সেরা বাংলা রান্নার বই

আগেকার দিনে বংশপরম্পরায় বাড়ির মেয়ে বউদের সমস্ত ধরণের রান্নার হাতেখড়ি হত তাদের মা, ঠাকুমার কাছ থেকে, আবার সেই সমস্ত রান্নার কৌশল তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হাতে ধরে শেখাতেন। এই ভাবেই যুগ যুগান্তর ধরে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের হাত ধরে বাঙালির হেঁশেলে তৈরি সুস্বাদু ঐতিহ্যবাহী রান্নাগুলি সকলের রসনা তৃপ্তির খেয়াল রাখত।

কিন্তু বর্তমান কর্মব্যস্ত যুগে বাড়ির গৃহিণীদের কাছে যে জিনিসটার খুবই অভাব সেটি হল মহা মূল্যবান সময়, আর বাড়ির মেয়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিযোগিতার দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই সময়ের অভাবে অনেকেরই শিখে ওঠা হয়নি পঞ্চব্যঞ্জন রন্ধনের কলাকৌশল। এই ভাবেই হারিয়ে গেছে বহু ঐতিহ্যবাহী সাবেকি রান্না।

তবে এখনও অনেক বাঙালি সাবেকি রান্নার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ও সেই রান্নায় মা ঠাকুমাদের হাতের স্বাদ আনার গোপন রহস্যের চাবিকাঠি রয়ে গেছে কিছু মহা মূল্যবান রান্নার বইতে। 

আজ আমার লেখনীতে বর্তমান কর্মব্যস্ত অথচ ভোজনরসিক বাঙালিদের জন্য রইল ছয়টি  বিখ্যাত রান্নার বই সম্বন্ধে কিছু বিশেষ তথ্য। 

আমিষ ও নিরামিষ আহার

রন্ধন প্রণালীকে মূল বিষয়বস্তু করে বই প্রকাশ করার রীতি যখন এই বাংলার বুকে প্রচলিত হয়নি,  সেই সময় প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী বাঙালি আমিষ ও নিরামিষ রান্নার রন্ধন প্রণালী বিষয়ক এই গ্রন্থটির রচনা করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞানী হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পূর্ণিমা দেবীর কন্যা ছিলেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর সম্পর্কে কাকা। 

তিনি এই কিংবদন্তীপ্রতিম মহাগ্রন্থ অনেকগুলি খণ্ডে রচনা করেছিলেন। তবে সেই খণ্ডগুলিতে যে সমস্ত রান্নাগুলি মুদ্রিত করা হয়েছিল, সেইগুলি ছাড়াও তাঁর রচিত আরও কিছু রান্নার বই এবং বেশ কিছু রন্ধন প্রণালীর পাণ্ডুলিপি তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপরিকল্পিতভাবে একত্রে সেই রচনা সমূহ দুটি খণ্ডে বিভক্ত করে প্রকাশ করা হয়।

আমিষ ও নিরামিষ আহার বইটির প্রথম খণ্ডে বর্ণিত রয়েছে বাঙালি ঘরের ঐতিহ্যমণ্ডিত নিরামিষ রান্নার কলাকৌশল এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ আমিষ আহারের রন্ধন প্রণালী।

তাঁর এই রান্নার বই দুটি বাঙালি আমিষ ও নিরামিষ আহারের দুটি কোষগ্রন্থ।

ঠাকুর বাড়ির রান্না

পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা এই বিখ্যাত রান্নার বই বাঙালিদের কাছে একটি অমূল্য রতন। পূর্ণিমা ঠাকুরের মাতা নলিনী দেবী ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ছিলেন একজন খাদ্যরসিক বাঙালি। নিজে রন্ধনপটীয়সী না হলেও রান্নার সম্বন্ধে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল এবং জ্ঞানও ছিল প্রচুর। তিনি যখনই  দেশ বিদেশের কোন সুস্বাদু রান্না আস্বাদন করেছেন, তখনি সেই পদগুলির রন্ধন প্রণালী জেনে নিয়ে নিজের খাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সেই অমূল্য সংগ্রহ উপহার হিসেবে তিনি পূর্ণিমা ঠাকুরের হাতে তুলে দেন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর লেখা সেই সমস্ত রন্ধন প্রণালী রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পূর্ণিমা ঠাকুর এই ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না' নামক বইটি রচনা করেছিলেন।

