Bengal TravelsBengaliFEATURED

কলকাতার সেরা ১০টি হন্টেড প্লেস

কলকাতা এমন একটি শহর যার সাথে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস। সময় বয়ে চলেছে, কিন্তু এখনও  ইতিহাস ফিসফিস করে যেন কিছু বলে যায়। অতীতে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার সাক্ষী রয়ে গেছে অনেক জায়গা। আর সেই সমস্ত হাড় হিম করে দেওয়া হন্টেড প্লেসগুলি আপনাকে দেবে এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। যারা ভয় পেতে ভালোবাসেন তাদের জন্য রইল কলকাতার ১০টি নামকরা হন্টেড প্লেস ও সেখানকার কিছু অলৌকিক কাহিনী।

হেস্টিংস হাউস

বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস নিজের থাকার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এই বিল্ডিংটি। বর্তমানে এটি একটি সুপরিচিত মহিলা কলেজ। এই কলেজের ছাত্রীরা বহু বার একজন অচেনা ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছে এবং তাদের বিবরণ অনুযায়ী সেই ব্যক্তিটি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেরান এবং তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি কিছু যেন খুঁজছেন। লোকমুখে এ কথা শোনা যায় যে জেনারেল হেস্টিংস তাঁর শেষ জীবনটা খুবই হতাশা ও দুঃখের সাথে কাটিয়েছিলেন এবং এখনও তাঁর আত্মা শান্তির খোঁজে হেস্টিংস হাউসে ঘুরে বেড়ায়। অনেকের মুখে একথাও শোনা যায় যে মধ্যরাত্রে যখন কলেজ সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকে, সেই সময় একটি ছোট বাচ্চার খিলখিল হাসি ও ফুটবল খেলার শব্দ পাওয়া যায়।

দ্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি

১৮৩৬ সালে কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে আপনি পেয়ে যাবেন বহু দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ আর তার সাথে ভৌতিক অভিজ্ঞতার সাক্ষীও হতে পারেন। এখানকার নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রায়ই এক মহিলার গলা শুনতে পান, মনে করা হয় এটি লর্ড মেটকাফের স্ত্রীর আত্মা, যিনি এখনো এই জায়গাটিতে ঘুরে বেড়ান। তিনি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও গোছানো একজন মানুষ ছিলেন এবং এখনো যদি আপনি লাইব্রেরির কোন বই পড়ে সেটি সঠিক জায়গায় না রাখেন তাহলে তাঁর নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারবেন আপনার ঘাড়ে। ২০১০ সালে ভবনটি সংস্কারের সময় ১২ জন খুবই মর্মান্তিক ভাবে মারা গিয়েছিলেন এবং কিছু মানুষ তাদের আত্মার উপস্থিতিও অনুভব করেছেন।

সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি

কলকাতার এই সেমিট্রিটি হন্টেড প্লেস হিসেবে খ্যাত। এই জায়গাটিতে প্রবেশ করলে একটা গা ছমছমে ভাব আপনি অনুভব করতে পারবেন। এখানে ব্রিটিশ সৈনিকদের কবরস্থ করা হত এবং এখনও তারা নানা ভাবে তাদের উপস্থিতির জানান দিয়ে যায়। যদিও কোন দিনও কারোর কোন রকম ক্ষতি হয় নি, কিন্তু একবার একটি দুর্ঘটনা বা বলা চলে অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায় এখানে। একদল ছেলে মিলে এখানে কিছু ছবি তোলে এবং সেই ছবিগুলিতে অদ্ভুত ভাবে একটি ছায়া মূর্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যে ছেলেটি সেই ছবিগুলি তুলেছিল তার শ্বাসকষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়, যদিও ছেলেটির কোন শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা কোনও দিনই ছিল না।

রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন

নামটি শুনে খুব অদ্ভুত লাগছে তাই না? আপনি হয়তো বহুবার এই স্টেশন থেকে মেট্রোতে উঠেছেন, কিন্তু কখনও কি রাতের শেষ মেট্রো করে বাড়ি ফিরেছেন? শেষ মেট্রোর যাত্রীরা অনেকেই তেনাদের দর্শন পেয়েছেন। প্রায়শই তারা ছায়ামূর্তি দেখতে পায় এই স্টেশনে, আর তার সাথে শুনতে পায় ভয়ঙ্কর আর্তনাদ। বহু মানুষ এই রেল লাইনে আত্মহত্যা করেছেন এবং তাদেরই অশরীরী আত্মা এখনও রাতের অন্ধকারে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করে।

একবার শেষ মেট্রোর যাত্রী হয়ে দেখতে পারেন, হয়তো আপনিও পেয়ে যেতে পারেন তাদের দর্শন।

রাইটার্স বিল্ডিং

কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং একটি নামকরা হন্টেড প্লেস। ১৭৭৭ সালে রাইটার্স বিল্ডিং স্থাপিত হয় এবং এটি তখনকার দিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেখকদের দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হত। ১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়, বাদল ও দীনেশ তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ কর্নেল সিম্পসনকে এখানে গুলিবিদ্ধ করেন। এরপর থেকেই রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঘটতে থাকে বিভিন্ন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা। কখনও বা পায়ের শব্দ, কখনো হাসি, আবার কখনো তারস্বরে চিৎকারের শব্দ শোনা যায় রাইটার্স বিল্ডিং থেকে। অন্ধকার নেমে এলে এখানকার কর্মীরাও এই জায়গাটিতে থাকার ঝুঁকি নেয় না। বিল্ডিংয়ের পঞ্চম ব্লকে যেখানে কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটি বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পরে রয়েছে। 

উইপ্রো অফিস

সম্ভবত কলকাতার উইপ্রো ভারতের একমাত্র অফিস যেখানে কর্মচারীদের অফিসের একটি নির্দিষ্ট অংশে যাওয়ার সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আছে। বিশেষ করে উইপ্রোর টাওয়ার থ্রির তৃতীয় তলা থেকে দূরে থাকার জন্য সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে যে জায়গাটিতে এই অফিসটি তৈরি হয়েছে সেখানে আগে একটি কবরস্থান ছিল এবং বহু ধর্ষণ ও খুনের সাক্ষী এই জায়গাটি। কোম্পানির কর্মচারীরা প্রায়ই বিল্ডিংয়ের ওয়াশরুমে অশরীরী কারোর উপস্থিতি অনুভব করে, আবার কখনো হঠাৎ করে দরজা খুলে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া এই ধরণের বহু ভৌতিক ঘটনার সাক্ষী এখানকার কর্মচারীরা। হয়তো তারা কিছু বলতে চায়, তাই বার বার তাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করে।

রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব

৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় জর্জ উইলিয়াম বলে এক ব্যক্তি ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নিজের টাকা লাগাতেন এবং প্রায় প্রতিটি দৌড়েই তার প্রিয় ঘোড়া পার্ল তাকে জয়ীর শিরোপা এনে দিত। এই কারণে পার্ল “দ্য কুইন অফ দ্য ট্র্যাকস” নামে খ্যাত ছিল। অ্যানুয়াল ক্যালকাটা ডার্বিতে পার্ল শেষবারের মতো অংশগ্রহণ করেছিল এবং বয়স জনিত কারণে সে সেই প্রতিযোগিতাটিতে হেরে যায় ফলে উইলিয়ামের প্রচুর টাকা নষ্ট হয়। পরের দিন সকালে পার্লকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কলকাতার রেল লাইনে পাওয়া যায়। আগেকার দিনে যখন কোনও ঘোড়া বয়স্ক বা অসুস্থ হয়ে যেত, তখন তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য হত্যা করার রীতি ছিল। আজও অনেকে গভীর রাতে বিশেষ করে শনিবারে একটি সাদা ঘোড়াকে টার্ফের ট্র্যাক দিয়ে সশব্দে ছুটে যেতে দেখে।

পুতুলবাড়ি

হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত পুতুলবাড়ি কলকাতার আরেকটি নামকরা হন্টেড প্লেস। রাতের বেলা বাইরে থেকেই বাড়িটিকে দেখলে আপনার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাবে। বাড়িটির বাইরের অংশটি দেখতে অনেকটা পরিত্যক্ত গুদামের মত।

এই বাড়িটি কেবল তার নানান ধরনের পুতুলের সংগ্রহের জন্যই নয় তার সাথে অলৌকিক কার্যকলাপের জন্যও পরিচিত। আগেকার দিনে ধনী বাবুরা নিজেদের বিলাসিতার জন্য এই বাড়িতে বহু নারীর উপর বিভিন্ন ভাবে শারীরিক অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন করতেন, আর এর প্রতিবাদ করার ফলস্বরূপ তাদেরকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। আজও রাতের অন্ধকারে সেই নারীদের হাতের চুরির ও পায়ের নূপুরের শব্দ শোনা যায়। আজও তারা চিৎকার করে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে চায়।

আকাশবাণী ভবন 

আকাশবাণী ভবনের পুরনো অফিস যেটি একসময় জনপ্রিয় একটি রেডিও স্টেশন ছিল এখন সেই জায়গাটি একাধিক অশরীরী আত্মার ঠিকানা। ব্রিটিশ আমলের তৈরি এই বিল্ডিংটিতে রয়েছে লম্বা করিডোর ও অজস্র স্টুডিও, সেই করিডোরের মধ্যে দিয়ে হেটে গেলে একটি গা ছমছমে অনুভূতি হয়। একথা শোনা যায় যে এখনও মধ্যরাত্রে একজন সাহেবের অশরীরী আত্মা ঘরের ফাইলপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, আবার কাউকে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় বসে গান শুনতেও দেখা যায়, আবার কখনও স্টুডিও থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন যান্ত্রিক সুর। এই ধরণের বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী গারস্টিন প্লেসের এই বিল্ডিংটি।

হাওড়া ব্রিজ

১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হাওড়া ব্রিজ কলকাতার একটি অন্যতম স্থাপত্য কলার নিদর্শন আর তার সাথে একটি বিখ্যাত হন্টেড প্লেস

বহু বার হয়তো বাসে বা ট্যাক্সি করে আপনি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে গেছেন। তারাও হয়তো আপনারই মতো কতবার এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছিল আর শেষে এই ব্রিজ থেকেই  ঝাঁপ দিয়ে মুক্তি নিয়েছিল জীবন থেকে। কিন্তু সত্যি কি তারা মুক্তি পেয়েছে? ভোর তিনটের সময় যে সমস্ত কুস্তিগিররা হুগলী নদীর ঘাটে অনুশীলন করতে আসেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নদী থেকে একটি হাত উঠে আসতে দেখেছেন, দেখে মনে হয় যেন সেই হাত তাদের থেকে সাহায্য চাইছে। আর যারা যারা সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেছেন তাদের মৃত দেহ পরে নদীতে পাওয়া গেছে। যদিও এই নিয়ে একটা ধোঁয়াশা থেকেই গেছে যে হাতগুলি সত্যিই কি কোন আত্মার, নাকি কোন মানুষ জলে ডুবে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বাঁচার শেষ আশা নিয়ে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার অনেকে একজন সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাকে কাঁদতে দেখেছেন এবং অদ্ভুত স্বরে তাদের নাম ধরে ডাকতেও শুনেছেন।

যদিও সময় বদলেছে, তার সাথে বদলেছে “কল্লোলিনী তিলোত্তমা“। হাই-রাইস বিল্ডিং আর শপিং মলের মাঝে কোথাও যেন তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে এসেছে। তাও তারা মাঝে মাঝে তাদের উপস্থিতির জানান দিয়ে যায় বিভিন্ন ভাবে।

আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন উঠে আসে, তবে বিজ্ঞানও আত্মার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করতে পারেনি। শক্তি অবিনশ্বর, শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, তাহলে একটি মানুষের মৃত্যুর পর কোথায় যায় তার ভেতরের সেই শক্তি? কি হয় মৃত্যুর পর?

উপরের সমস্ত জায়গাগুলির সাথে জড়িয়ে থাকা অলৌকিক ঘটনাগুলি লোকমুখে প্রচলিত। তাই এই ঘটনাগুলিকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা সম্পূর্ণ আপনার ওপর নির্ভর করছে। 

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from Kuntala's Travel Blog

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading