পশ্চিমবাংলার কয়েকটি বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত

বাংলার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণকারী লোকসংস্কৃতির সবচাইতে সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় শাখা লোকগীতি বা লোকসঙ্গীত। বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে ফুটে ওঠে সরল পল্লীজীবনের চিত্রকল্প। ভাব ও রসে সমৃদ্ধ এই গাথা আমাদের সামনে যেমন তুলে ধরে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও প্রয়োজনের কাহিনী, তেমনি আমরা এই গানের মাধ্যমে জানতে পারি প্রাচীনকালের নানান ইতিহাস থেকে শুরু করে বহু তথ্য ও তত্ত্ব। এ যেন কেবল গান নয়, এ গাথা যেন জীবন্ত চিত্র। চলুন তাহলে আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক অফুরন্ত প্রাণরস ও খেয়ালি আবেগে ভরপুর পশ্চিমবাংলার কয়েকটি বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত সম্পর্কে।  

কীর্তন

পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে লোকসঙ্গীতটির কথা উঠে আসে সেটি হল কীর্তন। আজও বাঙালির জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই প্রাচীন লোকগীতিটি। বাংলার লোকগীতির এই ধারার সূচনার সময়কাল সঠিক ভাবে জানা না গেলেও দ্বাদশ শতকে রচিত কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্-এর গীতিরীতিকেই কীর্তনের সোপান হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে শ্রীচৈতন্যদেবের আমলেই কীর্তন ব্যাপকতা লাভ করে, আর সেই কারণেই শ্রীচৈতন্যদেবকে কীর্তনের প্রবর্তক বলা হয়।

বাংলার লোকগীতির এই ধারায় রাধা-কৃষ্ণের নাম এবং তাঁদের লীলাকে সুর, তাল, লয়ে বেঁধে খোল, মন্দিরা ও করতাল সহযোগে এক অপূর্ব রসে নিবেদন করা হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে বাংলার এই লোকগীতি।

যাত্রাগান

গ্রাম বাংলায় বহু প্রাচীন কাল থেকেই দোলযাত্রা, রথযাত্রা, মনসামঙ্গলে ভাসান যাত্রা, মাঘী সপ্তমীর স্নানযাত্রার মতো শোভাযাত্রায় নৃত্য-গীত সহযোগে দেবমাহাত্ম্য কীর্তিত হত। ডঃ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই কৃষ্ণযাত্রার প্রচলন ছিল। যাত্রাগানের মূল বিষয় কৃষ্ণলীলাকে আশ্রয় করে পাঁচালী ও কীর্তন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে যাত্রাগান ধর্মীয় পটভূমিকায় পালাগান হিসেবে সৃষ্টি হলেও পরবর্তীকালে এই লোকগীতির বিশেষ পটপরিবর্তন ঘটেছে। ঐতিহাসিক পটভূমিকা থেকে শুরু করে নানান সামাজিক উপাখ্যান ও দৈনন্দিন জীবনের বহু দুরূহ সামাজিক বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই পালাগান পরিবেশিত হয়।

বাংলার যাত্রাগানকে সমৃদ্ধ করে তুলতে যাঁদের অবদান অপরিসীম তাঁরা হলেন মতিলাল রায়, দাশরথি রায়, গোবিন্দ অধিকারী, গোপাল উড়ে, মুকুন্দ দাশ, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, বিধায়ক ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত প্রমুখ।

লেটো

পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলের পল্লী সংস্কৃতির একটি অঙ্গ এই লেটো গান। যাত্রাগানের সাথে এর যথেষ্ট সমঞ্জস্য আছে। পালার আকারে রচিত এই লোকগীতি নৃত্য ও অভিনয় সহযোগে পরিবেশন করা হয় এবং সঙ্গে থাকে বাদকদল। দুই দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তর, রসিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিযোগিতা হয় এই লেটো গানের আসরে। মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ে এই গানের সমাদর বেশি, তবে গ্রাম বাংলার সব ধরণের শ্রোতারাই এই গান উপভোগ করেন। লেটো গানের প্রসঙ্গে উঠে আসে কাজী নজরুল ইসলামের কথা। শৈশবে লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি রাঢ় অঞ্চলের ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলে অর্থাৎ লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। “চাষার সঙ”, “শকুনি বধ”, “দাতা কর্ণ”, “কবি কালিদাস”, “আকবর বাদশাহ”, “রাজপুত্রের গান”, “মেঘনাদ বধ” ইত্যাদি তাঁর রচিত কিছু জনপ্রিয় লেটো গান।

