের পর দেবী দুর্গার চক্ষুদান পর্ব শুরু হত। সময়ের সাথে সাথে সেই নিয়মেরও বদল ঘটে। যেহেতু মহালয়ার দিন দেবীপক্ষের সূচনাকাল সেহেতু এই দিন থেকেই দেবী প্রতিমার চোখ আঁকার চল শুরু হয়। চক্ষুদানের পর মহাসপ্তমীতে দেবী মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মহিষাসুরমর্দিনী
হিন্দু শাস্ত্র মতে মহালয়ার তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনার এখানেই ইতি টানলাম। পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে মহালয়ার অর্থ হল একটি চিরাচরিত অনুষ্ঠান, সেই অসাধারণ অনুষ্ঠানটি হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী।
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।”

রেডিওর উপরে জমে থাকা সারা বছরের পুরু ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে মহালয়ার ভোরবেলায় এই পরিচিত সুর শোনার জন্য প্রত্যেক বাঙালি প্রতি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এই সুর মিশে গেছে সারা বিশ্বের আপামর বাঙালির রক্তে রক্তে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দূরদর্শন রেডিওর গরিমাকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই শব্দের সাথে কোন অনুষ্ঠান যদি স্বচক্ষে উপভোগ করা যায় তা দর্শক মনকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করবে। কিন্তু মহালয়ার ভোরে বেতারে সম্প্রচারিত মহিষাসুরমর্দিনী এখনও একমাত্র ব্যতিক্রম।
মহিষাসুরমর্দিনীর সাথে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম ছাড়াও আরও দুইজন স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তাঁরা হলেন বাণীকুমার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। বাণীকুমারের রচিত এবং পরিচালিত, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে অলঙ্কৃত ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে সজ্জিত এই অনুষ্ঠানটি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস
চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ঐতিহাসিক সৃষ্টির কিছু অজানা কাহিনী। পণ্ডিত অশোক নাথ শাস্ত্রীর সহায়তায় বাণীকুমার মহিষাসুরমর্দিনী রচনা করেছিলেন। পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল এই অনুষ্ঠানটির কয়েকটি গানের সুরকার ছিলেন, তবে বেশিরভাগ গানেরই সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। একথা শোনা যায় যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহালয়ার আগের দিন রাত্রেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন এবং সেখানেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরে অনুষ্ঠানে বসতেন।
ভোর চারটে বাজতে না বাজতেই তরঙ্গের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে যেত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমর কণ্ঠস্বর। তিনবার শঙ্খধ্বনি দিয়ে আরম্ভ হত এই অনুষ্ঠান। বাণীকুমার নিজের বাড়ি থেকে শঙ্খ নিয়ে যেতেন বেতারকেন্দ্রে এবং সম্প্রচারের প্রারম্ভে মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় সেই শঙ্খ বাজাতেন।
প্রথম দিকে আকাশবাণীতে সমস্ত অনুষ্ঠানই সরাসরি সম্প্রচারিত হত। ১৯৩২ সালে বাণীকুমারের প্রযোজনায় প্রথমবার সম্প্রচারিত হল শারদ-আগমনী গীতি আলেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী। তখন হিন্দু ধর্মের কিছু রক্ষণশীল মানুষ এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার তীব্র বিরোধিতা করেন তাঁরা। কিন্তু বাণীকুমার এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং প্রতিবারই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে দিয়েই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটির স্তোত্রপাঠ করানো হয়।
আরও একটি বাধার সম্মুখীন হতে হয় বাণীকুমারকে, মহালয়ার ভোরে পিতৃতর্পণের পূর্বে কেন চণ্ডীপাঠ হবে? এই কারণেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটিকে ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচার করা হয়। কিন্তু অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে ১৯৩৭ সালে পুনরায় মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী। যদিও ১৯৩২ সালে প্রথমবার ষষ্ঠীর ভোরেই এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়েছিল যা পরবর্তীকালে মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হতে শুরু করে।
১৯৭৬-এর ঘটনা
এত জনপ্রিয়তা লাভ সত্ত্বেও এক বছর মহালয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার বন্ধ ছিল। ১৯৭৬ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে দেবী দুর্গতিহারিণীম নামক বিকল্প একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। মহানায়ক উত্তমকুমার যার ভাষ্যপাঠ করেছিলেন, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন লতা মঙ্গেশকরের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। তা সত্ত্বেও এই বিকল্প অনুষ্ঠানটি হার মানাতে পারেনি মহিষাসুরমর্দিনীর জনপ্রিয়তাকে। জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। বিক্ষুব্ধ জনগণ বেতার অফিসে ভাঙচুর করেছিলেন।
যদিও বাণীকুমারকে এই দুঃখের দিনটি দেখে যেতে হয়নি। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৫ই আগস্ট ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। তবে মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার বন্ধ থাকার ঘটনায় শোকাহত হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পরবর্তীকালে টেপরেকর্ডারে অনুষ্ঠানটি চালানো হলেও বরাবরই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সেই প্রথম দিনের মতোই রাত্রে বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের এই ঘটনার পর থেকে তিনি আর কোন দিনও রাত্রিবেলা বেতারকেন্দ্রে যাননি। জনগণের বিক্ষোভের জেরে যদিও সেই বছরই ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী। ১৯৭৭ সালে স্বমহিমায় পুনরায় মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয় এই অনুষ্ঠানটি।
আজও মহালয়ার তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকের নাম বার বার উঠে এসেছে। তৎকালীন বেতারকেন্দ্রের ডিরেক্টর দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত বলেছিলেন- “বাণীকুমার যদি আর কোন কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু মহিষাসুরমর্দিনী-র জন্যই মানুষ তাঁকে মনে রাখত। … শাহজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.