কলকাতার সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল
দশমীর সিঁদুর খেলায় যখন বাঙালি মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, তখনই আবার মা দুর্গাকে বিদায় জানাবার প্রস্তুতিও শুরু করে দেয়। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ একটি বছরের প্রতীক্ষা পর্ব। এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি হয় প্রতিটি বাঙালির মনে। যদিওবা তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না, কথায় আছে না বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। দুর্গা পূজার পরেই হেমন্তের আলোয় সেজে ওঠে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ। অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী কালী পূজিত হন আমাদের দেশের প্রতিটি প্রান্তে।
দুর্গোৎসব বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব হলেও, শ্যামাঙ্গী কালীর নিত্যবাস প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়। কালী পূজা মানেই আলোর উৎসব। গৃহস্থে জ্বলা প্রদীপের আলো গ্রাস করে ফেলে সমস্ত অন্ধকার। আতশবাজিতে রঙিন হয়ে ওঠে রাতের আকাশ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সেজে ওঠে মণ্ডপ। যদিও আমরা কালী পূজা বলতে বারাসাত বা নৈহাটির কথাই ভাবি, তবে কলকাতাবাসীর পক্ষে সবসময় এই জায়গাগুলিতে গিয়ে প্রতিমা ও প্যান্ডেল দর্শন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাতে মন খারাপের কিছু নেই, কলকাতাও কিন্তু এই পূজায় পিছিয়ে নেই। আমাদের প্রাণের শহর কলকাতার অলিতে গলিতেও শুরু হয়ে গেছে কালী পূজার প্রস্তুতি। আর আজকে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু কলকাতার সেই সমস্ত সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল যেগুলি দর্শন না করলে এবারের কালী পূজা কিন্তু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। চলুন তাহলে আর বেশি দেরি না করে চটপট জেনে নেওয়া যাক কলকাতার কয়েকটি সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল সম্পর্কে।
নব যুবক সংঘ/ ফাটাকেষ্টর কালী পূজা
কলকাতার বিখ্যাত কালী পূজা বলতে প্রথমেই যে পূজাটির প্রসঙ্গ উঠে আসে সেটি হল ফাটাকেষ্টর কালী পূজা। কলকাতার আলোর উৎসবের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই পূজা। ফাটাকেষ্টর জমানা যদিও এখন আর নেই, কিন্তু এখনও সমস্ত নিয়ম নিষ্ঠা মেনে মহাসমারোহে পালিত হয়ে চলেছে মধ্য কলকাতার এই বিখ্যাত কালী পূজা। কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট-এর নব যুবক সংঘ আয়োজিত ফাটাকেষ্টর এই কালী পূজা এবার ৬৬তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই পূজার মূল আকর্ষণ এখানকার ১৪ ফুট উচ্চতা এবং ১ টন ওজন বিশিষ্ট সুবিশাল শ্যামবর্ণা দক্ষিণাকালীর মূর্তি। এই কালী মূর্তির নির্মাতা হলেন মৃৎশিল্পী মাধব পাল। পূর্বে তাঁর পিতা স্বর্গীয় কালীপদ পাল এই মূর্তি নির্মাণের কাজ করতেন। বাংলার বহু নামকরা চলচ্চিত্র তারকা ও শিল্পীদের আনাগোনা দেখা যায় এই মণ্ডপে। আমাদের সকলের প্রিয় মহানায়ক উত্তম কুমারও একসময় এই কালী প্রতিমা দর্শন করতে আসতেন। শুরু থেকেই দর্শনার্থীদের গন্তব্য তালিকায় ফাটাকেষ্টর কালী পূজা অন্যতম।
আদি বারোয়ারি কালী পূজা
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন কালী পূজা হিসেবে পরিচিত মধ্য কলকাতার এই আদি বারোয়ারি কালী পূজা। থিমের ভিড়ে কোথাও যেন আমাদের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও হ্রাস পাচ্ছে। আর তারই মাঝে স্বমহিমায় নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখে ১৬৫তম বর্ষে পদার্পণ করল এই পূজা। এই পূজা কমিটি আদি মায়ের ঐতিহ্যবাহী পূজার জন্য খ্যাত। সুবিশাল দেবী মূর্তি ও পরম্পরা মেনে পূজার সব উপাচার এখানকার মূল আকর্ষণ। এই পূজা কমিটি প্রতি বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করে। আপনি যদি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কালী পূজা অন্বেষণ করতে আগ্রহী হন, তাহলে আদি বারোয়ারির এই পূজা আপনার অবশ্যই দর্শন করা উচিত।
পাথুরিয়াঘাটা বড়কালী
কলকাতার আরও এক অন্যতম প্রাচীন কালী পূজা হল পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতির কালী পূজা। এই পূজার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বদেশী আন্দোলনের বহু ইতিহাস। ১৯২৮ সালে পাথুরিয়াঘাটা বড়কালী পূজার সূচনা হয়। সূচনা পর্বে এই পূজাটি অধুনা নিমতলা ঘাট স্ট্রিট লাগোয়া প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ঘাট চত্বরে উদযাপিত হত। ১৯৩০ সালে মেয়র সুভাষ চন্দ্র বসু অর্থাৎ আমাদের প্রাণের নেতাজি এই পূজার প্রেসিডেন্ট হন। স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত আরও এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হলেন অতুল কৃষ্ণ ঘোষ, যিনি ছিলেন রঘু ডাকাতের ভাব শিষ্য এবং একজন বিখ্যাত লাঠিয়াল। এই অতুল কৃষ্ণ ঘোষই ছিলেন এই পূজার প্রবর্তক। সেই সময় স্বদেশীরা শক্তির উপাসনা করতেন, আর সেই কারণেই এই কালী পূজার সূচনা। ১৯৫৬ সালে পূজার স্থান পরিবর্তন করা হয় এবং এই পূজাটি ঘাট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে মাঠে। বর্তমানে যেখানে বিনানি ধর্মশালা অবস্থিত, সেই সময় সেখানে ছিল ফাঁকা মাঠ। ১৯৬৩ সালের পর থেকে পাথুরিয়াঘাটা বড়কালী পূজা পুনরায় স্থানান্তরিত হয় ২২ নম্বর যদুনাথ মল্লিক রোডের এই জমিতে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই স্থানেই মহাসমারোহে পালিত হয়ে চলেছে এই বিখ্যাত বড়কালী পূজা। এখানকার সুবিশাল কালী প্রতিমার উচ্চতা ৩২ ফুট। সোনা ও রূপা মিলিয়ে মোট ৭৫ কিলো অলংকারে এখানে মা রাজবেশে ভূষিত হন। এবারে ৯৫ পেরিয়ে ৯৬-এর পথে কলকাতার বৃহত্তম কালী।
সাউথ দমদম এভিনিউ স্পোর্টিং ক্লাব
কলকাতার বিখ্যাত কালী পূজাগুলির মধ্যে অন্যতম সাউথ দমদম এভিনিউ স্পোর্টিং ক্লাবের কালী পূজা। এবারে ৫৮তম বর্ষে পদার্পণ করল এখানকার এই পূজা এবং এবছর এখানকার থিম “দিগম্বরী”। সম্পূর্ণ মণ্ডপসজ্জার পরিকল্পনায় রয়েছেন শিল্পী সৌরজিৎ ব্যানার্জি এবং প্রতিমা শিল্পী হলেন অর্ণভ পাল। সাউথ দমদম এভিনিউ স্পোর্টিং ক্লাবের এই বছরের কালী পূজার বিশেষ চমক দেখার জন্য অবশ্যই চলে আসুন এই পূজা মণ্ডপে।
গিরিশ পার্ক ৫ স্টার স্পোর্টিং ক্লাব
কলকাতার সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল দেখার জন্য দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে যে আরও এক বিখ্যাত পূজা সেটি হল গিরিশ পার্ক স্পোর্টিং ক্লাবের কালী পূজা। এবার এখানকার পূজা ৬৪তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই বছর গিরিশ পার্ক ৫ স্টার স্পোর্টিং ক্লাবের থিম “এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা”। শিল্পী মানস দাসের হাতের ছোঁয়ায় সমগ্র মণ্ডপটি এক অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে। এখানকার প্রতিমা শিল্পী হলেন ধনঞ্জয় রুদ্র পাল, আলোকসজ্জায় রয়েছেন অশোক দে এবং আবহে দীপাবলি দত্ত। প্রতি বছরই সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে আমজনতা সকলের উপচে পড়া ভিড় এই পূজা মণ্ডপটিতে লক্ষ্য করা যায়।
এবিএস স্পোর্টিং
কলকাতার সেরা কালী পূজার তালিকায় প্রতিবারের মতোই এবারও জায়গা করে নিয়েছে নিউ আলিপুরের এবিএস স্পোর্টিং-এর কালী পূজা। গত ৬৫ বছর ধরে এবিএস স্পোর্টিং এই পূজার আয়োজন করে আসছে। এখানে দেবী কালীর সবচেয়ে উগ্র অবতার চামুণ্ডা কালীর উপাসনা করা হয়। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এখানকার দেবী কালীর উগ্র মূর্তি আপনার মনে জাগাবে এক অপার বিস্ময়। স্বচক্ষে দেবীর এই মহিমান্বিতা রূপের দর্শন পেতে হলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে এবিএস স্পোর্টিং-এর কালী পূজায়। উপরন্তু এই পূজার সৌন্দর্য ও জাঁকজমক আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে।
শ্যামা পল্লী শ্যামা সংঘ
দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের শ্যামা পল্লী শ্যামা সংঘের নামটি থেকেই অনুমান করা যায় যে এখানকার শ্যামা পূজা কতটা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। পুরানো দিনের বিখ্যাত কালী পূজাগুলির তালিকায় এই পূজাটির বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এবারে ৭৪ বছরে পদার্পণ করল শ্যামা পল্লী শ্যামা সংঘের কালী পূজা। কলকাতার এই অন্যতম সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল এই বছর থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে “নগর পার্বণ”। এই পূজাটির সম্পূর্ণ বিষয় ভাবনার পিছনে রয়েছে থিঙ্কার্স এবং এখানকার প্রতিমা শিল্পী হলেন সৈকত বসু, আর আলোকসজ্জায় রয়েছেন দীপঙ্কর দে।
টালিগঞ্জ নবজাগরণ ক্লাব
কালী পূজার সাথে ভূতের সম্পর্কটা অনেক পুরানো। প্রতি বছরই কোনো না কোনো মণ্ডপে আমাদের দেখা মেলে ভূত বাবাজীদের সাথে। এই বছরও কিন্তু তার কোনো রকম ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রীপল্লী, পূর্ব পুটিয়ারীর টালিগঞ্জ নবজাগরণ ক্লাবের এই বছরের থিম “দ্য নান”। বিগত বছরের ন্যায় আবারও এদের পূজা মণ্ডপ ও প্রতিমার অভিনবত্ব সকল দর্শনার্থীদের মন জয় করবে এই দাবি রাখছে এখানকার পূজা কমিটি।
ত্রিভুবন ক্লাব
থিমের পূজায় আরও এক পূজা কমিটি যারা প্রতি বছর তাদের অভিনবত্ব নিয়ে দর্শনার্থীদের জন্য হাজির হয় সেটি হল ত্রিভুবন ক্লাব। সরশুনা সোনামুখী দাসপাড়ার এই কালী পূজা এবার ৩৯তম বর্ষে পদার্পণ করল এবং এই বছর এদের থিম “খোলামকুচি”। এখানকার মণ্ডপসজ্জার ভাবনায় রয়েছেন শিল্পী মিঠুন মন্ডল এবং প্রতিমা শিল্পী হলেন পিন্টু সিকদার।
বিজয়গড় ৬ পল্লী সর্বজনীন শ্যামা পূজা কমিটি
স্বল্প সময়ের মধ্যেই কলকাতার সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল হিসেবে নিজের এক বিশেষ স্থান অর্জন করে নিয়েছে বিজয়গড় ৬ পল্লী সর্বজনীনের পূজা। ১১তম বর্ষে এখানকার থিম বা বিষয় ভাবনা হল “স্বয়ম্ভু”। শিল্পী সুশোভন রায়ের ভাবনায় সমগ্র মণ্ডপ জুড়ে রয়েছে বিশেষ চমক। এখানকার প্রতিমা শিল্পী হলেন দীপেন মন্ডল এবং আলোকসজ্জায় রয়েছেন প্রেমেন্দু বিকাশ চাকি।
মৈনাক ক্লাব
বাঘাযতীনের মৈনাক ক্লাবের পূজা মানেই জাঁকজমক, চোখ ধাঁধানো মণ্ডপসজ্জা ও মহিমান্বিতা দেবী মূর্তি। কলকাতার সেরা কালী পূজা প্যান্ডেল হিসেবে এই পূজা দর্শনার্থীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এবারে ৪৯তম বর্ষে পদার্পণ করল এই ক্লাবের কালী পূজা। প্রাক সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে মৈনাকের উপস্থাপনায় রয়েছে মৈনাকেরই গল্প, যারা থেকে যায় আড়ালে তাদেরই গল্প বলতে এবার আসছে মৈনাক ক্লাব। ঠিক কি রকম হতে চলেছে এই পূজা, তা জানতে হলে পৌঁছে যেতে হবে মৈনাক ক্লাবের পূজা প্রাঙ্গণে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.