বাউল

বাংলার একটি প্রাচীন বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত হল বাউল সঙ্গীত। আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে এই লোকসঙ্গীতের জন্ম হয়। বাউল আসলে একটি সম্প্রদায়, যাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাচরণে বিশ্বাসী নন। এঁদের ধর্ম একটাই, আর সেটা হল মানব ধর্ম। সহজ সরল ভাষায় ডান হাতে একতারা আর বাম হাতে ডুগি সহযোগে নৃত্যের মাধ্যমে বাউল সাধকেরা গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়ান।

ফকির লালন শাহ এই লোকসঙ্গীতের স্রষ্টা। এছাড়াও যাঁরা নিজেদের সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলার লোকসঙ্গীতের এই শক্তিশালী ধারাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে যাদুবিল, গোঁসাই গোপাল, পাগলা কানাই, রামচাঁদ, নবীন দাস, এবং বর্তমানে পূর্ণদাস বাউলের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

কবিগান

কলকাতা শহরে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে কবিগান। এই লোকগীতির সেইভাবে কোনো লিখিত রূপ নেই, কারণ সভার মধ্যে দাঁড়িয়ে উপস্থিত বুদ্ধি ও তাৎক্ষণিক রচনা কৌশলের মাধ্যমে কবিয়ালরা এক একটা গান তৈরি করে ফেলতেন। কবিগানের আসরে ঢোল ও কাঁসি সহযোগে চাপান উতোরের মাধ্যমে চলত গানের লড়াই। এই প্রতিযোগিতামূলক গানের আসর যদিও শুরু হত ধর্ম সম্বন্ধীয় কোনো তত্ত্ব নিয়ে কিন্তু শেষ পর্যায়ে গিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেত। পুরস্কার হিসেবে বিজয়ীরা পেতেন প্রচুর অর্থ ও অন্যান্য সম্মান। এই কবিগানের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী। তিনি তাঁর অনন্ত কাব্য সাধনার মধ্যে দিয়ে কবিগানকে অশ্লীলতা থেকে মুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও বাংলার কবিগানের ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন ভোলা ময়রা, গোঁজলা গুই, ভবানী বেনে-এর মতো বহু মহান কবিয়াল।

টপ্পা

পশ্চিমবাংলার এই লোকগীতির আদিভূমি পাঞ্জাব। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে পাঞ্জাবে এই গানের প্রচলন শুরু হয়। তবে পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সাথে বাংলার টপ্পা গানের কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবেই পরিচিত। প্রধানত বিরহকে বিষয়বস্তু করে এই গান রচিত হত। বাংলা টপ্পা গানের আদিপুরুষ ছিলেন কালী মীর্জা। তবে বাংলায় রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর হাত ধরেই এই লোকগীতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ভাদু

বাংলার এই বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত ঘিরে রয়েছে এক সুপ্রাচীন কাহিনী। এই কাহিনী মানভূম অঞ্চলের পঞ্চকোটের মহারাজা নীলমণি সিংহ দেও-র রূপবতী কন্যা ভদ্রাবতীর। বিবাহের পূর্বেই পাণিপ্রার্থীর অকাল মৃত্যুতে রাজকুমারী বাগদত্তের জ্বলন্ত চিতায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন। ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংহ দেও ভাদু পূজার প্রচলন করেন। যদিও ভাদু পূজা ও গানের উৎস নিয়ে নানা মত রয়েছে।

প্রধানত অবিবাহিত মহিলারা সমগ্র ভাদ্র মাসব্যাপী ভাদু দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে গানের মাধ্যমে তাঁর আরাধনা করে থাকে। এই লোকগীতিতে রামায়ণ ও রাধাকৃষ্ণের কাহিনী সহ সমসাময়িক কালের নানান বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে গান গাওয়া হয়। পশ্চিমবাংলার বাঁকুড়া, বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় ভাদু পূজা ও তার গানের প্রচলন লক্ষণীয়।

টুসু

রাঢ় অঞ্চলের এক কৃষিভিত্তিক লৌকিক উৎসব হল টুসু। গ্রাম বাংলার মানুষেরা টুসু দেবীকে শস্যের দেবী হিসেবে এবং দেবী লক্ষ্মীর প্রতিভূ হিসেবে গণ্য করেন। বাংলার বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় নবান্ন উৎসব উপলক্ষ্যে নানান উপাচারের মাধ্যমে নিষ্ঠা সহযোগে টুসু দেবীর পূজা ও টুসু গান হয়ে থাকে। মূলত অবিবাহিত মহিলারাই এই পূজায় অংশগ্রহণ করে।

ঝুমুর

বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী এলাকায় একপ্রকার নৃত্যবহুল আদিরসাত্মক লোকসঙ্গীত ঝুমুরের প্রচলন আছে। মহুয়া-শাল-পিয়ালের বনে ধামসা-মাদলের তালে তাল মিলিয়ে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা প্রভৃতি অনুন্নত সম্প্রদায়ের আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা দলবদ্ধভাবে নৃত্য সহযোগে এই লোকগীতি পরিবেশন করেন। মূলত দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় হল এই গানের উপজীব্য।

আলকাপ

আলকাপ লোকগীতিটি মূলত পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুল প্রচলিত। তবে মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম এবং মালদহ জেলাতেও এই গানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। মূলত তপশীলি উপজাতির লোকেরা এই লোকগীতির সাথে সাথে নৃত্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জন করেন।

পটুয়া

পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুর ও বীরভূম জেলার এক বিশিষ্ট লোকচিত্র হল পটচিত্র। মূলত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এই চিত্রগুলি কাপড়ের উপর আঁকা হয়ে থাকে। পটুয়া চিত্রকর গোষ্ঠীর লোকেরা এই ধরণের চিত্র অঙ্কনের কাজ করে থাকেন। এই চিত্রে অঙ্কিত পৌরাণিক কাহিনীগুলি তাঁরা নিজস্ব সুর ও ছন্দে বেঁধে গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন, যা “পটুয়া” গান নামে পরিচিত।

ভাওয়াইয়া

বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত হিসেবে ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার প্রভৃতি অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। বাংলার লোকগীতির এই উজ্জ্বল ধারাটির রচয়িতা মূলত রাজবংশী সম্প্রদায় হলেও হিন্দু-মুসলমান সহ এলাকার সকল মানুষই এই গানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। দোতারা সহযোগে এই গানের মাধ্যমে মূলত প্রণয়-প্রণয়ীর বিরহ ব্যথা মিশ্রিত করুন সুরটিই বিশেষ করে ফুটে ওঠে।

গম্ভীরা

উত্তরবঙ্গের মালদা জেলার একটি বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত হল “গম্ভীরা”। এই লোকসঙ্গীতের সাথে সাথে মুখোশ পরে লোকশিল্পীরা এক বিশেষ প্রকার নৃত্য পরিবেশন করেন। মূলত পৌষ সংক্রান্তি, গাজন প্রভৃতি ধর্মীয় উৎসবে শোভাযাত্রা ও নৃত্যের মাধ্যমে মালদহে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয় গম্ভীরা উৎসব। এই উৎসবে মূলত দেবাদিদেব মহাদেবকে বন্দনা করে গান গাওয়া হয়। তবে মহাদেবের স্তুতিতেই সীমাবদ্ধ নয় এই গানের বিষয়বস্তু, জাতির দুঃখ-লাঞ্ছনা, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়েও গাওয়া হয় এই গান।

ধর্মীয় ভাবের সাথে সাথে এই লোকগীতি মানুষকে সমাজ সংস্কারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। যদিও বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক অগ্রগতি মানুষের রুচিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের ফলে এই শ্রেণীর গান ও গায়ক উভয়ই ক্ষীয়মাণ। ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে প্রাচীন প্রথা ও বিশ্বাসের জোর। লোকগাথার ভাব পূর্বে যত সমৃদ্ধ ছিল, তা আর এখন নেই। তবে আজও চাষিরা মাঠে লাঙ্গল চালাতে চালাতে কিংবা মাঝিরা নৌকা বাইতে বাইতে ঢেউয়ের তালে তালে গুনগুন করে ওঠে এই সমস্ত গানের দু'এক কলি। আজও বহু গ্রাম্য কবি লোকগীতিকে আশ্রয় করে আমাদের সামনে তুলে ধরে কালের নানান ঘটনাবলী।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: