বাংলার ১৬টি ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত। কোথাও মাটির পুতুল তো কোথাও তাঁত, আবার কোথাও পাবেন মাদুর তো কোথাও শাঁখের তৈরি জিনিস। এছাড়াও আরও অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে বাংলার আনাচে কানাচে। আজ সেই সমস্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প এবং কোথায় এই শিল্পগুলি গড়ে উঠেছে সেই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
টেরাকোটা শিল্প
টেরাকোটা কথার অর্থ হল “পোড়া মাটি”। আর এই টেরাকোটা মানেই আমরা যা বুঝি তা হল বিখ্যাত বাঁকুড়ার ঘোড়া। এই ঘোড়াগুলি একাধিক অংশে বিভক্ত থাকে, যেগুলিকে একত্রিত করলে আপনি একটি সম্পূর্ণ ঘোড়ার কাঠামো পাবেন। তাছাড়া এখানকার বোঙা হাতি টেরাকোটা শিল্পের আরও একটি অন্যতম নিদর্শন। বর্তমানে বাড়ির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য টেরাকোটার টাইলের ব্যবহার চোখে পরার মত। মূলত বিষ্ণুপুর এবং পাঁচমুড়া গ্রামের দক্ষ শিল্পীরা এই শিল্পদ্রব্যগুলি তৈরি করে থাকেন। বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্প পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে।
ডোকরা শিল্প
ডোকরা প্রায় ৪০০০ বছর পুরনো একটি প্রাচীন শিল্পকর্ম। মহেঞ্জোদারো শহরে সিন্ধু সভ্যতার সময়কালীন যে ড্যান্সিং গার্লের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল তা ডোকরা শিল্পের অন্যতম একটি নিদর্শন। নানা ধরনের ধাতব অলংকার, দেব দেবীর মূর্তি, ঘর সাজাবার জিনিস “হারানো মোম ঢালাই” পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিটি ধাতব ঢালাইয়ের প্রাচীনতম পদ্ধতি। বাঁকুড়া জেলার বিকনা গ্রাম এই প্রাচীন শিল্পকর্মটির জন্য বিখ্যাত, যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
বালুচরী শাড়ি
পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ির নাম কে না জানে। এই শাড়ির নকশাগুলি প্রাচীন মন্দিরের পোড়ামাটির টালির নকশার অনুকরণে তৈরি করা হয়। নকশাগুলি ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন তার মধ্যে চিত্রিত আছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী, উপজাতিদের জীবনযাত্রা ও বিভিন্ন সামাজিক জীবনযাত্রার ছবি।
বাঁকুড়া জেলা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ, আর তার মধ্যে বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস দেশ বিদেশের সংগ্রহশালায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। মল্ল রাজা বীর হাম্বি এই দশাবতার তাস খেলার প্রচলন শুরু করেন। মোট ১২০টি তাস লাগে এই খেলায়, তার মধ্যে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের দশটি তাসের প্রতিটির অধীনে মোট ১২টি তাস থাকে। এই তাসগুলি কাপড়, তেঁতুল বীজের আঠা, খড়ি ধুলা, রঙ, সিঁদুর এবং লাক্ষা দিয়ে তৈরি করা হয়। বর্তমানে এখানকার ফৌজদার পরিবার এই শিল্পকর্মটির ঐতিহ্যকে এখনও বহন করে চলেছে।
লন্ঠন শিল্প
বৈদ্যুতিক এলইডি বাল্বের যুগে যদিও লন্ঠনের ব্যবহার নেই বললেই চলে, তাও এখনও এই লন্ঠনগুলি পাঁচ তারা হোটেল ও বড় বড় অফিসের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী এই লন্ঠন শিল্প বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপনি এই লণ্ঠনগুলি ক্রয় করে আপনার ড্রয়িংরুমের শোভা বাড়াতে পারেন বা আপনার প্রিয় কাউকে উপহার হিসেবেও দিতে পারেন।
শঙ্খ শিল্প
বাংলার প্রাচীন শিল্পকলাগুলির মধ্যে শঙ্খ শিল্প অন্যতম আর এই বিখ্যাত শিল্পকর্মের আবাস হল বাঁকুড়া জেলার হাটগ্রাম। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পীদের হাতের তৈরি শঙ্খের মধ্যে পৌরাণিক দেব দেবীর সূক্ষ্ম নকশার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এখানকার শাঁখারিরা বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের জন্য কারুকার্য করা শাঁখা থেকে শুরু করে বাদ্য শাঁখ, ধূপদানী, কাজলদানী , বিভিন্ন অলংকার, ঘর সাজাবার জিনিস সহ আরও অনেক প্রকার শঙ্খজাত পণ্য তৈরি করেন।
