কলকাতার ১০টি বিশিষ্ট “উইকএন্ড গেটওয়ে”

মাঝে মধ্যে প্রত্যেক ভ্রমণবিলাসী বাঙালিরই মন চায় একঘেয়েমি কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একটু ছুটি নিতে। কিন্তু এতো সময় কোথায়? বর্তমান যুগে সময়ের বড়ই অভাব। তবে কলকাতার আশেপাশে এমন অনেক জায়গা আছে যা আপনাদের এই সমস্যার সমাধান করে দেবে। আপনি আপনার উইকএন্ডগুলিকে করে তুলতে পারেন অন্য চার পাঁচটা দিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

আজকে এই রকমই ১০টি “উইকএন্ড গেটওয়ে” ও সেই জায়গাগুলির বিবরণ রইল আপনাদের জন্য।

বরন্তী

সমস্ত প্রকৃতি প্রেমী বাঙালিদের জন্য বরন্তী একটি আদর্শ “উইকএন্ড গেটওয়ে“। এই জায়গাটি পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত। এখানকার সবুজে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার চোখে এক আলাদাই প্রশান্তি এনে দেবে। বিহারীনাথ ও পঞ্চকোট পাহাড় এই জায়গাটিকে দুদিক দিয়ে বেষ্টন করে রেখেছে। এছাড়া আপনি বরন্তী থেকে রওনা দিতে পারেন অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।

সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য বরন্তীর মুরুদি হ্রদ আদর্শ একটি জায়গা

হাওড়া স্টেশন থেকে আসানসোলগামী ট্রেন ধরে আসানসোলে নেমে সেখান থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার গাড়ি করে গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন বরন্তী।

বাগুরান

দীঘা, মন্দারমণি তো অনেকবার গেছেন, এবার ঘুরে আসুন এই অফবিট জায়গাটি থেকে। পূর্ব মেদিনীপুরের কন্টাই মহকুমার অন্তর্গত এই সমুদ্র সৈকতটি আপনার মনে এনে দেবে এক শান্ত অনুভূতি। চারিদিকে ঝাউগাছে ঘেরা এই নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতটিতে উইকএন্ডের দুটো দিন আপনি অনায়াসেই কাটিয়ে আসতে পারেন।

আর সমুদ্র মানেই ভোজন রসিক বাঙালি যা বোঝে তা হল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক মাছ। এখানকার প্রতিটি রেস্তোরাঁয় আপনি পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের এই খাবারগুলি।

কলকাতা শহর থেকে মাত্র ৪ ঘণ্টা লাগে এই জায়গাটিতে পৌঁছাতে। হাওড়া স্টেশন থেকে কাঁথিগামী ট্রেন ধরে পৌঁছে যেতে হবে কাঁথি স্টেশনে, তারপর ওখান থেকে অটো বা গাড়ি করে সোজা পৌঁছে যাবেন বাগুরান।

মৌসুনি আইল্যান্ড

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নামখানার অন্তর্গত মৌসুনি আইল্যান্ড বর্তমানে বাঙালিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি “উইকএন্ড গেটওয়ে“। যারা ঘুরতে গিয়ে ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তারা অবশ্যই এই জায়গাটি থেকে একবার হলেও ঘুরে আসুন। তাছাড়া আপনি চাইলে কটেজও ভাড়া নিতে পারেন। এখানে প্রতিটি হোটেলে ক্যাম্প ফায়ার ও বারবিকিউ করার সুব্যবস্থা আছে। সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে দুপুরের খাওয়া, ইভনিং স্ন্যাক্স এবং রাতের খাওয়া সবই পেয়ে যাবেন এই হোটেলগুলিতে।

শিয়ালদা থেকে ট্রেন অথবা ধর্মতলা থেকে বাস ধরে আপনাকে প্রথমে নামখানায় আসতে হবে, সেখান থেকে টাটা ম্যাজিক করে হুজ্জুতি ঘাট আর তারপর নৌকা করে চেনাই নদী পেরিয়ে বাগডাঙ্গা, এরপর একটা টোটো ধরলেই আপনি পৌঁছে যাবেন ক্যাম্পে।  

