বাংলার যাত্রাপালার সেকাল ও একাল
সুপ্রাচীন কাল থেকেই শিল্প ও সাহিত্যে সমৃদ্ধ আমাদের এই বাংলার মাটি। আর এই বাংলার সংস্কৃতির এক অন্যতম নিদর্শন ও চিরায়ত ঐতিহ্য যাত্রাপালা। বলা চলে গ্রাম বাংলার বিনোদনের একটি উপকরণ এই যাত্রাপালা। তবে এটি শুধুমাত্র একটি বিনোদনের উপকরণই নয়, এটি ছিল লোকশিক্ষার একটি অন্যতম মাধ্যম। যাত্রাপালার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার নিরক্ষর মানুষ জানতে পারত ধর্ম, ইতিহাস ও সমাজ-জীবনের নানান কাহিনী। এই ভাবেই বাংলার যাত্রাপালার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উজ্জীবিত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। আজকে আমার এই প্রবন্ধে বাংলার এই লোকশিল্পের জন্ম, বিকাশ ও ক্রমবিবর্তনের কিছু কাহিনী আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
যাত্রা শব্দের অর্থ
বাংলার যাত্রাপালার জন্ম ও ক্রমবিবর্তনের কাহিনী সম্বন্ধে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে “যাত্রা” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ। সংস্কৃত গমনার্থক “যা” ধাতু থেকে যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ যাত্রা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল গমন বা প্রস্থান।
গ্রাম বাংলায় দোলযাত্রা, রথযাত্রা, মনসামঙ্গলে ভাসান যাত্রা, মাঘী সপ্তমীর স্নানযাত্রার মতো শোভাযাত্রায় নৃত্য-গীতযোগে দেবমাহাত্ম্য কীর্তিত হত। প্রাচীনকালে এই জঙ্গম উৎসবকেই বলা হত যাত্রা। তবে পরবর্তীকালে এই যাত্রা শ্রোতৃমণ্ডলী পরিবেষ্টিত নির্দিষ্ট আসরে অভিনয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাংলার যাত্রাপালার জন্মলগ্নের ইতিহাস
দেবোৎসব উপলক্ষ্যে বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় নাট্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল। ডঃ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই কৃষ্ণযাত্রার অভিনয়ের চল ছিল।
কিছু সংখ্যক পণ্ডিতগণ দ্বাদশ শতকে রচিত কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দম্” কে কৃষ্ণযাত্রার আদি রূপ বলে অভিমত প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছিলেন- “জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্'-এ বাংলার যাত্রাগানের আদিম রূপটি বিধৃত আছে বলে মনে হয়।”
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের অভিমত থেকে এটা স্পষ্ট যে যাত্রাগানের বিকাশের ক্ষেত্রে গীতগোবিন্দের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
তবে বাংলায় কৃষ্ণযাত্রার বহু পূর্বেই শক্তি বিষয়ক যাত্রার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এই প্রসঙ্গে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন “ইউরোপে যে অবস্থায় মিস্টারিজ (Mystery Plays) আরম্ভ হইয়াছিল বাংলায় সেই অবস্থায় যাত্রা আরম্ভ হয়। সে কত দিনের কথা, তাহা আমরা এক্ষণে নিশ্চয় করিয়া বলিতে প্রস্তুত নই। শুনিতে পাওয়া যায়, চৈতন্যদেবের বহু পূর্বে বাংলায় যাত্রা ছিল, সে যাত্রা কেবল শক্তি বিষয়ক, কৃষ্ণযাত্রা তখন একেবারে হইত না। চৈতন্যদেবের পর যখন বৈষ্ণব সম্প্রদায় জাঁকিয়া উঠিল, তখন কৃষ্ণলীলার যাত্রা আরম্ভ করার ইচ্ছা অনেকের হয়।”
শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলায় যাত্রাপালার প্রচলন ছিল ঠিকই, কিন্তু বহু শতাব্দীব্যাপী উৎসবের ঘেরাটোপে বন্দী থাকার পর চরিত্রানুযায়ী সাজসজ্জা সহকারে আসরে অভিনয়ে অর্থে যাত্রার প্রথম নিদর্শন মেলে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে চৈতন্যদেবের আমলে। আনুমানিক ১৫০৮ অথবা ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং সারারাত ব্যাপী কৃষ্ণলীলা অভিনয় করেছিলেন। এর বর্ণনা আমরা পেয়ে থাকি কবি কর্ণপুরের “চৈতন্য চন্দ্রোদয়” নাটকে।
এছাড়াও পণ্ডিতবর্গ যাত্রার উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পোষণ করে থাকেন।
বাংলার যাত্রাপালার বিবর্তনের ইতিহাস
