ন্যাশনাল পার্কের শিরোপা প্রাপ্ত ৬টি বিখ্যাত বাংলার অরণ্য
অরণ্য আর অ্যাডভেঞ্চার শব্দ দুটিকে সমার্থক বলা যেতে পারে। গহীন অরণ্যের রহস্য উদঘাটন করতে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা চিরকালই সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে পৌঁছে গেছেন সবুজের দেশে। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে অরণ্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা যে কোন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষকে টেনে নিয়ে যাবে গভীর অরণ্যের মাঝে। বাংলার বুকে রয়েছে এই রকমই বহু অরণ্য। আজকে সেই সমস্ত বাংলার অরণ্য যেগুলি ন্যাশনাল পার্কের শিরোপা পেয়েছে, সেই অরণ্যগুলির বিস্তারিত তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছি আপনাদের জন্য।
জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক
পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায়, পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে তোর্সা নদীর তীরে প্রায় ২১৬.৫১ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই অরণ্যটি রহস্যময় মায়াজাল বুনে রেখেছে। এই অরণ্য মূলত দীর্ঘকায় এলিফ্যান্ট ঘাসবিশিষ্ট সাভানা অঞ্চল। আসামের কাজিরাঙা ও পবিতারা ছাড়া জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক একমাত্র বাংলার অরণ্য যেখানে সর্বাধিক সংখ্যক এক শৃঙ্গ গণ্ডারের দেখা মেলে। এখানকার নদীকেন্দ্রিক বনাঞ্চলময় সুবিস্তৃত তৃণভূমি এই লুপ্তপ্রায় প্রাণীটির নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। এছাড়া রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, নানান প্রজাতির হরিণ, বাইসন ও আরও অনেক ধরনের পশুর দেখা মেলে এই অরণ্যে। বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান সহ নানান প্রজাতির পাখির কলরব শুনতে পাবেন এখানে। সরীসৃপের মধ্যে অজগর, কোবরা, গিরগিটি, ক্রেট ছাড়াও ৮ প্রকারের কচ্ছপ পাওয়া যায় এই ন্যাশনাল পার্কটিতে।
হাতির পিঠে চড়ে বন্যজীবনকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুব্যবস্থা আছে জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্কে। এলিফ্যান্ট সাফারি ছাড়াও এখানে জিপ সাফারিরও ব্যবস্থা রয়েছে।
আপনি যদি অরণ্যের বুকে থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাহলে হলং বনবাংলোটি আপনার জন্য আদর্শ হবে।
বক্সা ন্যাশনাল পার্ক
পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় বক্সা পাহাড়ের পাদদেশে ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই ন্যাশনাল পার্কটি অবস্থিত। রাজাভাতখাওয়া, নিমাটি, বারবিশা, রায়ডাক, রায়মাটাং, জয়ন্তী, বক্সাদুয়ার ও ভুটানঘাট নিয়ে মোট ৮টি বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করে বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট গড়ে উঠেছে। বক্সা ও জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে চিলাপাতা বনাঞ্চলটি একটি এলিফ্যান্ট করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই অরণ্যভূমির উপর দিয়ে রায়ডাক, জয়ন্তী সহ বহু নদী বয়ে গেছে, এছাড়া এখানকার নরথালি হ্রদে দেখা মিলবে বহু পরিযায়ী পাখিদের। নানা ধরনের হর্নবিল, ওয়াগটেইল, রেডস্টার সহ বহু পাখির কিচিরমিচির শব্দ অরণ্যের নির্জনতা ভেদ করে বহু দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, গুল্ম, বনৌষধি, অর্কিড, বাঁশ, বেত, ঘাস ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে এই অরণ্য সবুজ কার্পেটে মোড়া। বাঘ, এশীয় হাতি, লেপার্ড ক্যাট, রিগাল পাইথন, বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, হিসপিড হেয়ার, হগ হরিণ, চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন ছাড়াও বহু বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের এখানে বসবাস।
এই অরণ্যটির ভিতরে বহু প্রাচীন বক্সা দুর্গ অবস্থিত। ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকে এই দুর্গটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এছাড়াও এই অরণ্যের ভিতরে একটি প্রাচীন শিব মন্দিরও আছে, এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা এই শিব মন্দিরটিকে খুবই পবিত্র বলে মনে করেন।
এখানে থাকার জন্য রাজাভাতখাওয়া, নিমাটি, বারবিশা, রায়ডাক, রায়মাটাং, জয়ন্তী, আর ভুটানঘাটে বনবাংলো পেয়ে যাবেন।
গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক
পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ডুয়ার্স অঞ্চলে ৮০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই বনভূমিটি বিস্তৃত। শাল, সেগুন, শিরিষ, শিমুল, বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস ও নল খাগড়া সহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অর্কিডে এই অরণ্যটি সেজে উঠেছে। গণ্ডার, হাতি, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বন্য শূকর, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, এছাড়া ইন্ডিয়ান পাইথন ও কিং কোবরার মতো বিষাক্ত সরীসৃপ, পাখিদের মধ্যে হাজারিকা, মৌটুসি, বুলবুলি, ফিঙে, ইন্ডিয়ান হর্নবিল, বিরল প্রজাতির ব্রাহ্মণী হাঁস সহ অনেক ময়ূর ও কাঠঠোকরার বাসস্থান এই অরণ্য। গরুমারা ন্যাশনাল পার্কে জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থাও আছে, যা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
