১৫টি ঐতিহ্য বহনকারী বিখ্যাত বাংলার লোকনৃত্য
নৃত্য একটি প্রাচীন শিল্পকলা। বহু প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রে ও মিশরীয় দেওয়াল চিত্রে নৃত্যকলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সহজ ভাষায় নৃত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা হল শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কোন বিষয় বা ভাবকে পরিবেশন করা।
লোকনৃত্য নৃত্যকলার অন্তর্ভুক্ত হলেও এর কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে যা এই নৃত্যকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের থেকে আলাদা করে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতো মুদ্রার ব্যবহার লোকনৃত্যে লক্ষ্য করা যায় না। জীবনচক্রের গতিময় দলবদ্ধ আচরণের দ্বারা এই নৃত্য অনুপ্রেরিত হওয়ায় সাধারণত দলবদ্ধভাবেই লোকনৃত্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বাংলার লোকনৃত্য সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হল।
ছৌ নাচ
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার ছৌ নাচের খ্যাতি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত যে বিশালাকার মুখোশ ও রং-বেরঙের পোশাক পরে নৃত্যশিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন, তা এই নৃত্যকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। অনেকটা মার্শাল আর্টের সাথে এই নৃত্যের ভঙ্গিমাগুলির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ছৌ নাচের কিছু বিশেষ বিশেষ ভঙ্গি রয়েছে, সেইগুলি হল দানব চাল (রাক্ষসের মতো নৃত্য), দেব চাল (দেবতাদের মতো নৃত্য), পশু চাল (পশুদের মতো নৃত্য) ইত্যাদি। ছৌ নাচে হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।

সন্ধ্যাবেলায় এই নৃত্যের আসর বসে, যেখানে স্থানীয় লোক ছাড়াও বহু দেশ বিদেশের লোকেরাও ভিড় জমায়। বাংলার এই লোকনৃত্যের স্রষ্টা পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামের বাসিন্দা পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া।
গম্ভীরা নাচ
মালদা জেলার গম্ভীরা নাচ একটি পুরাণভিত্তিক লোকনৃত্য। গ্রামবাংলার মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকার্য এবং এই কৃষিকার্য যাতে ভালো ভাবে সম্পন্ন হয় তারই উদ্দেশ্যে এই নৃত্য পরিবেশন করা হত। পরবর্তীকালে এই নৃত্যটি ধর্মীয় নৃত্যে পরিণত হয়, যেখানে সকলের মঙ্গল কামনা করে দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। হারমোনিয়াম, বাঁশি ও আরও নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্রের সুরে সুর মিলিয়ে নৃত্যশিল্পীরা এই নৃত্যানুষ্ঠানটি শুরু করেন। এই নৃত্যে প্রধান দুই জন নৃত্যশিল্পী থাকেন, যাদের সাথে বাকি নৃত্যশিল্পীরা তালে তাল মিলিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। ছৌ নাচের মতোই গম্ভীরা নাচেও বিভিন্ন হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের মুখোশের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
সাঁওতাল নাচ
সাঁওতাল নাচ একটি বাংলার লোকনৃত্য যা ভারতবর্ষের অন্যতম আদিবাসী নৃত্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। বহু প্রাচীন কাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও তার প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে সাঁওতালদের বসতি গড়ে উঠেছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই প্রাণবন্ত নৃত্যটি তাদের নিজস্ব সঙ্গীতের সাথে পরিবেশন করেন। মাদলের মন মাতানো সুরের সাথে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় এই সাঁওতাল নাচ এক আলাদাই মাত্রা পায়।
ব্রিটা নাচ বা বৃত্ত নাচ
