কলকাতার বিশিষ্ট শীতকালীন পিকনিক স্পট
শীতকাল মানেই লেপের উষ্ণতা, নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর পিঠেপুলি। তবে আরও একটা জিনিস যেটা ছাড়া বাঙালিদের শীতকাল অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটা হল পিকনিক। নতুন বছরের শুরুতে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় বাঙালি মেতে উঠেছে পিকনিকের আমেজে। কিছু না হলেও বাড়ির উঠোনে বা ছাদে প্রিয়জনদের সাথে জমিয়ে মাংস-ভাত খাওয়ার এক আলাদাই মজা আছে। তবে যদি বাড়ির চার দেওয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে কোথাও নিরিবিলি সবুজে ঘেরা জায়গায় প্রকৃতির কোলে বসে চড়ুইভাতি হয় তাহলে আনন্দটা হাজার গুণে বেড়ে যায়। আজকে আমার লেখনীতে আপনাদের জন্য রইল কলকাতার বুকে অবস্থিত সেই রকমই কয়েকটি বিশিষ্ট শীতকালীন পিকনিক স্পট সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তথ্য।
ইকোপার্ক
কলকাতার রাজারহাটে নিউটাউন অঞ্চলে অবস্থিত এই ইকোলজিক্যাল পার্ক বা ইকোপার্কের সম্পর্কে আশা করি সবাই জানেন। ভারতের বৃহত্তম এই উদ্যানটি মোট ৪৮০ একর জমির উপরে তৈরি করা হয়েছে, এর সাথে একটি দ্বীপ ও ১০৪ একর আয়তনের একটি লেক রয়েছে। এই লেকের ধার দিয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার সময় কিভাবে কেটে যাবে তা বুঝতেই পারবেন না। এই লেকে বোটিং-এর সুব্যবস্থাও রয়েছে। ২০০৭ সালে ঘোষিত বিশ্বের বর্তমান সপ্তম আশ্চর্যের প্রত্যেকটির রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে এই পার্কটিতে। এছাড়াও প্রাচীন আশ্চর্য হিসাবে মিশরের পিরামিডও এখানে তার স্থান করে নিয়েছে। কচিকাঁচাদের জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে একটি চিলড্রেন্স পার্ক। ইকোপার্কে রয়েছে একটি ভাসমান অর্ধবৃত্তাকার অ্যাম্ফিথিয়েটার যার মধ্যে প্রায় ২০০০ দর্শক একই সাথে যেকোনো অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকতে পারে। এছাড়াও এই পার্কটিতে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে রবি অরণ্য, ট্রপিক্যাল টি গার্ডেন, বাটারফ্লাই গার্ডেন, আর্টিস্টস কটেজ, রোস গার্ডেন, স্কাল্পচার গার্ডেন, মাস্ক গার্ডেন, রেইন ফরেস্ট, ফলের বাগান, ডিয়ার পার্ক, পাখিবিতান, গল্ফ কোর্স, জাপানিজ ফরেস্ট ইত্যাদি। পায়ে হেঁটে অথবা ট্যান্ডেম বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে আপনি গোটা পার্কটি ঘুরে দেখতে পারেন। সবশেষে সন্ধ্যের সময় অন্ধকার নেমে এলে ইকোপার্ক আপনাকে উপহার হিসাবে দেবে একটি মিউসিক্যাল ফাউন্টেন শো।
শীতকালীন পিকনিক স্পট হিসাবে ইকোপার্ক বিগত কিছু বছর ধরে কলকাতা সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। আপনি চাইলে বাড়ি থেকে খাবার তৈরি করে নিয়ে এসে এখানে বসে সবাই মিলে অনায়াসেই পিকনিক করতে পারেন। এছাড়া এখানে অনেক খাবারের স্টল আছে, সেখান থেকে খাবার কিনেও আপনি পিকনিকের মজা নিতে পারেন।
চার নম্বর ভেড়ী
কলকাতার ইএম বাইপাসে চিংড়িঘাটা বাসস্টপ থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেক দূরে অবস্থিত এই ভেড়ীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি পিকনিক স্পট। এখানে সবুজের ছায়া মাখানো মেঠো পথের ধার দিয়ে বিস্তারিত এলাকা জুড়ে রয়েছে জলাশয় যেখানে মাছ চাষ করা হয়। খোলা আকাশের নিচে পিকনিকের জমজমাট খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথে জেলেদের জীবনযাত্রা ও মাছ চাষের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইলে শীতকালীন পিকনিক স্পট হিসাবে এই ভেড়ীটি একটি আদর্শ স্থান। এখানকার জলাশয়ে আপনি চাইলে প্যাডেল বোট বা ছোট নৌকায় করে ঘুরে আসতে পারেন। ফিসারমেন্স কোওপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত এই ভেড়ীটিতে মোট ছয়টি পিকনিক স্পট আছে এবং প্রতিটি স্পটে পিকনিক করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুব্যবস্থা রয়েছে। অন্যান্য আর পাঁচটা পার্কের মতো লোকের ভিড় আপনি এখানে পাবেন না। তাই নিরিবিলিতে পরিবারের সদস্য অথবা বন্ধুদের সাথে পিকনিক করতে চাইলে অতি অবশ্যই চলে আসুন চার নম্বর ভেড়ী পিকনিক স্পটে।
সুকান্তনগর সমিতি ভেড়ী
কলকাতার সল্টলেকের সেক্টর ৫-এর কথা ভাবলে আমাদের একটা কথাই মাথায় আসে, আর সেটা হল বড় বড় গগনচুম্বী অফিস আর অজস্র খাবারের দোকান। কিন্তু এই অফিস পাড়ায় যে মনোরম একটি পিকনিক স্পট রয়েছে তার সন্ধান হয়তো অনেকেরই জানা নেই। চার নম্বর ভেড়ীর মতোই এখানেও সুকান্তনগর ভেরীকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি পিকনিক স্পট। শীতের মিঠে রোদ গায়ে মাখিয়ে জলাশয়ের পাশে বসে চড়ুইভাতির এক আলাদাই মজা নিতে পারবেন এই জায়গাটিতে।
মুদিয়ালি নেচার পার্ক
কলকাতার বুকে অবস্থিত একটি আদর্শ শীতকালীন পিকনিক স্পট মুদিয়ালি নেচার পার্ক। মুদিয়ালি ফিসারমেন্স কোওপারেটিভ সোসাইটির বহু পরিশ্রমের ফলস্বরূপ দূষিত জলাশয়গুলি হয়ে উঠেছে মাছ চাষের উপযুক্ত। বিশাল বিশাল জলাশয় তো রয়েছেই তার সাথে এখানে আছে সেগুন, মেহগনি, কদম, কৃষ্ণচূড়া থেকে শুরু করে নানান ধরণের গাছগাছালি। এরই মাঝে শীতকালে কনসার্ট শুরু হয়ে যায় ভিন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিদের। এছাড়া এখানে কচিকাঁচাদের জন্য রয়েছে দোলনা, স্লিপ সহ নানান খেলার জিনিস। জলাশয়গুলিতে স্পিড বোটের ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানকার আরও একটি অন্যতম মূল আকর্ষণ মিনি চিড়িয়াখানা, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন প্রচুর হরিণ, রাজহাঁস ও ময়ূর। সব মিলিয়ে আপনি এখানে পিকনিকের ভরপুর মজা নিতে পারবেন।

নীলদীপ গার্ডেন
পিকনিক প্রেমী বাঙালিদের জন্য খুঁজে দিলাম আরও একটি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে আবৃত শীতকালীন পিকনিক স্পট। প্রকৃতিবিলাস ও নির্ভেজাল আড্ডার সাথে সাথে কব্জি ডুবিয়ে রসনাতৃপ্তির জন্য বারুইপুরের এই জায়গাটি একদম আদর্শ। ৩২ কাঠা জমির উপরে এই গার্ডেনটি গড়ে উঠেছে। বাচ্চাদের খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের দোলনা, ফুল, ফল ও সবজীর বাগান নিয়ে তৈরি হয়েছে এই পিকনিক স্পটটি। আপনারা চাইলে গার্ডেন বিল্ডিং-এর ডাইনিং হলে একসাথে আনন্দের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন। এছাড়া যদি প্রকৃতির কোলে বসে আপনি আপনার মধ্যাহ্নভোজটি সারতে চান তাহলে বাইরে আমব্রেলা টেবিলেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এই গার্ডেনটিতে রয়েছে দুটি ট্রি হাউস যেখানে বসে আড্ডাটা বেশ ভালোই জমে যাবে। যেটা ছাড়া শীতকালে পিকনিক অসম্পূর্ণ থাকে সেটা হল ক্যাম্পফায়ার, নীলদীপ গার্ডেনে আপনাদের জন্য সেই ক্যাম্পফায়ারেরও সমস্ত ব্যবস্থা আছে। পিকনিকের সমস্ত সরঞ্জাম আপনি যদি বয়ে নিয়ে যেতে না চান তাহলে এখানে আপনি পেয়ে যাবেন ফুড ও ক্যাটারিং সার্ভিসের সুব্যবস্থা।
রায়কুঠীর পিকনিক গার্ডেন
কলকাতার রাজারহাট নিউটাউন সিসি২ থেকে মাত্র ১কিলোমিটার দূরে রায়কুঠীর বাগানবাড়িটি অবস্থিত। প্রায় ১১০০ এর উপরে সুপারি গাছ নিয়ে শান্ত শীতল পরিবেশে সেজে উঠেছে রায়কুঠীর। এই পিকনিক গার্ডেনটির বিশেষত্ব হল এখানে এক দিনে একটি পরিবার অথবা একটি গ্রুপকেই ভাড়া দেওয়া হয়, এরফলে আপনজনদের সাথে বাইরের কোলাহল ও অচেনা মানুষের ভিড় থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে নিরিবিলিতে আপনি আপনার মতো করে কাটাতে পারবেন গোটা একটি দিন। এই বাগানবাড়িটিতে রয়েছে একটি রেস্টরুম যেখানে আপনি চাইলে দুদণ্ড জিরিয়েও নিতে পারেন। এখানে বাচ্চাদের জন্য রয়েছে টেন্ট, বিভিন্ন ধরণের দোলনা থেকে শুরু করে নানান খেলার জিনিস। শীতকালীন পিকনিক স্পট হিসাবে এই বাগানবাড়িটির জুড়ি মেলা ভার। এখানে পিকনিকের খুঁটিনাটি সমস্ত ধরণের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে রাঁধুনি দিয়ে রান্না করানোরও ব্যবস্থা রয়েছে।
ময়দান
ময়দান মানেই শীতের প্রত্যেকটি রবিবারে মানুষের ভিড়। শুধু ভিড় বললে যদিও ভুল হবে, রীতিমতো চাদর বা শতরঞ্চি বিছিয়ে পিকনিক। বাড়ি থেকে ভালো-মন্দ রেঁধে এনে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া তো আছেই, তার সাথে নয় থেকে নব্বই সকলেই মেতে ওঠে ব্যাডমিন্টন বা ক্রিকেট খেলায়। লুচি-তরকারি, পোলাও-মাংসের মতো বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের গন্ধে গোটা ময়দান চত্বর ভরে ওঠে। এর মাঝে সময় করে কিছু মানুষ আবার ঘোড়ায় চেপে ঘুরেও আসে। পিকনিকের এই নির্ভেজাল আনন্দ একমাত্র এই রকম মুক্ত পরিবেশে খোলা আকাশের নিচেই মেলে, যেখানে কচিকাঁচা থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, মধ্যবয়সী এমনি বয়স্করাও প্রাণ খোলা হাসি হাসতে পারেন।
এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে বহু পিকনিক স্পট যেখানে আপনি এই শীতে একটি ছুটির দিন পরিবার পরিজনদের সাথে অনায়াসেই কাটিয়ে আসতে পারেন।
আমার সকল পাঠকদেরকে জানাই হ্যাপি নিউ ইয়ার। এই নতুন বছর আপনাদের জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
How to contact those property? Plz share there contact no
Which property do you want to connect to?
Pingback: কলকাতা শহরের জনপ্রিয় জাদুঘর - Kuntala's Travel Blog
Pingback: কলকাতা থেকে সেরা রোড ট্রিপ - Kuntala's Travel Blog