যাত্রাগানের মূল বিষয় কৃষ্ণলীলাকে আশ্রয় করে পাঁচালি ও কীর্তনের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা কোথাও যেন যাত্রাকে বৈচিত্র্যহীন করে তুলেছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বীরভূম জেলার কেঁদুলী গ্রামের শিশুরাম অধিকারী যাত্রাগানে নিয়ে এলেন এক নতুন বার্তা। বাংলার যাত্রাগানের বিবর্তনের ইতিহাসে তিনি “নবযাত্রার পথিকৃৎ” নামে খ্যাত।
একটা সময় বাগানবাড়ি ও বৈঠকখানায় বাবু বিলাসের নব নব চাহিদার স্রোতের সম্মুখীন হয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই লোকশিল্প পায় এক আলাদাই বিকৃত রূপ। যাত্রাপালার সাথে সংযোজিত হতে থাকে বাইনাচ, সং ভাঁড়ামি ইত্যাদি। যাত্রাপালার এই নবরূপ তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারলেও শিক্ষিত-ভদ্র সমাজ এই কুরুচিপূর্ণ লঘু রসিকতাকে কখনই স্বাগত জানায়নি।
বাংলার যাত্রাপালাকে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন আরেক বিশিষ্ট পালাকার মতিলাল রায়। তাঁরই হাত ধরে সূচনা হয়েছিল অপেরা যাত্রার।
এছাড়াও দাশরথি রায়, গোবিন্দ অধিকারী, গোপাল উড়ের মতো বিশিষ্ট পালাকাররা যাত্রাপালাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিন্যাসে ও রূপকল্পে আরও যুগোপযোগী করে তোলেন, যা দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল।
আধুনিক ও পেশাদারী যাত্রার পথ চলা শুরু হয় উত্তর কলকাতার চিৎপুরকে কেন্দ্র করে। বলা চলে চিৎপুরে এসে যাত্রা পেল এক নতুন জন্ম। যাত্রার জনপ্রিয়তা শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িও এই যাত্রার নেশায় মজেছিল। গোপাল উড়ের যাত্রাপালা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছিল।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার যাত্রাপালার ভূমিকা
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাশের হাত ধরে জন্ম হল স্বদেশী যাত্রার। নজরুল ইসলাম তাঁর নাম দিয়েছিলেন “চারণ কবি”। “ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে সমর রঙ্গে/ সাজরে সন্তান, হিন্দু মুসলমান/ থাকে থাকিবে প্রাণ/ না হয় যাইবে প্রাণ।”- মুকুন্দ দাশের এই গানের উদ্দীপনামূলক ভাষা ও শব্দ চয়নের মাধুর্য জনতার মনে সৃষ্টি করেছিল বাঁধন ছাড়া আবেগ। এই ধরণের স্বদেশী যাত্রা ও সেই যাত্রাগুলিকে কেন্দ্র করে মানুষের আবেগ কোথাও যেন ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই কারণে মুকুন্দ দাশের “মাতৃপূজা”, “পল্লীসেবা”-র মতো বহু স্বদেশী যাত্রাপালাগুলি বাজেয়াপ্ত করেছিল ইংরেজ সরকার।

বাংলার যাত্রাপালার ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন আরও এক মহান ব্যক্তি, তিনি হলেন “যাত্রাপালাসম্রাট”, “লোকনাট্যগুরু” ব্রজেন্দ্রকুমার দে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ও সময়ের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে যুগোপযোগী পালা রচনা করে তিনি মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ভাসিত তাঁর রচিত পালাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “লীলাবসান” এবং “প্রবীরার্জুন”। ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র পুত্র তথা যাত্রা বিশেষজ্ঞ তরুণকুমার দে বলেছিলেন- “তিনি শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্যই ডাক দেননি। বরং ইংরেজরা আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ঘটিয়ে যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। এছাড়া অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের দ্বন্দ্ব এসবের বিরুদ্ধেও তিনি গর্জে উঠেছিলেন। বারবার তিনি বলেছেন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি সম্প্রীতির কথা।”
এছাড়াও বহু পালাকার ও যাত্রাশিল্পীরা সেই সময় স্বদেশী যাত্রাপালার মধ্য দিয়ে বিপ্লব চেতনাকে পুষ্ট করে তুলেছিলেন।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বাংলার যাত্রাপালা
স্বাধীনতার পরবর্তী সময় যাত্রার মানোন্নয়নে নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে পালা লিখেছিলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবেন নাথ, অমর ঘোষ, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, মধু গোস্বামী সহ আরও বহু পালাকার। এই সময় সূচিত হয়েছিল বাংলার যাত্রাপালার স্বর্ণযুগ।