এছাড়া পূর্ণিমা ঠাকুরের মাতা নলিনী দেবী ছিলেন রন্ধনপটীয়সী। তাঁর মায়ের কাছ থেকে তিনি অনেক রান্না শিখেছিলেন এবং নিজেও বহু বৈচিত্র্যময় রান্নার প্রণালী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সেই সমস্ত রন্ধন প্রণালী তিনি ১৯৮৬ সালে এই বিখ্যাত রান্নার বইটি প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

রান্নার বই

বিখ্যাত সাহিত্যিক লীলা মজুমদার ও তাঁর কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায় এই অসাধারণ রন্ধন প্রণালী বিষয়ক বইটির রচয়িতা। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াও অন্যান্য বহু লোকের কাছ থেকে বিভিন্ন রান্নার কলাকৌশল জেনে সেইগুলিও লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। লীলা দেবী এবং তাঁর কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায় ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর লেখা কিছু কিছু রন্ধন প্রণালীর সরলীকরণ করেছিলেন। এই বইটিতে লীলা মজুমদার যে সমস্ত রান্নার বর্ণনা করেছিলেন তার মধ্যে অনেকগুলি প্রণালীতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, চীনা, এবং মুসলিমদের রন্ধন কৌশলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন রন্ধন প্রণালীর বিশদ বিবরণ রয়েছে এই বইটির মধ্যে। সবশেষে ‘রান্নার বই'-এ তিনি যে কথাগুলি উল্লেখ করেছিলেন তা হল- “আমাদের দেশের মা-মেয়েদের হাতে এই বই দিলাম এই আশাতে যে তাঁরা নিজের বাড়িতে বসে পৃথিবীর একটি সেরা শিল্প-কর্মের সাধনা করবেন এবং শুধু পাঠিকা নয়, পাঠকদের জন্যেও নিবেদন করলাম।”

রকমারি নিরামিষ রান্না

প্রায় সাতশত নিরামিষ রান্না এবং মিষ্টি ও জলখাবারের সমাহার নিয়ে ভোজনরসিক পাঠকদের উপহার হিসেবে এই রান্নার বই রচনা করেছিলেন রেণুকা দেবী চৌধুরানী। পূর্ব বাংলার জমিদার পরিবারের এই রন্ধনপটীয়সী গৃহবধূ নিজ হাতে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী এই সমস্ত উত্তম পদগুলি রেঁধে বহু মানুষকে খাইয়েছেন। নিরামিষ রান্না মানেই বেশিরভাগ মানুষের ধারণা রুগীর পথ্য অথবা কোন ব্রত উদযাপনের অঙ্গ। কিন্তু সেই পরিভাষা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন রেণুকা দেবী চৌধুরানী। পেঁয়াজ, আদা, রসুন কষিয়ে মাছ, মাংস ডিমের মতো রসনালোলুপ আমিষ পদগুলি বাঙালিদের অত্যন্ত প্রিয়, কিন্তু সেই পদগুলিকেও স্বাদের দিক দিয়ে হার মানাতে পারে বহু নিরামিষ রান্না, তারই প্রমাণ হিসেবে বহু বৈচিত্র্যময় ও অভিনব নিরামিষ আহারের রন্ধন প্রণালী রয়েছে এই বইটিতে। ‘রকমারি নিরামিষ রান্না' ছাড়াও রেণুকা দেবী চৌধুরানীর রন্ধন প্রণালী বিষয়ক আরও একটি সমাদৃত গ্রন্থ হল ‘রকমারি আমিষ রান্না'।