ব্রিটা নাচ বা বৃত্ত নাচ একটি ঐতিহ্যবাহী বাংলার লোকনৃত্য। গ্রাম বাংলার সন্তানহীন মহিলারা ভগবানের কৃপায় সন্তান লাভ করার পর ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্যে দলবদ্ধভাবে মন্দির চত্বরের সামনে এই লোকনৃত্যটি পরিবেশন করেন। এছাড়া চিকেন পক্সের মতো সংক্রামক রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও ভগবানের উদ্দেশ্যে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। শুধুমাত্র মহিলারাই এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
ঝুমুর নাচ
বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আদিবাসীদের মধ্যে এই নৃত্যটির প্রচলন আছে। গ্রামের পুরুষেরা বাঁশি, মাদল ও আরও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গায়, আর অল্প বয়সী মেয়েরা পায়ে ঝুমুর পরে, একে অপরের কোমর ধরে সেই গানের তালে তাল মিলিয়ে দলবদ্ধভাবে এই নৃত্য পরিবেশন করে। সাধারণত দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ঝুমুর গানের প্রধান বিষয়বস্তু। কোন শুভ কাজ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা কৃষিকাজের জন্য বর্ষাকে আহ্বান জানবার উদ্দেশ্যে এই নৃত্যানুষ্ঠানটি করা হয়। আসামের আদিবাসী এলাকায়ও এই নৃত্যটি দেখতে পাওয়া যায়।
টুসু নাচ
মকর সংক্রান্তির সময় পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর জেলায় টুসু পরব পালিত হয়। এটি একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব। ফসলের ভালো ফলন হওয়ার জন্য এখানকার আদিবাসীরা তাদের দেবী টুসুর মূর্তি তৈরি করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার উদ্দেশ্যে ধূমধাম করে পূজা করেন। এই পরবে এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে দলবদ্ধভাবে টুসু নৃত্য পরিবেশন করেন।
গোমিরা নাচ
গোমিরা পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার একটি প্রাচীন লোকনৃত্য, যা মূলত বাংলার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ -আষাঢ় মাসে বিভিন্ন উৎসবের সময় পরিবেশিত হয়। এই লোকনৃত্যটিতে বিখ্যাত কুশমন্ডির কাঠের মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে “মুখা খেল” বলা হয়। এখানকার রাজবংশীয় জনগোষ্ঠী এই নৃত্যের মাধ্যমে দেবী চামুণ্ডার আরাধনা করেন। শুভ শক্তির আহ্বান ও অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য এই আরাধনা করা হয়।
বাউল নাচ
গেরুয়া বস্ত্র ও মাথায় পাগড়ী পরিহিত, ডান হাতে একতারা নিয়ে আর কোমরে বাঁয়া ও পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাউলরা এই নৃত্যটি করে থাকেন। এই নৃত্যে কোন মুদ্রা বা অঙ্গভঙ্গি নেই। বাউলরা তাদের গানের সুরের সাথে তালে তাল মিলিয়ে ডান হাতের একতারাটি কখনো উপরের দিকে তুলে বা কখনো কানের পাশে রেখে ও বাঁ হাতটি কোমরে রেখে মূলত পদ সঞ্চালনের মাধ্যমে এই নৃত্যটি পরিবেশন করেন। এই লোকনৃত্যটিতে সাধারণত একজন বাউল শিল্পীই গান ও নাচ করেন, তবে বাউলদের আখড়াগুলিতে দলবদ্ধভাবেও এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মূলত বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় এই নাচের প্রচলন রয়েছে।

কীর্তন নাচ
প্রায় ৫০০ বছর প্রাচীন এই নৃত্যটি ভগবান বিষ্ণুকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নারদ মুনি পরিবেশন করতেন। শ্রী চৈতন্যদেব এই নৃত্যকে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাংলার লোকনৃত্য হিসেবে কীর্তন সারা বিশ্বে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী দেশ বিদেশের বহু মানুষ কৃষ্ণের ভক্তিগীতির সাথে ঢোল ও মৃদঙ্গের তালে এই নৃত্য পরিবেশন করেন। পশ্চিমবঙ্গের মূলত নদীয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় এই নৃত্যের প্রচলন আছে।
পুতুল নাচ
গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির সাথে পুতুল নাচের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা এই লোকনৃত্যটির জন্য বিখ্যাত। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী পুতুল নাচের প্রধান বিষয়বস্তু, তবে বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে এর বিষয়বস্তুরও যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। কাঠের তৈরি রং-বেরঙের পোশাক পরিহিত পুতুলগুলির কোন পা থাকে না। এই পুতুলগুলি এক বিশেষ পদ্ধতিতে সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে। পর্দার আড়াল থেকে শিল্পীরা সেই সুতোতে টান দিয়ে পুতুলগুলিকে এমন ভাবে নাড়ান যেন মনে হয় পুতুলগুলি নাচছে, তার সাথে সাথে সংলাপ ও গানে পুতুল নাটিকা বেশ জমে ওঠে। শিশুদের মধ্যে এই লোকনৃত্যটি খুবই জনপ্রিয়।
কুশান নাচ
“কু” শব্দের অর্থ খারাপ ও “শান” শব্দের অর্থ বিতাড়িত করা অর্থাৎ “কুশান” শব্দের অর্থ অশুভ শক্তির বিনাশ। বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্যের কাহিনী অবলম্বনে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। মূলত পুরুষ নৃত্যশিল্পীরাই এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং তারাই মহিলাদের মতো সেজে মহিলা চরিত্রগুলি নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। হারমোনিয়াম, বাঁশি ও খোলের সুরে রামায়ণের বিভিন্ন অংশের ধারাবিবরণীর সাথে এই নৃত্যানুষ্ঠানটি এক অপূর্ব রূপ পায়।
আলকাপ নাচ
পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা ও ওপার বাংলার রাজশাহী জেলার এই লোকনৃত্যটি সেই ভাবে পরিচিতি লাভ না করলেও এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বাংলার লোকনৃত্য। গাজন উৎসবের সময় ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে এখানকার তপশিলি উপজাতির লোকেরা এই নাচটি পরিবেশন করেন। নাচের সাথে সাথে গান, নাটক সব মিলিয়ে একটি বিচিত্রানুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জন করা হয়।
লাঠি নাচ
লাঠি নাচ বাংলার অতি জনপ্রিয় একটি লোকনৃত্য। এই নাচটি মূলত মহরমের ১০ দিন ধরে বাড়ির উঠানে বা রাস্তার মোড়ে অল্প বয়সী ছেলেরা পরিবেশন করে থাকে। আরম্ভ, পাঁয়তারা, লড়াই, বিরতি প্রভৃতি অংশে এই লোকনৃত্যটি বিভক্ত। এই নাচ ধীর লয়ে শুরু হয় আর দ্রুত লয়ে সমাপ্ত হয়। বাদ্যের তালে তালে বিভিন্ন কৌশলে লাঠি ঘুরিয়ে আবার কখনো কখনো তলোয়ার ও ছোরার ব্যবহার করেও আঘাত প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে কৃত্রিম যুদ্ধ করা হয়।
রণপা নাচ
রণপা নাচ কাঠি নাচ নামেও খ্যাত। দীর্ঘদিনের কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে এই নাচটিকে নৃত্যশিল্পীরা রপ্ত করেন। মূলত পুরুষ শিল্পীরা রণপার উপরে দাঁড়িয়ে এই লোকনৃত্যটি পরিবেশন করেন। এই নাচে নৃত্যশিল্পীরা কৃত্রিম যুদ্ধ করে, যার মাধ্যমে তারা তাদের দক্ষতার পরিচয় দেন, যদিও এই নাচটি যথেষ্ট বিপজ্জনক।
খ্যামটা নাচ
গ্রাম বাংলায় এই লোকনৃত্যটি কয়েক দশক আগেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। মহিলা নৃত্যশিল্পীরা জমিদার বাড়ির অনুষ্ঠানে এই নৃত্য পরিবেশন করতেন। হিন্দুধর্মের অনেক পূজা পার্বণের সময় ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও এই নৃত্যের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। মূলত রাধা কৃষ্ণের লীলা খেলা ছিল এই নৃত্যের প্রধান বিষয়বস্তু। এই লোকনৃত্যটি খেমটা তালের সাথে পরিবেশিত হয়। গ্রাম বাংলার কোন কোন অঞ্চলে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই বিলুপ্তপ্রায় নৃত্যটির ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে। এই লোকনৃত্যটিকে শহরের বাইজি নাচের গ্রামীণ সংস্করণও বলা যেতে পারে।
শিল্প ও সাহিত্যের দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাম বিশ্বের দরবারে এক আলাদা মর্যাদা লাভ করেছে। তার মধ্যে বাংলার লোকনৃত্য একটি বিশেষ স্থান অর্জন করে নিয়েছে। বিভিন্ন নৃত্যের মাধ্যমে
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, পারিবারিক ঐতিহ্যকে এখনো এই ভাবেই বহন করে চলেছে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.