স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলার গ্রামে গ্রামে কয়েক রাত ধরে চলত যাত্রাপালার আসর। যাত্রাশিল্পীদের মন মাতানো সংলাপ, ঝলমলে পোশাক, বিবেকের গান সব মিলিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে যাত্রা হয়ে উঠেছিল একটি রঙিন উৎসব। যদিও সেই সময় ছিল না আলোর রোশনাই বা মাইক্রোফোন। হ্যাজাকের আলোয় শুধুমাত্র অভিনয় দক্ষতা দিয়েই গ্রাম বাংলার হাজার হাজার মানুষের মন জয় করেছে প্রত্যেকটি অপেরা।
ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে শোভাবাজার রাজবাড়িতে শুরু হল যাত্রা উৎসবের আসর। মূলত এই পর্ব থেকেই যাত্রার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছিল। এই সময় থেকেই বাংলার যাত্রাপালায় এল আধুনিকতার ছোঁয়া। বাংলার যাত্রাপালা নিল এক নতুন মোড়। যাত্রায় এল রঙিন আলোর মায়া, এল মাইক্রোফোন, ডায়াস, রস্ট্রাম। পাঁচের দশক থেকে বিদায় নিতে শুরু করল পুরানো “রানি” প্রথা। এই রানি অর্থ নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয়। এইভাবেই স্বর্ণযুগের যাত্রা নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে।
বাংলার যাত্রাপালার কিছু বিখ্যাত শিল্পী ও সৃষ্টি
বাংলার যাত্রাপালার ইতিহাস যাদের ছাড়া অসম্পূর্ণ, যারা একসময় তাঁদের অভিনয় দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন, সেই সমস্ত বিখ্যাত যাত্রাশিল্পীরা হলেন সূর্য দত্ত, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ (বড় ফণী), ফণীভূষণ মতিলাল (ছোট ফণী), শান্তিগোপাল, মোহিত বিশ্বাস, সুজিত পাঠক, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, পান্না চক্রবর্তী প্রমুখ।
রানি প্রথা লুপ্ত হওয়ার পর যাত্রার মঞ্চ কাঁপাতে শুরু করলেন জ্যোৎস্না দত্ত, বীণা ঘোষ, মিতা চট্টোপাধ্যায়, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীরাও।
“দোষী কে”, “চণ্ডীমঙ্গল”, “সোহরাব-রুস্তম”, “বাঙালি”, “রাজ সন্ন্যাসী”, “চাঁদ সুলতানা”, “বর্গী এল দেশে”, “চাষার ছেলে”, “রাজনন্দিনী”, “নটি বিনোদিনী”, “বিদ্রোহী নজরুল”, “সোনাই দীঘি”, “একটি পয়সা”, “মাইকেল মধুসূদন”, “হিটলার”, “বাঘিনী”, “জালিয়ানওয়ালা”-এর মতো শত শত যাত্রাপালা সেইসময় জয় করে নিয়েছিল মঞ্চের পর মঞ্চ।
বর্তমানকালে বাংলার যাত্রাপালা
কালের বিবর্তন বাংলার লোকসংস্কৃতিতে এনেছে নানান পরিবর্তন, আর এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলার যাত্রাপালার কৌলীন্যে। আধুনিকতার বিষবাষ্পে হারিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের এই চিরায়ত ঐতিহ্য। ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে যোগ্য পালাকারের সংখ্যা আর সাথে হ্রাস পেয়েছে যোগ্য যাত্রাশিল্পীর সংখ্যাও। যে সকল যাত্রাশিল্পীরা একসময় উত্তর কলকাতার চিৎপুরে দাপিয়ে রাজত্ব করেছিলেন, তারা এখন নয়ত নিজেদের পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছেন অথবা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে অতি শোচনীয় অবস্থায় দিনযাপন করছেন।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে শহর হোক কিংবা গ্রাম, সব মানুষের হাতেই পৌঁছে গেছে স্মার্টফোন, যার মধ্যে রয়েছে মনোরঞ্জনের সমস্ত বস্তুই। তাই যে যাত্রাপালা আগে বিনোদনের একটি উপকরণ ছিল তার জনপ্রিয়তাও ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে।
তবে আশার কথা এই যে বিগত এক দশকে চিৎপুরে একপ্রকার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সমস্ত ভুলত্রুটিগুলি মুছে ফেলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার যাত্রাশিল্প। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন থিয়েটারের গ্রুপ, আর সেখানে নতুনত্ব আনতে নতুন শিল্পীদের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে সেই প্রাচীন যাত্রার কাছেই।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.