কলকাতার ১৫টি হেরিটেজ তকমা পাওয়া ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান
খাবারের সাথে বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অপরূপ মেলবন্ধন রয়েছে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলির, তারমধ্যে কলকাতার ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজের তরফ থেকে ‘হেরিটেজ' তকমা দেওয়া হয়েছে। কলকাতার যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি ১৯৬০ সাল বা তারও আগে থেকে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে গেছে এবং এখনও মানুষের রসনা তৃপ্তির খেয়াল রেখে চলেছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে নীল রঙের এক বিশেষ ফলক দিয়ে এই সম্মান প্রদান করা হয়েছে। আজকে আমি আলোচনা করব সেই ১৫টি হেরিটেজ তকমা পাওয়া ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান সম্বন্ধে। চলুন তাহলে আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাসের কিছু কাহিনী।
ভীম চন্দ্র নাগ (১৮২৬)
মিষ্টির ইতিহাসের পাতায় কড়াপাকের মিষ্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভীম চন্দ্র নাগের নাম। বৌবাজারের এই মিষ্টির দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিখ্যাত ভীম চন্দ্র নাগের পিতা পরান চন্দ্র নাগ। পুত্রের নামেই তিনি এই দোকানের নামকরণ করেছিলেন।
১৮৫৬ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের স্ত্রী লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভীম নাগ তৈরি করেছিলেন একটি নতুন ভাজা মিষ্টি, যার স্বাদ লেডি ক্যানিং-এর মন জয় করে নিয়েছিল। তাঁকে সম্মান জানিয়ে ভীম নাগ এই মিষ্টির নাম রেখেছিলেন “লেডি ক্যানিং”, যা বর্তমানে লেডিকেনি নামে বিখ্যাত।
এই দোকান থেকেই নাকি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের উদ্বোধনের দিন নৌকা পথে পাঠানো হয়েছিল মণ মণ মিষ্টি। এই রকমই আরও বহু ইতিহাসের কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে এই শতাব্দী প্রাচীন দোকানটির সাথে। এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান রকমারি সাবেকি মিষ্টির সাথে সাথে নতুন ধরণের বিভিন্ন মিষ্টির স্বাদও আমাদের উপহার দিয়েছে।
গিরিশ চন্দ্র দে ও নকুর চন্দ্র নন্দী (১৮৪৪)
গিরিশ চন্দ্র দে এবং তাঁর জামাতা নকুর চন্দ্র নন্দী এই মিষ্টির দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানকার জলভরা, শাঁখসন্দেশ, কাঁচাগোল্লা কলকাতা সহ সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। এই শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টির দোকানটি তার নরম পাকের সন্দেশের জন্য মানুষের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায় এমনকি বর্তমানের বিশিষ্ট ফিল্ম তারকারাও এই দোকানের সন্দেশের বড় ভক্ত। এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান থেকেই নাকি অভিষেক বচ্চনের বিয়ের অনুষ্ঠানের সমস্ত সন্দেশ পাড়ি দিয়েছিল সুদূর মুম্বাইতেও।
নবীন চন্দ্র দাশ (১৮৬৬)
বাগবাজারের এই মিষ্টির দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন নবীন চন্দ্র দাশ। আর সেই নবীন চন্দ্র দাশের সর্বকালের সেরা সৃষ্টি রসগোল্লা। বাঙালির এই প্রিয় মিষ্টিটির আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকে “রসগোল্লার কলম্বাস” আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই মিষ্টির বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি ছোট্ট গল্প। একদিন রায়বাহাদুর ভগবানদাস বাগলা নামে একজন জনৈক ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাশের মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তার পুত্র খুবই তৃষ্ণার্ত ছিল, জল খাওয়ার জন্য তারা তখন নবীন ময়রার মিষ্টির দোকানে এসে পৌঁছায়। নবীন ময়রা ভগবানদাসের পুত্রকে জলের সাথে একটি রসগোল্লাও খেতে দেন। সেটি খেয়ে তার এত ভালো লাগে যে তা দেখে তার পিতাও সেই মিষ্টির স্বাদ নিতে ইচ্ছুক হন। পিতা ও পুত্র দুজনেরই রসগোল্লার স্বাদ মনে ধরে যায়। তারপর ভগবানদাস নিজের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের জন্যও নবীন ময়রার কাছ থেকে হাঁড়ি হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে যান। এরপর থেকেই নবীন চন্দ্র দাশের রসগোল্লার খ্যাতি মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

অ্যালেন কিচেন
প্রায় ১৩০ বছর পুরানো এই দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্কটিশ সাহেব মিস্টার অ্যালেন। তাঁর নাম অনুসারে এই দোকানটির নামকরণ করা হয়েছিল অ্যালেন কিচেন। পরবর্তীকালে যখন মিস্টার অ্যালেন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যান তখন এই রেস্তোরাঁটির সমস্ত দায়িত্ব তাঁর কর্মচারী জীবন কৃষ্ণ সাহাকে দিয়ে যান। এখানকার প্রন ও ভেটকি মাছের কাটলেট, চিকেন-মটন স্টেক, কবিরাজি সহ বিভিন্ন জিভে জল এনে দেওয়া খাবারের স্বাদ সত্যিই অতুলনীয়।
দিলখুশা কেবিন (১৯১৮)
দিলখুশা কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন চুনীলাল দে। এখানকার পুরানো দিনের আসবাবপত্র, সাজ-সরঞ্জাম, সেকেলে মেঝে থেকে শুরু করে দেওয়ালের বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না সমস্ত কিছুই আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অতীতের কলকাতায়। তৎকালীন কবি ও সাহিত্যিকদের জমজমাটি আড্ডার সাক্ষী এই শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান।
প্যারামাউন্ট (১৯১৮)
১৯১৮ সালে বরিশাল নিবাসী নীহার রঞ্জন মজুমদার কলকাতার এই বিখ্যাত শরবতের দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এর নাম ছিল প্যারাডাইস। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী সেই সময় এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান থেকেই অনেক স্বদেশী কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবী সতীন সেন স্বদেশী অনুশীলন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এই দোকানটিকেই। বাঘাযতীন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, মেঘনাদ সাহা, জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো নামকরা মনীষীরাও এখানে এসেছেন। তবে ব্রিটিশ পুলিশরা এর সন্ধান পাওয়ার পর কিছু কালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই দোকানটি। ১৯৩৭ সালে নাম পরিবর্তন করে দোকানটিকে পুনরায় খোলা হয়। তারপর থেকে প্যারাডাইসের নাম মুছে গিয়ে জন্ম হল প্যারামাউন্টের। কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন সহ বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এখানকার ডাবের শরবতের বিশাল বড় ভক্ত ছিলেন।
নিরঞ্জন আগার (১৯২২)
এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা নিরঞ্জন হাজরার নামেই এর নাম হয় নিরঞ্জন আগার। এক সময় মান্না দে থেকে শুরু করে উৎপল দত্ত, তরুণ কুমার, অপর্ণা সেন সহ বহু নামকরা ব্যক্তিত্বরা এখানে চাঁদের হাট বসাতেন। মিনার্ভা থিয়েটারে রিহার্সাল চলাকালীন সেখানকার আর্টিস্ট ও কর্মচারীদের জন্য সমস্ত খাবারই যেত এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান থেকে। এই দোকানের ডিমের ডেভিলের স্বাদ, গন্ধ ও আকার সবই অতুলনীয়, যা ভোজনপ্রেমী বাঙালিদের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।
ইউ চিউ রেস্টুরেন্ট (১৯২৭)
ইউ চিউ রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠাতা হলেন আচুম্পা হুয়াং। চায়না থেকে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসার পর ইমিগ্রেন্ট চাইনিজদের জন্য খাবার বানাতে বানাতেই তাঁর এই রেস্তোরাঁর পথ চলা শুরু, তারপর বংশ পরম্পরায় তাঁর পরিবারের সদস্যরাই এর ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছেন। এখানকার বিখ্যাত খাবারগুলির মধ্যে চিমনি স্যুপ, চিলি পর্ক, হানি লেমন চিকেন, জোসেফাইন নুডলসের নাম না নিলেই নয়।
কে সি দাশ (১৯৩০)
রসগোল্লার আবিষ্কর্তা নবীন চন্দ্র দাশের পুত্র কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ ও নাতি সারদাচরণ দাশ এই মিষ্টির দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ বাঙালিকে তার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রসগোল্লার সাথে আরও এক নতুন সংস্করণ উপহার দেন, আর সেটা হল রসমালাই। রসমালাই ছাড়াও এই দোকানে আপনারা পেয়ে যাবেন অন্যান্য জিভে জল এনে দেওয়া রকমারি মিষ্টি। বিশেষ করে শীতকালে এখানকার গুড় রায়টাকলি, গুড়ের শঙ্খ, গুড়ের তালশাঁস আর অমৃতকুম্ভের মতো সুস্বাদু মিষ্টি আপনার মন কেড়ে নেবে।
ট্রিঙ্কাস (১৯৩৯)
১৯৩৯ সালে সিনজিও ট্রিঙ্কার হাত ধরে একটি চা-এর দোকান ও বেকারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে পার্ক স্ট্রিটের এই দোকানটির। ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে ওম প্রকাশ পুরি এবং এলিস জশুয়া সিনজিও ট্রিঙ্কার কাছ থেকে ট্রিঙ্কাস কিনে নেন এবং এই দোকানটিকে একটি রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত করেন। অসাধারণ খাবার, লাইভ ফ্লোর পারফরমেন্স সব কিছু মিলিয়ে শীঘ্রই ট্রিঙ্কাস কলকাতার শহুরে সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
সিরাজ (১৯৪১)
হেরিটেজ তকমা পাওয়া সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁর একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। ১৯৪১ সালে মহম্মদ আরশাদ আলি এবং মহম্মদ হুসেন বিহার থেকে কলকাতায় আসেন এবং এখানে এসে তাদের আলাপ হয় ওয়াজিদ আলি শাহের খাস বাবুর্চির বংশধর মহম্মদ শামসুদ্দিনের সাথে। এই তিন জনে মিলেই সিরাজ রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানেও কলকাতা শহরে মুঘলাই খানার জন্য বেশ বিখ্যাত।

ইন্ডিয়ান কফি হাউস (১৯৪২)
ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৪২ সালে কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে কফি হাউসের যাত্রা শুরু হয়। সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের মতো বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আনাগোনা ছিল এই কফি হাউসে। যদিও “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”, তবে আজও এই কফি হাউসে দেখা মেলে বহু নতুন প্রতিভাবান মুখের।
সাবির হোটেল (১৯৪৮)
হাজি সাবির আলি চাঁদনি চকে এই রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে প্রধানত আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের আনাগোনা ছিল। সাবির হোটেলে বিভিন্ন ধরণের মুঘলাই খানার মধ্যে অন্যতম ছিল রেজালা, যা হাজি সাবির আলির হাত ধরেই কলকাতার মানুষের কাছে প্রথম পৌঁছায় এবং খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কোয়ালিটি রেস্টুরেন্ট (১৯৫২)
কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হলেন পি. এন. ঘাই। পার্ক স্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁটি প্রথমে চা, কফি আর মাত্র কয়েক ধরণের স্ন্যাক্স নিয়ে তার যাত্রা শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর ভারতীয় খাবারের সমাহার নিয়ে হাজির হয় কলকাতাবাসীর কাছে, যা অল্প সময়ের মধ্যেই ভোজনপ্রেমী বাঙালির খাদ্যের তালিকায় এক বিশেষ জায়গা করে নেয়।

মোকাম্বো (১৯৫৬)
এই রেস্তোরাঁর প্রাণপুরুষ ছিলেন এখানকার শেফ কাম ম্যানেজার মিস্টার অ্যান্টোনিও প্রানধে। ইনি ছিলেন ইটালির বাসিন্দা, আর সেই কারণে এই রেস্তোরাঁ ইউরোপিয়ান ও ইটালিয়ান খাবারের জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল। সেই সময় এই রেস্তোরাঁয় লাইভ মিউজিক এমনকি ডান্স ফ্লোরেরও ব্যবস্থা ছিল। এখানকার ডেভিলড ক্র্যাব, চিকেন আলা কিভ, বেকড আলাস্কা মাস্ট ট্রাই ডিশগুলির মধ্যে অন্যতম।


Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.