অক্ষয় তৃতীয়া ২০২৩
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের পরেই যে পার্বণে মেতে ওঠে গোটা বাংলা সেটি হল অক্ষয় তৃতীয়া। তবে এই উৎসব শুধু বঙ্গেই নয় সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দুদের কাছে এটি একটি ধার্মিক ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। হিন্দু ধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও এই তিথিটিকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করেন। অক্ষয় তৃতীয়া বহু জায়গায় ‘আখা তিজ' নামেও পরিচিত। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া অর্থাৎ শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। এই বছর ইংরেজির ২২শে এপ্রিল (বাংলার ৮ বৈশাখ) অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ তিথি পড়েছে এবং এই তিথি ২৩শে এপ্রিল অবধি থাকবে।
আজকে আমার প্রবন্ধে এই বিশেষ তিথিকে কেন্দ্র করে কিছু পৌরাণিক কাহিনী ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে আলোচনা করব।
অক্ষয় তৃতীয়ার তাৎপর্য
সংস্কৃত ‘অক্ষয়' শব্দের অর্থ ‘যার কোনো ক্ষয় নেই'। তাই মনে করা হয় অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে কোনো শুভ কাজ সম্পন্ন করলে সেই কাজের আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। হিন্দু শাস্ত্রমতে পুণ্য এই তিথিকে সুখ প্রদানকারী ও পাপ নাশকারী তিথি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই দিনে যে যে শুভ কাজগুলি করা হয়
এই দিনটি নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য অত্যন্ত শুভ।
মনে করা হয় এই বিশেষ দিনে সোনা, রুপা বা কোনো জিনিসপত্র কিনলে তা পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও আপনার নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশ বা নতুন গাড়ি কেনার জন্য এই দিনটি খুবই শুভ।
এই শুভ দিনটিতে বিবাহ করলে দম্পতিদের জীবনে সর্বদা সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।
পয়লা বৈশাখের মতোই অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিতে লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা করা হয় এবং নতুন হিসাবের খাতা অর্থাৎ হালখাতা তৈরি হয়।
হিন্দু গৃহস্থেও এই দিনে পূজা পার্বণ করা হয়। এছাড়াও অক্ষয় তৃতীয়ার এই বিশেষ দিনে মন্দিরে মন্দিরে ভক্তদের সমাগম ঘটে।সব মিলিয়ে বাঙালি তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল মানুষের কাছে এই তিথির এক বিশেষ গুরুত্ব আছে।
অক্ষয় তৃতীয়াকে ঘিরে কিছু পৌরাণিক কাহিনী
আমাদের কাছে অক্ষয় তৃতীয়া মানেই শুধুমাত্র হালখাতা আর মিষ্টির প্যাকেট। কিন্তু এই বিশেষ দিনটির সাথে যে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী, তা হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। চলুন তাহলে আজকে অক্ষয় তৃতীয়ার এই বিশেষ দিনে ঘটে যাওয়া কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
- আমরা সকলেই জানি কুবের হলেন ধনসম্পদের দেবতা। কিন্তু কিভাবে তিনি হয়ে উঠলেন ধনাধ্যক্ষ সেই কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রইল এখানে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দেবাদিদেব মহাদেব কুবেরের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে অতুল সম্পদ ও ঐশ্বর্য প্রদান করেছিলেন। এই দিনে যেহেতু কুবের এই অতুল ধনসম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন, তাই এই বিশেষ দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কুবের ও ধনলক্ষ্মীর আরাধনা করেন। বিশ্বাসানুসারে এই দিনে এনাদের পূজা করলে সংসারে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।
- পুরাণ অনুযায়ী দ্বাপর যুগে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন বিষ্ণুর নবম অবতার শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের পরম বন্ধু ছিলেন সুদামা নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। সুদামা একদিন ভুলবশত শ্রীকৃষ্ণের সব খাবার খেয়ে নিয়েছিলেন। যখন তিনি এটা বুঝতে পারেন যে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সব খাবার ভুল করে খেয়ে নিয়েছেন, তখন তিনি তার পরিবর্তে এক মুঠো চাল নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ঘরে আসেন। সুদামার এরূপ আচরণে মুগ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে আশীর্বাদ দেন এবং তাঁর সমস্ত দারিদ্র্য চিরকালের জন্য দূর হয়ে যায়। পুরাণ মতে এই ঘটনাটি যেদিন ঘটেছিল সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথি।
- মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের পাশা খেলার কাহিনী সম্বন্ধে আমরা সকলেই অবগত। এই পাশা খেলায় কৌরবদের কাছে পাণ্ডবরা হেরে যাওয়ায় পাণ্ডবদের বারো বছরের জন্য বনবাস এবং এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে যেতে হয়েছিল। যদিও এখানেই কৌরবদের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। বনবাসে থাকাকালীন কৌরবদের চক্রান্তে মুনি দুর্বাসা তাঁর শিষ্যদের সহিত এক রাতে পাণ্ডবদের কাছে উপস্থিত হন। সেই সময় মুনি দুর্বাসা খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য পাণ্ডবদের কাছে কোনো অন্ন ছিল না। এমতাবস্থায় ক্ষুধার্ত দুর্বাসা মুনির অভিশাপের হাত থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ সেই সময় হাঁড়ির তলায় লেগে থাকা একটি মাত্র চালের দানা অন্ন হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে দুর্বাসা মুনি সহ তাঁর সকল শিষ্যদের ক্ষুধা মিটে যায়। এই ঘটনাটিও ঘটে অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে।
- অক্ষয় তৃতীয়ার এই বিশেষ দিনেই মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম।
- অক্ষয় তৃতীয়া তিথি সিদ্ধিদাতা গণেশেরও জন্মতিথি, তাই এই দিনে গণেশ পূজা করে যেকোনো শুভ কাজের সূচনা করলে তার আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।
- এছাড়াও এই তিথিতেই বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে গণেশ মহাভারত রচনা শুরু করেছিলেন।
- অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই সত্যযুগ সমাপ্ত হয়ে ত্রেতা যুগের সূচনা হয়।
- এই দিনেই রাজা ভগীরথের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শ্রী শ্রী গঙ্গা দেবী মর্ত্যে অবতরণ করেন।
- কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী মন্দিরের দরজা টানা ছয় মাস বন্ধ থাকার পর অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনেই সেই দরজা খোলা হয়। আশ্চর্য করার বিষয় হল এই যে, এই মন্দিরে ছয় মাস আগে জ্বালিয়ে রাখা অক্ষয়দ্বীপ তখনও একইভাবে জ্বলতে দেখা যায়।
- এই বিশেষ তিথিতে পুরীধামে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে জগন্নাথ দেবের নতুন রথ নির্মাণের কাজও শুরু হয়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী উল্লিখিত সমস্ত ঘটনা অক্ষয় তৃতীয়ার এই বিশেষ তিথিতে ঘটেছিল বলে এই দিনটিকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এই দিনে সম্পন্ন প্রতিটি শুভকার্য তাই অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে।
আমার সকল পাঠক পাঠিকাকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়ার হার্দিক শুভেচ্ছা। এই অক্ষয় তৃতীয়ায় সকলের জীবন সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভোরে উঠুক, দূর হয়ে যাক সকল নৈরাশ্য ও গ্লানি।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.