রেশম শিল্প
মোঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় রেশম শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই রেশম শিল্পের জন্য মুর্শিদাবাদ পূর্ব ভারতের “সিল্ক মক্কা' নামে খ্যাতি অর্জন করেছে। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ সিল্কের চাহিদা ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্বে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই রেশমের শাড়িগুলি এতটাই হালকা ও কোমল যে আপনি একবার এই শাড়ি পড়লে আর অন্য কোনও শাড়ি পড়ার কথা ভাববেনই না।
মাদুর শিল্প
মাদুর শিল্প একটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প আর পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এই শিল্পের আঁতুড় ঘর। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। শিল্পী শ্রীমতী গৌরীরানি জানা ও শ্রীমতী গৌরীবালা দাস তাদের নিপুণ শিল্পকর্মের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। তারা মাদুরের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই শিল্পীদের হাত ধরেই বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। মাদুর শিল্প পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিও পেয়েছে।
পটচিত্র
পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পটচিত্র একটি প্রাচীনতম চিত্রকলা। সংস্কৃত পট্ট কথাটি থেকে পট শব্দটি এসেছে, যার অর্থ বস্ত্র। কাপড়ের উপরে একটি বিশেষ ধরনের আঁকা চিত্র বা চিত্রাবলীকে বলা হয় পটচিত্র, যেগুলি মূলত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে বানানো হয়ে থাকে। পটচিত্রের উপর ভিত্তি করে চালচিত্র, কালীঘাট পটচিত্র, পটুয়া সঙ্গীত, দূর্গাপট, লক্ষ্মী সরা প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের নয়াগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পটচিত্র গ্রাম যেখানে প্রতিটি ঘরের দেওয়ালে ও উঠোনে এই পটচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রামের পটুয়ারা বাংলার এই প্রাচীন শিল্পের ঐতিহ্যকে এখনও বহন করে চলেছে।
নকশি কাঁথা
বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প নকশি কাঁথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের লেখা “নকশি কাঁথার মাঠ” কবিতাটির কথা। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রথম শিল্প হল বীরভূমের নকশি কাঁথা। এখানকার দক্ষ শিল্পীদের হাতে তৈরি এই নকশি কাঁথাগুলিতে সূক্ষ্ম সুতোর কাজে নানা ধরনের ফুল-ফল, পশু-পাখি, সামাজিক জীবন যাত্রা, পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র ফুটে উঠেছে।
কুমারটুলির প্রতিমা
বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে কলকাতার কুমারটুলির প্রতিমার নাম দেশ বিদেশে ছড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কুমারটুলির প্রতিমা দক্ষ মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় এক অপূর্ব রূপ পেয়েছে। এখানকার তৈরি দেব দেবীর প্রতিমা শুধুমাত্র শহরের মণ্ডপগুলিতে বা ঘরোয়া পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে নানান দেশে এই প্রতিমা রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
তাঁত শিল্প
হস্তচালিত তাঁত শিল্প বা হ্যান্ডলুম মানেই বাংলার নদীয়া জেলার বিখ্যাত শান্তিপুর ও ফুলিয়ার তাঁতকে বোঝায়, আর তার সাথে হুগলী জেলার ধনেখালির তাঁতের খ্যাতিও কিছু কম নয়। শান্তিপুর ও ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কারুকার্য করা পাড়ের নকশা। নীলাম্বরী, গঙ্গা-যমুনা, রাজমহল, বৃন্দাবনী ময়ূর পাড় ও আরও নানান ধরনের পাড়ের শাড়ি এখানে বিখ্যাত। শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ঐতিহ্যবাহী ধনেখালির তাঁতের শাড়ির জমিন সাধারণত ধূসর রঙের হয় এবং পাড়গুলি সরু আর লাল বা কালো রঙের হয়। বিখ্যাত ধনেখালির তাঁতও পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
মাটির পুতুল
“পুতুল নেবে গো পুতুল” আর সেই পুতুল মানেই নদীয়া জেলার বিখ্যাত কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বেই এই মাটির পুতুলের ব্যাপক চাহিদা আছে। মূলত দেশের বাইরে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে কৃষ্ণনগর থেকে এই মাটির পুতুলগুলি রপ্তানি করা হয়। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণী অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা প্রধানত এই পুতুলগুলি তৈরি করে থাকেন।
পাট শিল্প
হুগলী নদীর দুই তীরে উত্তরে কল্যাণী-বাঁশবেড়িয়া থেকে দক্ষিণে বজবজ-উলুবেড়িয়া পর্যন্ত এলাকায় বেশিরভাগ পাটকলগুলি অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে কাঁচা পাট থেকে সুতো, দড়ি, কার্পেট, পাপোশ, ব্যাগ, ঘর সাজানোর জিনিস সহ আরও অনেক পাটজাত পণ্য তৈরি করা হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাহিদাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মুখোশ শিল্প
পশ্চিমবঙ্গের মুখোশের ব্যবহার মূলত এখানকার তিনটি লোকনৃত্যে হয়ে থাকে। সেইগুলি হল পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য, মালদার গম্ভীরা নৃত্য ও দিনাজপুরের গোমিরা নৃত্য।
ছৌ মুখোশ
ছৌ লোকনৃত্যে নৃত্য শিল্পীরা এই মুখোশ পরে অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করেন। এই মুখোশ বর্তমানে পুরুলিয়ার বিভিন্ন দোকানে পর্যটকদের জন্যও বিক্রি করা হয়। পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

গম্ভীরা মুখোশ
মালদা জেলার বিখ্যাত গম্ভীরা উৎসবে দলবদ্ধভাবে নৃত্য শিল্পীরা এই মুখোশ পরে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই মুখোশগুলি প্রধানত বিভিন্ন হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র যেমন কালী, নরসিংহী, চামুণ্ডা, মহিষাসুরমর্দিনী, লক্ষ্মী, সরস্বতীর আদলে তৈরি করা হয়।
কুশমন্ডি মুখোশ
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র কুশমন্ডি। এখানকার গোমিরা লোকনৃত্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের মুখোশগুলি গামারি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। কুশমন্ডির কাঠের মুখোশও পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাঁশ ও বেত শিল্প
গৃহস্থের বিভিন্ন ব্যবহারের জিনিস থেকে শুরু করে সাঙ্গীতিক যন্ত্রপাতি ও বাসস্থান নির্মাণের জন্য বাঁশের ব্যবহার করা হয়। ফুলের সাজি, লক্ষ্মীর হাঁড়ি, ট্রে, ব্যাগ, চটি, শীতল পাটি, মোড়া, দোলনা, আরাম কেদারা সহ বহু জিনিসে বেতের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা বাঁশ ও বেতের কাজের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে কোচবিহার জেলায় শীতল পাটির হাব তৈরি হয়েছে।
এই সমস্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্বের দরবারে পশ্চিমবঙ্গের নাম উজ্জ্বল করে রেখেছে। বর্তমানে এই শিল্পগুলির মধ্যে কিছু কিছু শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। বিদেশী ব্র্যান্ডেড জিনিসপত্রের প্রতি আমাদের যে ঝোঁক বেড়েছে তা কিছুটা হলেও এই শিল্পগুলিকে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম বাংলার দক্ষ শিল্পীদের হাতের তৈরি অসাধারণ শিল্পকর্মের সঠিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার আর এক্ষেত্রে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Thanks for sharing about Traditional Painting. Your content is realy informative for us……Thank a lot
very informative and well explained about Indian traditional paintings !
Good presentation
খুবই ভালো ভাবে তুলে ধরেছেন