মুর্শিদাবাদ

স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদের সাথে জুড়ে আছে বহু ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস সম্বন্ধে যদি আপনি জানতে চান তো আর দেরি না করে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিন। মুর্শিদাবাদের নবাব ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, আর তাঁর নামেই এই জায়গার নামকরণ হয় মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদের দর্শনীয় স্থানগুলি হল- হাজারদুয়ারি প্যালেস, খোশবাগ, বড়া ইমামবরা, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, নাসিপুর প্যালেস, কাঠগোলা বাগানবাড়ি ও কাশিমবাজার রাজবাড়ী।

কলকাতা থেকে ২০৪ কিলোমিটার দূরে এই ঐতিহাসিক স্থানটি অবস্থিত।

বাড়ির গৃহিণীদের জানিয়ে রাখি যে মুর্শিদাবাদে এলে এখানকার বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ সিল্ক কিনতে একদমই ভুলবেন না। 

শিয়ালদা স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে বা লালগোলা প্যাসেঞ্জারে করে আপনি পৌঁছে যাবেন মুর্শিদাবাদে, এছাড়া বাসে করে বহরমপুর এসে সেখান থেকে গাড়ি করেও আপনি যেতে পারেন।

মায়াপুর

ধার্মিক বাঙালিদের কাছে নদীয়া জেলার মায়াপুরের ইসকন মন্দির অত্যন্ত প্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান। এই মন্দিরের ভোরবেলার মঙ্গল আরতি আর সন্ধেবেলার সন্ধ্যা আরতি একটি প্রাত্যহিক ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। এখানে প্রতিদিনই আগত ভক্তদের জন্য অন্নভোগ বানানো হয়, সেই অন্নভোগ যদি আপনি খেতে চান তাহলে আপনাকে মন্দিরের কাউন্টার থেকে একটি কুপন সংগ্রহ করতে হবে।

মায়াপুরে যাওয়ার জন্য শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার ইসকন কলকাতার বাস ছাড়ে, তাছাড়া হাওড়া থেকে গেলে কাটোয়া লোকাল ধরে আপনাকে নামতে হবে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট স্টেশনে, তারপর সেখান থেকে রিকশা করে চলে যেতে হবে গঙ্গার ঘাটে। নদী পার করে মায়াপুর ঘাটে নেমে দশ মিনিটের হাঁটা পথে মায়াপুরের ইসকন মন্দিরটি অবস্থিত। যদি আপনি শিয়ালদা থেকে যাত্রা করেন, তাহলে কৃষ্ণনগরগামী ট্রেন ধরে কৃষ্ণনগরে নেমে তারপর বাস ধরে চলে আসুন নবদ্বীপ ঘাটে। সেখান থেকে খেয়া পার হলেই মায়াপুর ঘাট, তারপর হেঁটে বা রিকশা করে পৌঁছে যান মায়াপুরের ইসকন মন্দিরে।

বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে যেকোনো উইকএন্ডে চলে আসুন ইসকনের এই মন্দিরটি দর্শন করতে।

সুন্দরবন  

সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, যদিও বাঘ মামার দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, বাঁদর, সাপ সহ নানান প্রজাতির প্রাণী এই অরণ্যে বসবাস করে।

এখানে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প, পাখিরালয়, সোজনেখালি ওয়াচ টাওয়ার, মিউজিয়াম, কচ্ছপ পুকুর, কুমীর পুকুর, গাজিখালি, পিরখালি, পঞ্চমুখানি সহ আরও অনেক দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে।

একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইলে কোন হোটেলে না থেকে একটি হাউসবোট ভাড়া করে আপনি নদী ও অরণ্যের রাতের সৌন্দর্যকেও অনেক কাছ থেকে উপভোগ করতে পারেন। আর তার সাথে পূর্ণিমার চাঁদের আলো যোগ হলে সেই সৌন্দর্য এক আলাদাই মাত্রা পায়। 

শীতকালের শুরুর দিকে আপনি সেরে আসতে পারেন সুন্দরবনের ঝটিকা সফরটি। 

শিয়ালদা স্টেশন থেকে ক্যানিংগামী ট্রেনে করে প্রথমে চলে আসতে হবে ক্যানিং এ, তারপর ওখান থেকে টোটো বা অটো করে গদখালি এসে সেখান থেকে লঞ্চ ধরে পৌঁছে যাবেন সুন্দরবন। তাছাড়া  এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে করেও গদখালি অবধি আসতে পারেন।

আর আপনি যদি চান তো কলকাতা থেকে সরাসরি ক্রুজে করে গঙ্গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যেতে পারেন সুন্দরবনে।

রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চাইলে আপনি সুন্দরবনকে বেছে নিতে পারেন আপনার “উইকএন্ড গেটওয়ে” হিসেবে।

শান্তিনিকেতন

শান্তিনিকেতন নামটি শুনলে যে গানটি মন গুনগুন করে গেয়ে ওঠে সেটি হল – গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আ-মা-র মন ভুলায় রে। বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শান্তির নীড়টি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশ বিদেশ থেকে বহু ছাত্রছাত্রী এখানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করার জন্য আসে।

এই জায়গাটিতে আপনি একই সাথে দেখতে পাবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্প সাহিত্যের অপরূপ  মেলবন্ধন। এখানে অনেক ছোট বড় কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে যা পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম একটি কারণ। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ও বসন্ত উৎসব পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্বে  বিখ্যাত।  

হাওড়া স্টেশন থেকে বোলপুরগামী যেকোনো ট্রেন ধরে বোলপুরে নেমে সেখান থেকে টোটো বা রিকশায় ১০-১৫ মিনিট লাগে শান্তিনিকেতনে পৌঁছাতে। এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে করেও আপনি চলে যেতে পারেন এই জায়গাটিতে।

দারিংবাড়ি

শৈল শহর দারিংবাড়ি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশাতে অবস্থিত। এই জায়গাটি “ওড়িশার কাশ্মীর” নামে খ্যাত। রেকর্ড অনুযায়ী এখনও অবধি শীতকালে এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -০.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। জায়গাটিতে কোথাও রয়েছে পাইন জঙ্গল, কোথাও ঘন শালবন, কোথাও একটানা অনেকটা জায়গা জুড়ে দেখতে পাবেন কফি বা গোলমরিচের বাগিচা।

হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে চেন্নাই বা বিশাখাপত্তনমগামী ট্রেন ধরে পৌঁছে যাবেন ব্রহ্মপুর। তারপর গাড়ি পথে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্যে।  

কলকাতার তীব্র দাবদাহ থেকে অল্প কয়েক দিনের জন্য মুক্তি পেতে চলে আসুন এই মনোরম জায়গাটিতে।

কিরিবুরু ও মেঘাতুবুরু

এই টুইন সিটি দুটি ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তের কাছে একে ওপরের থেকে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে  অবস্থিত। “সেল” এর অধীনস্থ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ শৈল শহর দুটির মনোরম পরিবেশ, জলপ্রপাত, পাহাড় ও জঙ্গল পর্যটকদের আকর্ষণের প্রধান কারণ। আপনি কিরিবুরু ভিউপয়েন্ট থেকে এখানকার পাহাড় এবং উপত্যকা অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এই দুটি শহরের মধ্যে যেকোনো একটিতে থেকে বাকি জায়গাগুলি আপনি অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন। 

হাওড়া থেকে টাটানগরগামী ট্রেন ধরে টাটানগরে নেমে সেখান থেকে বাসে করে সরাসরি পৌঁছে যাবেন কিরিবুরু।

পাত্রাতু ভ্যালি

উইকএন্ড গেটওয়ে” হিসেবে এই জায়গাটি কিন্তু মন্দ নয়। রাঁচি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাত্রাতু ভ্যালি। এই উপত্যকা অঞ্চলের রাস্তাটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বহু দূর অবধি উঠে গেছে, গহীন বন, ঘন সবুজে কোথাও এতটুকু ফাঁকা নেই। এখানকার পাত্রাতু লেকে শিকারা করে নৌকা বিহারের আনন্দ উপভোগ করতে একদমই ভুলবেন না, তাছাড়া শীতকালে এই লেকে নানান ধরণের পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। পালানী জলপ্রপাত এখানকার আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান।

হাওড়া স্টেশন থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস করে আপনি সরাসরি পৌঁছে যেতে পারবেন পাত্রাতু ভ্যালিতে।  

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সব কিছুর ছোঁয়াই আপনি পেয়ে যাবেন উপরের উল্লিখিত জায়গাগুলিতে। এই ১০টি উইকএন্ড গেটওয়ের মধ্যে আপনার পছন্দের জায়গাটি বেছে নিন এবং আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষ দিনগুলিকে চুটিয়ে উপভোগ করার জন্য।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

One thought on “কলকাতার ১০টি বিশিষ্ট “উইকএন্ড গেটওয়ে”

  • July 21, 2022 at 6:29 pm
    Permalink

    bhalolaglo….notun kichu jaygar bapare janlam

    Reply

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: