বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাহেশের রথযাত্রা উৎসবের ইতিহাস
বর্ষার মরসুমে যে উৎসবটি আমাদের মনে আনন্দের শিহরণ জাগিয়ে তোলে, পাঁপড় ভাজা আর রসালো জিলিপি ছাড়া যে উৎসবটি কোথাও যেন অসম্পূ্র্ণ থেকে যায়।যে উৎসবটিকে ঘিরে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “রাধারাণী”র প্রেক্ষাপট লিখেছিলেন,সেই রথযাত্রা উৎসবের জন্য নয় থেকে নব্বই সকলেই সারা বছর অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। ভ্রমণ বিলাসী বাঙালির অধিকাংশই রথযাত্রার পুণ্য তিথিতে পুরীকেই নিজের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু যাদের সময় বা সাধ্য কোনটাই হয়ে ওঠে না, অথচ প্রভুর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে; তাদের জন্য রয়েছে মাহেশের রথযাত্রা উৎসব।
মাহেশের রথযাত্রা বাংলার প্রাচীনতম ও ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। ৬২৬ বছর পুরানো এই বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন ও সুদীর্ঘ ইতিহাস। আসুন, আজ সেই ইতিহাসের কিছু পাতা ঘেঁটে দেখা যাক।
বিগ্রহ ও মন্দির প্রতিষ্ঠার সুপ্রাচীন ইতিহাস
মাহেশের রথের ইতিহাসের পাতায় প্রথমেই উঠে আসে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর নাম, যিনি চতুর্দশ শতকে জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবার মনোবাসনা নিয়ে তীর্থ ভ্রমণের জন্য পুরীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁর সেই ইচ্ছা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। হতাশাগ্রস্ত ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী আমরণ অনশনে বসেন। কিন্তু ভক্তের এই কষ্ট কি ভাবে ভগবান সহ্য করতে পারেন, তিন দিন পর জগন্নাথদেবের কৃপা-দৃষ্টি পড়ে তাঁর উপর। তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে তিনি যেন বঙ্গদেশে ফিরে যান এবং সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামক গ্রামে জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। স্বপ্নাদেশে এও উল্লেখ ছিল যে জগন্নাথদেব একটি বিশালাকার দারুব্রহ্ম অর্থাৎ নিম কাঠ পাঠাবেন যা দিয়ে বলরাম, সুভদ্রা এবং তাঁর মূর্তি বানাতে হবে এবং তিনি সেখানে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর হাতে ভোগ খাওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করেন।
ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী তাঁর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী বঙ্গে ফিরে আসেন এবং সাধনায় লিপ্ত হন। এক প্রবল বর্ষণের দিনে মাহেশের ঘাটে ভেসে আসে সেই নিম কাঠ যা দিয়ে তৈরি হয় তিন দেব দেবীর বিগ্রহ এবং এক কুটিরে সেই বিগ্রহগুলি তিনি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।সেই প্রাচীন মন্দিরটি গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ১৭৫৫ সালে কলকাতার বড়বাজার নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক বর্তমান মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করেছিলেন।
“নব নীলাচল” নামকরণের ইতিহাস
শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করার পর পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন,পথে মাহেশের মন্দির দর্শনের জন্য আসেন এবং মন্দির পরিদর্শনের পর তিনি তাঁর জ্ঞান হারান এবং গভীর সমাধিতে চলে যান। পরে তিনি মাহেশের নতুন নামকরণ করেন “নব নীলাচল”, যার অর্থ “নতুন পুরী”।
ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী শ্রীচৈতন্যদেবকে মন্দিরের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান। তখন শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর এক প্রিয় শিষ্য কমলাকর পিপলাইকে এই মন্দিরের দায়িত্ব বহনের আদেশ দেন এবং মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে কমলাকর পিপলাই সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন । ১৩৯৬ সালে তিনিই এই ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেন।এখনো তাঁর বংশধরেরাই মন্দিরের সেবাইত হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
রথের ইতিহাস
রথ তৈরির ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে জানা যায় মাহেশের প্রথম রথটি দান করেন এক জনৈক মোদক।তারপর ১৭৫৪ সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিষ্য কলকাতার শ্যামবাজার নিবাসী কৃষ্ণরাম বসু পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট কাঠের একটি রথ তৈরি করে দেন এবং তার সাথে তিনি মাহেশের জগন্নাথ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি পর্যন্ত দেড় মাইল সুপ্রশস্ত পাকা রাস্তাও বানিয়ে দেন, যাতে রথ চলাচলের কোনও রকম অসুবিধা না হয়। সেই রথটি বহু বছর পর কালের নিয়মে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণরাম বসুর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ বসু ১৭৯৮ সালে একটি নবচূর রথ তৈরি করে দেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিনে বল্লভপুরে গন্ডিচাবাটিতে আগুন লেগে সেই রথটি পুড়ে যায়।
বর্তমান রথের নির্মাণের ইতিহাস ও বর্ণনা
বর্তমানে যে লোহার রথটি আমরা দেখতে পাই, সেটি গুরুপ্রসাদ বসুর নির্মিত কাঠের রথটি পুড়ে যাওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৫ সালে বসু পরিবারের কর্তা কৃষ্ণচন্দ্র বসু নির্মাণ করিয়ে দেন।
তৎকালীন অন্যতম নির্মাণ-স্থপতি সংস্থা মার্টিন বার্ন কোম্পানির দ্বারা এই রথটি নির্মিত হয় এবং এই রথের নকশার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী নীলমণি মিত্র। সেই সময় প্রায় ২০ লক্ষ্য টাকা ব্যয় করে এই রথটি নির্মাণ করা হয়। ৫০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ১২৫ টন ওজনের এই লোহার রথটি ১২ টি লোহার চাকা দ্বারা চালিত হয় এবং প্রতিটি চাকার বেড় ১ ফুট। এই চারতলা রথের প্রথম তলে চৈতন্য লীলা, দ্বিতীয় তলে কৃষ্ণ লীলা এবং তৃতীয় তলে রাম লীলার মনোরম চিত্র অঙ্কিত আছে। সবার উপরে চতুর্থ তলে বিগ্রহ বসানো হয়। রথের সামনে দুটি তামার ঘোড়া লাগানো আছে এবং তাতে একটি কাঠের তৈরি সারথি আছে।১৮৮৫ সাল থেকে সুদীর্ঘ ১৩৭ বছর ধরে একই ভাবে এই রথ চলে চলেছে।এই ভাবে বংশানুক্রমে বসু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা রথ তৈরির দায়িত্ব বহন করে এসেছেন।
রথযাত্রার সুপ্রাচীন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান
চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী, প্রতি বছর স্নানযাত্রার দিনে জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রার প্রাচীন মূর্তি গুলিকে ২৮ ঘড়া পবিত্র গঙ্গাজল ও দু'মণ দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। এর ফলে তিনজনই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন এবং প্রথা অনুযায়ী আজও আরামবাগ, গোঘাট এবং ঘাটাল থেকে তিনজন কবিরাজকে নিয়ে আসা হয় তাদের শুশ্রূষা করার জন্য। তিন কবিরাজ তাদের জন্য পাঁচন তৈরি করে দেন এবং সেই পাঁচনের গুনেই তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন।স্নানযাত্রার কিছু দিন পরে পালিত হয় অঙ্গরাজ উৎসব যখন বিগ্রহগুলিকে নতুন করে রং করা হয় এবং এরপরে পালিত হয় নবযৌবন উৎসব।রথযাত্রার এক দিন পূর্বে রাজা হিসাবে অভিষেক হয় জগন্নাথদেবের। সোজা রথের দিন জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা রথে চড়ে স্নানপিড়ি ময়দানের সামনে থেকে যাত্রা শুরু করেন গন্ডিচাবাটির উদ্দেশ্যে, যা মাসির বাড়ি নামে খ্যাত।
মাসির বাড়ি নামটি থেকে অনেকেরই এই ভুল ধারণা হতে পারে যে এটি জগন্নাথদেবের মায়ের বোনের বাড়ি, কিন্তু মাসি কথাটি এসেছে জগন্নাথদেবের সখী পৌর্ণমাসির নাম থেকে। জগন্নাথদেব বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে তাঁর সখী পৌর্ণমাসির বাটীতে যান। অসংখ্য ভক্তগণ নগ্নপদে রথের রশি টেনে তাঁদেরকে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। মাসির বাড়ির মন্দিরটি আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর পূর্বে পাথুরিয়াঘাটার বাসিন্দা মতিলাল মল্লিকের স্ত্রী রঙ্গমণি দাসী নির্মাণ করেন। কাঁসর, ঘণ্টা বাজিয়ে সাড়ম্বরে এই রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং টান থামানোর জন্য বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়। সোজা রথের ন'দিনের মাথায় পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ পালিত হয়, সেই দিন জগন্নাথদেব বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে তাঁর সখীর বাটী থেকে ওই একই পথ ধরে স্নানপিড়ি ময়দানে পুনরায় ফিরে আসেন।
জগন্নাথদেবের ভোগের আয়োজন
জগন্নাথদেবের জন্য যে ভোগ বানানো হয় তাতে কোনও লবণ ব্যবহার করা হয় না, তার পরিবর্তে সৈন্ধব লবণের ব্যবহার হয়। সাধারণত জগন্নাথদেবকে যে ভোগ নিবেদন করা হয় তার মধ্যে থাকে – খিচুড়ি ভোগ,সাদা ভোগ, অড়হর ডাল, বিভিন্ন রকমের ভাজা, শাক, আলুর দম, মিষ্টান্ন, চাটনি, মিষ্টি ইত্যাদি। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিনে তাঁকে এই পদ গুলির সাথে আরও কিছু বিশেষ বিশেষ পদ নিবেদন করা হয়, তারমধ্যে মালপোয়া অন্যতম, কারণ সেটি জগন্নাথদেবের খুবই পছন্দের একটি খাবার।
রথের মেলার বিবরণ
এই রথযাত্রা উৎসবের মূল আকর্ষণ রথের মেলা। যদিও এখন এই মেলার জৌলুস অনেকটাই কমে গেছে, কিন্তু পূর্বে বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ থেকে অসংখ্য মানুষ জিনিস পত্র কেনা কাটা করতে আসতেন এই মেলায়। এখনও জিটি রোডের দু'ধার দিয়ে এক মাসব্যাপী রথের মেলা বসে এবং সেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে মাটির পুতুল, রংবেরঙের চুরি, জিভে জল এনে দেওয়া খাবার কি না পাওয়া যায়, তাছাড়া ছোটদের জন্য রয়েছে নাগরদোলা সহ বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।রথযাত্রার এই পুণ্য তিথিতে সকল জনসাধারণকে বিগ্রহগুলি স্পর্শ করার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সকলেই বিগ্রহগুলিতে ফুল,মালা নিবেদন করে তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য প্রার্থনা জানান।
মাহেশের রথযাত্রার সুপ্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। কোনটি সঠিক তথ্য এবং কোনটি লোক মুখে প্রচলিত তা নিয়ে একটি ধন্ধ সব সময়ই থেকে যাবে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
omg take me there now…These pictures are stunning stunning…So many things to explore and see…
The photographs are wonderful. I love anything cultural and colourful and this shows both to the extreme!
This is such a lovely place. I would love to visit with my family!
What an interesting and lovely place! Thank you so much for sharing.
Pingback: বাংলার ১৬টি ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প - Kuntala's Travel Blog