এখানে গরুমারা হর্নবিল নেস্ট, গরুমারা ইকো-ভিলেজ কালিপুর, গরুমারা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প সহ আরও অনেক সরকারি রিসোর্ট আছে। তবে হাতে কিছুটা সময় নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে থেকে এই রিসোর্টগুলি বুক করতে হবে।
নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক
পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই ন্যাশনাল পার্কটি অবস্থিত। জীববৈচিত্রের দিক দিয়ে উত্তর পূর্ব ভারতের সর্বাধিক সমৃদ্ধ বাংলার অরণ্য এই নেওড়া ভ্যালি। এই অরণ্যের দুর্গমতাই চোরা শিকারি ও পর্যটকদের থেকে এখানকার উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুলকে সুরক্ষিত রেখেছে। এখানে কিছু কিছু জায়গায় দিনের বেলাতেও সূর্যের আলোর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঘন সন্নিবদ্ধ আকাশছোঁয়া বৃক্ষের সারি। তবে প্রকৃতিপ্রেমী ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য এই নেওড়া ভ্যালি। এখানকার নিকটতম শহর লাভা থেকে আপনারা ট্রেকিং শুরু করতে পারেন। খয়ের, শিরীষ, শিশুর ঘন বনানী সাথে রঙিন রডোডেনড্রন, বিরল প্রজাতির অর্কিডে সেজে উঠেছে এই অরণ্য। মাঝে মধ্যে দূর থেকে গগনচুম্বী তুষারাবৃত পর্বত শৃঙ্গগুলি হাতছানি দেয়, তার সাথে পাহাড়ি নদীর কলকল ধ্বনি আর নাম না জানা হাজার হাজার পাখির সুমধুর ডাক এক মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করে। এরই মাঝে রেড পান্ডা, ক্লাউডেড লেপার্ড, বনবিড়াল সহ বহু বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীদের অবাধ বিচরণ এখানে লক্ষ করা যায় ।
এখানে থাকার জন্য এই ন্যাশনাল পার্কটির আশেপাশে অনেক সরকারি ও বেসরকারি রিসোর্টের সুব্যবস্থা আছে।
সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক
দার্জিলিং জেলার পরতে পরতে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রকৃতি যেন সবটুকু উজাড় করে এই জায়গাটিকে সাজিয়ে তুলেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের এই দার্জিলিং জেলায় পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে ৭৮.৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক। এই গহীন অরণ্যে রুপালি দেবদারু, ওক, হেমলক, রুপালি ফার, বার্চ প্রভৃতি বৃক্ষের মাঝে রেড পান্ডা, সোনালী বিড়াল, হলুদ গলা মার্টেন, ভাল্লুক, প্যাঙ্গোলিন সহ বহু প্রাণীর বাসস্থান গড়ে উঠেছে। এই বাংলার অরণ্য স্কারলেট মিনিভেট, হিমালয়ান শকুন, তোতাপাখি সহ বহু বিরল প্রজাতির পাখির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। সিঙ্গালিলা রিজ বরাবর সান্দাকফু-ফালুটের ট্রেকিং রুটটি পূর্ব হিমালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয়। এভারেস্ট আর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সঙ্গী করে এই পথ অতি সহজেই অতিক্রম করে যেতে পারবে প্রকৃতিপ্রেমী ট্রেকাররা।
দার্জিলিং-এ প্রচুর টুরিস্ট লজ রয়েছে যেখান থেকে আপনি অনায়াসেই সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছে যেতে পারবেন।
সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন একটি ন্যাশনাল পার্ক, টাইগার রিজার্ভ ও বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এই অরণ্যটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এরমধ্যে ৬৬ শতাংশ এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত, বাকি ৩৪ শতাংশ ভারতের অন্তর্গত। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে এই বাংলার অরণ্য নিজের জায়গা করে নিয়েছে। পর্যটকদের কাছে এখানকার মূল আকর্ষণ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। যদিও বাঘ মামার দেখা পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে শীতকালে নদীর চড়ে অনেক কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন রকমের পরিযায়ী পাখি, সরীসৃপ, চিত্রা হরিণ, বাঁদর, সহ নানান প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থান এই অরণ্য। প্রধানত সুন্দরী, গেঁওয়া, গরান ও কেওড়ার মতো ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদগুলি এখানে দেখতে পাওয়া যায়।
সুন্দরবন ভ্রমণকে দুটি অংশে ভাগ করা যায়- এক দিকে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ভগতপুর, বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প, লোথিয়ান দ্বীপ। অপর দিকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সোজনেখালি, সুধন্যখালি, দোঁবাকি থেকে বুড়ির ডাবরি পর্যন্ত।
রোমাঞ্চকর পরিবেশে রাতের অন্ধকারে প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আপনি লঞ্চে রাত্রিবাস করতে পারেন। এছাড়া সোজনেখালিতে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ সহ আরও অনেক জায়গায় থাকার সুব্যবস্থা আছে।
বর্ষাকালে এরমধ্যে বেশিরভাগ অরণ্যগুলিতে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। তাই বর্ষাকাল বাদে বছরের অন্য যেকোনো সময় আপনি চলে যেতে পারেন গহীন অরণ্যের মায়াবী রূপের সাক্ষী হতে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.