কলকাতা থেকে সেরা রোড ট্রিপ
ট্রেনে অথবা ফ্লাইটে অতি সহজেই হয়ত আমরা পৌঁছে যেতে পারি আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে, কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি আঁকাবাঁকা পথ ধরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাত্রা করার এক আলাদাই অনুভূতি আছে। প্রতিটি রাস্তারই থাকে নিজস্ব সৌন্দর্য, আর সেই রাস্তা দিয়ে পথ চলার মধ্যে মধ্যেই চলতে থাকে পথের সঙ্গে আমাদের একান্ত আলাপচারিতা। তবে যেকোনো রোড ট্রিপের জন্য দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একটি হল সঠিক রাস্তা দেখাবার জন্য জিপিএস আর সেই রাস্তা অতি সহজেই অতিক্রম করার জন্য মনের মতো সহযাত্রী। আজকে আমার লেখনীতে কলকাতা থেকে সেরা কয়েকটি রোড ট্রিপ সম্বন্ধে রইল বিশেষ কিছু তথ্য, যা আপনাদের পরবর্তী ট্যুর প্ল্যানিং-এ আশা করি বেশ কাজে লাগবে।
কলকাতা – দীঘা
দীঘার নাম শুনলেই অনেকেই আপত্তির সুর তোলে, কিন্তু ফোর হুইলার অথবা বাইকে করে কলকাতা থেকে দীঘার একটি রোড ট্রিপ বাস বা ট্রেনের চাইতে অনেক বেশি মজাদার হয়ে ওঠে। কলকাতা শহর থেকে যতই দীঘার দিকে এগোনো যায় ততই শহরের ব্যস্ততা ও রুক্ষ পরিবেশ থেকে গ্রামীণ সরলতা ও অকৃত্রিম সৌন্দর্যের জগতে আমরা প্রবেশ করতে থাকি। রাস্তায় একবারও গাড়ি না থামালে কলকাতা থেকে দীঘা পৌঁছাতে আপনার প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা মতো সময় লাগবে। তবে রাস্তার ধারের চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা না খেলে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি না তুললে ঘুরতে যাওয়ার মজাটা ঠিক আসে না।
দিনের বেলায় সমুদ্র স্নান ও রাতে সমুদ্র সৈকতে বসে বিভিন্ন সুস্বাদু সামুদ্রিক খাবার খেতে খেতে শীতল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জন শুনতে শুনতে আপনার সময় কিভাবে কেটে যাবে তা টেরই পাবেন না।
কলকাতা – বোলপুর
কলকাতা থেকে বোলপুরের রোড ট্রিপ মানেই গন্তব্য শান্তিনিকেতন। পশ্চিমবাংলার এক মনোমুগ্ধকর অপূর্ব সুন্দর রাঙা মাটির দেশ বীরভূম, আর এই বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত শান্তিনিকেতন। কলকাতা থেকে বোলপুরের ট্রেনের সফরে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা মতো, আর যদি সেটা রোড ট্রিপ হয় তবে সময়ের হিসেব দাঁড়ায় ঘণ্টা চার-পাঁচেকের।
রবি ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে আমাদের পরিচয় ঘটে বাংলার সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে। এখানকার গ্রাম বাংলার রাঙা মাটির পথ আপনাকে নিয়ে যাবে কোপাই নদীর ধারে অথবা সোনাঝুরির জঙ্গলে আদিবাসীদের হাটে। এই হাটটি প্রতি সপ্তাহে শনিবার করেই বসে। শান্তিনিকেতনের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য ও রোড ট্রিপের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে সপ্তাহান্তের দুটি দিন আশা করি আপনাদের ভালোই কাটবে।
কলকাতা – সুন্দরবন
বাইকপ্রেমীদের জন্য কলকাতা টু সুন্দরবন রোড ট্রিপ একদম আদর্শ একটি বাইক ট্রিপ হয়ে উঠতে পারে। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার সম্পূর্ণ এই ট্রিপটি আপনি আপনার বাইকে করে কভার করতে পারবেন, শুধু নদী পার হওয়ার সময় আপনার বাইকটিকে সাবধানে লঞ্চে তুলে দিতে হবে। এখানকার ম্যানগ্রোভ অরণ্য, নানা ধরণের পরিযায়ী পাখির কিচিরমিচির, কুমীর, হরিণ ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রাণীর সাথে সাক্ষাৎ আপনার সুন্দরবন ট্রিপকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। আর আপনার ভাগ্য যদি খুবই ভালো হয় তাহলে দেখা পেলেও পেতে পারেন বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের।
কলকাতা – পুরুলিয়া
পুরুলিয়া মানেই লাল পাহাড়ের দেশ, রাঙা মাটির দেশ। সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টার রোড ট্রিপ আপনার গোটা সপ্তাহের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে দূর করে দেবে। কংক্রিটের মসৃণ রাস্তার দুপাশে দেখতে পাবেন দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ, ধানক্ষেত, সবুজ বনানী ও মাঝে মাঝে কিছু মাটির বাড়ি। বসন্তের সময় সারি সারি পলাশ গাছে ফুটে থাকা পলাশ ফুল এই রোড ট্রিপকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। প্রায় জনপ্রাণীহীন এই রাস্তাগুলি আপনার মনে দেবে এক পরম শান্তির অনুভূতি।

পুরুলিয়ায় আগত বেশিরভাগ পর্যটকদেরই গন্তব্য হয় অযোধ্যা পাহাড়। অনেকেই এই পাহাড়ে ট্রেকিং-এর জন্য আসেন। অযোধ্যা পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের অকল্পনীয় সৌন্দর্য ট্রেকিং-এর সমস্ত ক্লান্তি নিমেষের মধ্যে দূর করে দেয়। এছাড়াও চড়িদা গ্রাম (মুখোশ গ্রাম), রাকাব অরণ্য, মুরাডি বাঁধ, সীতাকুণ্ড, বামনি জলপ্রপাতের মতো বহু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জায়গার অধিকারী আমাদের রাঙা মাটির দেশ পুরুলিয়া।
কলকাতা – পুরী
যদি কেউ লং রোড ট্রিপ প্ল্যান করতে চান তাহলে কোলকাতা থেকে পুরীর রোড ট্রিপটি আপনি বেছে নিতে পারেন। সম্পূর্ণ রোড ট্রিপটি কভার করতে আপনার প্রায় দশ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা রাজ্যের মধ্যে দিয়ে আপনার যাত্রাপথে দুটি ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন চিত্র চোখে পড়বে। এই লং ট্রিপের মাঝে পুরীর সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় কাটানোর মুহূর্ত আপনার হৃদয়ের ক্যানভাসে চীর জীবন বন্দী হয়ে থাকবে। পুরীর প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও জগন্নাথ দেবের দর্শন এই ট্রিপের আকর্ষণের আরও একটি অন্যতম কারণ। এছাড়াও পুরী থেকে অল্প দূরেই কোণার্কের সূর্য মন্দির, চিল্কা হ্রদ, নন্দনকানন সহ বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

কলকাতা – ডুয়ার্স
প্রায় এগারো থেকে বারো ঘণ্টা স্টিয়ারিংয়ে বসে থাকাটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে যারা গাড়ি চালাতে ভালোবাসেন তাদের কাছে কলকাতা টু ডুয়ার্সের রোড ট্রিপটি বেশ রোমাঞ্চকর একটি রোড ট্রিপ হয়ে উঠবে। সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি এবং মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলার মধ্যে দিয়ে সময় কিভাবে কেটে যাবে তা আপনি বুঝতেও পারবেন না। প্রকৃতির সবটুকু সবুজ যেন এই অঞ্চলটি ঘিরেই বিরাজমান। ডুয়ার্সে পৌঁছে জলদাপাড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বক্সা ফোর্ট, তিস্তা ব্যারেজ, জয়ন্তী নদী ইত্যাদি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি গাড়ি করে আপনি সহজেই ঘুরে আসতে পারেন।

কলকাতা – দার্জিলিং
ডুয়ার্সের মতোই কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এর রোড ট্রিপটিও দীর্ঘ এবং বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি ট্রিপ। মনের জোর আর প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আপনার সংশয় নিমেষে দূর করে দেবে। তবে মনে রাখতে হবে নিজে গাড়ি চালাতে হলে আপনাকে অতি অবশ্যই হতে হবে একজন পাকাপোক্ত ড্রাইভার, কারণ সমতলে গাড়ি চালানো আর পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। কলকাতা থেকে প্রথমে আপনাকে শিলিগুড়ি পৌঁছাতে হবে, সেক্ষেত্রে সকাল সকাল যাত্রা শুরু করে দেওয়াটাই বেস্ট। শিলিগুড়িতে নাইট স্টে করে আবার পরের দিন সকালে রওনা দিতে হবে দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে। সম্পূর্ণ রোড ট্রিপটি কভার করতে প্রায় পনেরো থেকে ষোলো ঘণ্টা মতো সময় লাগবে। তবে এই যাত্রাপথে আদিম প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দৰ্য্য পরতে পরতে মিশে আছে। তাই এই দীর্ঘ সময় অতি সহজেই অতিবাহিত হয়ে যাবে। দার্জিলিং-এ পৌঁছে টাইগার হিল, বাতাসিয়া লুপ, চৌরাস্তা মলের মতো বিখ্যাত জায়গাগুলি আপনি অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন। আর তার সাথে দার্জিলিং-এর টয়ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে একদমই ভুলবেন না।

কলকাতা – কালিম্পং
সেরা রোড ট্রিপের তালিকায় কলকাতা থেকে কালিম্পং-এর রোড ট্রিপটি বেশ আকর্ষণীয়। কলকাতার ক্যাকোফোনি থেকে দূরে এই হিল স্টেশনটি একটি শান্তির নীড়। ষোলো-সতেরো ঘণ্টার এই যাত্রাটি কিছুটা ক্লান্তিকর হলেও যে অভিজ্ঞতা আপনি এই রোড ট্রিপ থেকে অর্জন করবেন তা আপনার সময় ও কষ্ট কোনোকিছুকেই বৃথা যেতে দেবে না। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ও ছোট ছোট ঝর্ণার অবিশ্রান্ত জলধারার শব্দ এবং শীতল হওয়ার স্পর্শ আপনাকে দেবে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এখানকার হন্টেড প্লেসগুলি আমার মতো ভূতপ্রেমীদের বেশ আকর্ষণ করে। তাছাড়া কালিম্পং-এ এসে প্যারাগ্লাইডিং করতে একদমই ভুলবেন না। আর এখানকার মনেস্ট্রিগুলিও আপনাকে দেবে এক অপার শান্তির অনুভূতি। এছাড়াও কালিম্পং-এর অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি আপনি চাইলেই এই ট্রিপের মধ্যে কভার করতে পারেন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Your blog pictures look nice. But, unfortunately, I can only speak English. I wish there was a way to translate. You are lucky to be able to travel to such nice places so freely.