রান্না খাদ্য পুষ্টি

পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ ও রন্ধন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীর বিখ্যাত রান্নার বই ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি'-এর রচয়িতা। তাঁর লেখা এই বইটিতে মুদ্রিত রন্ধন প্রণালীগুলির মধ্যে ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার অপরূপ মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। খাদ্য ও পুষ্টি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাঁর দীর্ঘকালের অধ্যাপনার ফল স্বরূপ অর্জিত অভিজ্ঞতার মুদ্রিত রূপ হিসেবে প্রকাশিত রান্নার এই বইটির খ্যাতি শুধু মাত্র তাঁর নিজের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এই বইটি বহির্বিশ্বেও যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীরের লেখা এই অসাধারণ রান্নার বইটি ২০২১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘গুরমান্ড ওয়ার্ল্ড কুকবুক অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেছে।

বিনা তেলে রান্না

সাধনা মুখোপাধ্যায় ও শোভনা মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বিনা তেলে রান্না' নামক এই বইটিতে বিভিন্ন ধরণের পানীয়, স্যুপ, স্যালাড, আচার, চাটনি, মিষ্টি থেকে শুরু করে ভাত, ডাল, তরকারি, পোলাও, এমনকি বাঙালির প্রিয় মাছ, মাংস, ডিমের তেল, ঘি বা মাখন ছাড়া অবিশ্বাস্য সব রন্ধন প্রণালীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। স্বাস্থ্য-সচেতন ভোজনরসিক বাঙালিদের কাছে এই বইটি একটি দুর্মূল্য উপহার। বর্তমানে সরষের তেল অথবা ভোজ্য যেকোনো তেল থেকে শুরু করে ঘি বা মাখন সব কিছুতেই রয়েছে ভেজাল, তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত তেল, ঘি বা মাখন কোনটাই শরীরের পক্ষে ভালো নয়। কিন্তু তেল ছাড়াও যে সুস্বাদু রান্না করা সম্ভব তা এই বইটি না পড়লে বিশ্বাস করা মুশকিল। যাদের হৃদরোগ বা স্থূলতার কারণে শারীরিক সমস্যা রয়েছে, বিশেষত তাদের জন্য এই রন্ধন প্রণালী অনুসরণ করে রান্না করলে খাবারের তালিকা থেকে ওষুধের সংখ্যা অনেক হ্রাস পাবে।

আপনাদের মনে হতে পারে ২ মিনিটের ম্যাগির যুগে কেই বা এতকিছু রেঁধে খাবে। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এইটুকু বলতে পারি এই সমস্ত দুর্মূল্য রান্নার বইগুলি আপনার রসনা তৃপ্তির চিরজীবন খেয়াল রেখে যাবে। ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক রান্নাই আমি করেছি, তবে বহুবার ব্যর্থতার সম্মুখীনও হতে হয়েছে ইউটিউবারদের অপটু রন্ধন কৌশল অনুসরণ করে। অভিজ্ঞ লেখক লেখিকাদের উৎকৃষ্ট মানের এই রান্নার বইগুলির প্রত্যেকটি রন্ধন প্রণালী আপনাকে প্রতিবার সুস্বাদু রান্না আস্বাদনের সুযোগ করে দেবে। তাই আধুনিক প্যাকেটে পোৱা অস্বাস্থ্যকর খাবারকে বিদায় জানিয়ে আপনার হেঁসেলের সঙ্গী করে নিন এই সমস্ত বিখ্যাত রান্নার বইগুলিকে। 

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “সেরা বাংলা রান্নার বই

  • February 19, 2023 at 3:55 pm
    Permalink

    After examine a few of the weblog posts on your web site now, and I truly like your approach of blogging. I bookmarked it to my bookmark web site checklist and might be checking back soon. Pls try my website as effectively and let me know what you think.

    Reply

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: