কীভাবে সবুজ দীপাবলি পালন করবেন

দীর্ঘ এক বছর অতিক্রান্ত করে আবার আসতে চলেছে আমাদের প্রাণের উৎসব দীপাবলি। আর দীপাবলি মানেই আলোর উৎসব। ইতিমধ্যেই আলোর রোশনাইতে সেজে উঠেছে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষ। ঘরে ঘরে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে সকলে। খুদেদের ভিড় জমেছে আতশবাজির দোকানে, আর বাড়ির বড়রা প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজেদের বাড়ি আলোকিত করে তোলার।

দীপাবলি বলতে বোঝায় অন্ধকারের উপর আলোর, অজ্ঞতার উপর জ্ঞানের, হতাশার উপর আশার ও মন্দের উপর ভালোর বিজয়। দীপাবলিতে দেবী কালীর আরাধনার মাধ্যমে সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে। তবে আমাদের এই উৎসব উদযাপনের পদ্ধতি কোথাও যেন আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিয়ে আসছে অশুভ বার্তা। কি সেই অশুভ বার্তা তা আপনি অতি সহজেই বুঝতে পারবেন দীপাবলির পরে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স চেক করলে। এই উৎসবের পরে বায়ুর দূষণের মাত্রা একলাফে বহুগুন বৃদ্ধি পায়, আর এর মূলে দায়ী দীপাবলিতে ব্যবহৃত আতশবাজি। এই আতশবাজি শুধুমাত্র বায়ুর দূষণের মাত্রাই বৃদ্ধি করে না তার সাথে সাথে ঘটায় শব্দদূষণও।

যদিও সরকার এই দূষণ কমাবার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য উৎসব চলাকালীন সেই সমস্ত পদক্ষেপগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। তবে শুধুমাত্র আতশবাজি থেকেই নয়, কখনো আমাদের অজ্ঞানতায়, কখনো বা জেনেশুনেই আমরা উৎসবের সময় পরিবেশকে নানা ভাবে কলুষিত করে তুলি। এই দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নিজেকে সবুজ দীপাবলি বা পরিবেশবান্ধব দীপাবলি উদযাপনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে হবে। কীভাবে করবেন এই সবুজ দীপাবলি পালন? চলুন জেনে নেওয়া যাক তারই খুঁটিনাটি।

১. সবুজ আতশবাজির ব্যবহার করুন, শব্দবাজিকে বলুন না 

‘দিওয়ালি' বা ‘দীপাবলি' শব্দটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘সজ্জিত প্রদীপের সারি'। কিন্তু এই উৎসব যে শুধুমাত্র আলোর, শব্দের নয় তা বোধহয় আমাদের অনেকেরই অজানা। উচ্চতম আদালতে শব্দবাজি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া সত্ত্বেও আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চুপিসারে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হচ্ছে শব্দবাজি। এই নিয়মভঙ্গের কর্মে শুধুমাত্র বিক্রেতারাই নয় আমাদের মতো ক্রেতারাও সমানভাবে লিপ্ত। আতশবাজি থেকে নির্গত গ্যাস আমাদের স্বাস্থ্য ও প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বিকট আওয়াজ যুক্ত চকলেট বোমা অথবা যেকোনো ধরণের শব্দবাজি বায়ুদূষণের সাথে সাথে শব্দদূষণের জন্যও দায়ী। এই দানবীয় দূষণের হাত থেকে মুক্তি পায় না নিরীহ পশুপাখিগুলিও। আতশবাজি থেকে সৃষ্ট শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণকে আমাদের রুখতে হবে। সকলকে সোচ্চার হতে হবে দূষণ প্রতিরোধে।

যদিও বাড়ির খুদেদের এই বিষয়টা বোঝানো একটু মুশকিল হয়ে পরে। বছরের এই একটা দিন তারা আতশবাজি ফাটানো থেকে বিরত থাকতে খুব একটা বেশি পছন্দ করে না। তাই এর উপায় হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে পরিবেশবান্ধব সবুজ আতশবাজি যা অন্যান্য আতশবাজিগুলির তুলনায় কম দূষণকারী। আর অতি সহজেই আপনি বাজারে পেয়ে যাবেন এই সমস্ত সবুজ বাজি। তাই এই দীপাবলিতে নিজের সন্তানকে পরিবেশবান্ধব সবুজ আতশবাজিগুলিই কিনে দিন। তাতে সবুজ দীপাবলি পালনও হল আর খুদেদের মন রক্ষাও হল।

২. মাটির প্রদীপ ব্যবহার করুন

প্লাস্টিকের বৈদ্যুতিক প্রদীপ বা মোমবাতি বর্তমানে বাজারে ছেয়ে গেছে। তবে মাটির প্রদীপের সত্যিই কোনো বিকল্প হয় না। বিভিন্ন কারুকার্য খচিত রংবেরঙের মাটির প্রদীপ যেমন আপনার বাড়ি আলোকিত করে তোলে তার সাথে সাথে বিদ্যুতের সাশ্রয়ও ঘটায়। মাটির প্রদীপ শুধুমাত্র আপনার বাড়ির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করবে না, এই প্রদীপগুলি আপনি বছরের পর বছর ব্যবহারও করতে পারবেন। প্রদীপ জ্বালানোর কাজে পরিবারের খুদে থেকে বয়স্ক সকলেই একত্রিত হয়ে হাত লাগাতে পারে, যার মাধ্যমে এই উৎসবের দিনে পরিবারের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। আমাদের এই উৎসবগুলির উপর নির্ভর করে বহু মানুষের জীবিকা। আর দীপাবলির জন্য অধীর আগ্রহে এক রাশ প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন কুমোরেরা। আপনার সবুজ দীপাবলি পালনের এই পদক্ষেপটি সেই সমস্ত কুমোরদের মুখে এনে দেবে আনন্দের হাসি।

৩. রঙ্গোলির জন্য ব্যবহার করুন প্রাকৃতিক উপাদান

দীপাবলির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ রঙ্গোলি। বাড়ির উঠানে বা অন্তঃপুরের বিভিন্ন স্থানে গৃহিণীরা তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় দীপাবলির দিনে রঙ্গোলি তৈরি করেন। তবে আপনি কি জানেন রঙ্গোলিতে ব্যবহৃত রংগুলিতে বহু ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এই রাসায়নিক রঙের পরিবর্তে গোলাপ, গাঁদা অথবা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের পাপড়ি, পান পাতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে আপনি অনায়াসেই বানিয়ে ফেলতে পারবেন একটি সুন্দর রঙ্গোলি। প্রথমে চক বা পেনসিল ব্যবহার করে মেঝেতে একটি নকশা তৈরি করে সেই নকশাটিকে ফুলের পাপড়ি দিয়ে ভরাট করে নিন। তারপর রঙ্গোলির মাঝখানে একটি সুন্দর কারুকার্য করা জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে দিন। ফুলের সুবাস এবং প্রদীপের আলো আপনার বানানো রঙ্গোলিতে এক আলাদাই মাত্রা এনে দেবে। এছাড়াও রং হিসেবে আপনি হলুদের গুঁড়ো, কফি পাউডার ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করেও বানিয়ে ফেলতে পারেন আপনার পছন্দসই রঙ্গোলি। এই জিনিসগুলি শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধবই নয় এগুলি কম্পোস্টেবলও। তাই সবুজ দীপাবলি উদযাপনে অংশীদার হতে আপনার রঙ্গোলিতে ব্যবহার করুন প্রাকৃতিক উপাদান।

৪. পরিবেশবান্ধব টেবিলওয়্যার ব্যবহার করুন

দীপাবলি মানেই পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সমাবেশ। আর সেই সমাবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া। আগেকার দিনে উৎসবের সময় খাওয়া-দাওয়ার জন্য কাঁসার বাসনের ব্যবহার হত। তবে ইদানীং বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আগমন ঘটলে আমরা স্টাইরোফোমের থালা বাটিতে খাবার পরিবেশন করি, পানীয়র জন্য ব্যবহার করি প্লাস্টিকের গ্লাস। এই ধরনের টেবিলওয়্যার যেমন অস্বাস্থ্যকর সেইরকমই প্রকৃতির জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকারক। এই  নন-বায়োডিগ্রেডেবল টেবিলওয়্যার মৃত্তিকা দূষণের অন্যতম কারণ। তাই অস্বাস্থ্যকর ও দূষণকারী টেবিলওয়্যারের পরিবর্তে শালপাতার বা মাটির থালা ও মাটির গ্লাসের মতো পরিবেশবান্ধব টেবিলওয়্যার ব্যবহার করে পরিবেশ এবং নিজেকে নিরাপদে রাখুন।

৫. পরিবেশবান্ধব উপহার দিন

সবুজ দীপাবলি পালনের অন্যতম সেরা উপায় হল প্রকৃতিকে আরও সবুজ করে তোলা। আর তার জন্য নিজের কাছের মানুষগুলিকে এই দীপাবলিতে উপহার হিসেবে দিতে পারেন বাহারি ফুলের গাছ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের পাতাবাহার গাছ। আপনাদের সম্পর্কের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে উঠবে সেই গাছটিও, আর বারবার আপনার প্রিয়জনটিকে মনে করিয়ে দেবে আপনার কথা। এছাড়াও অর্গানিক স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট অথবা বর্জ্য পদার্থ থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের জিনিসও আপনি উপহার হিসেবে বেছে নিতে পারেন।

৬. পরিবেশবান্ধব মোড়ক ব্যবহার করুন

শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব উপহার কিনলেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হবে না। এই উপহারগুলিকে মোড়ানোর জন্য আমরা যে রঙিন চকচকে প্লাস্টিকের মোড়ক ব্যবহার করি তাতে থাকে সীসা থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ফিল্ম, সিনথেটিক কালি, ধাতব ফয়েলের মতো দূষণকারী বস্তু। এই মোড়কগুলি সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহৃত না হলে তা পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

এই দীপাবলিতে প্লাস্টিকের মোড়কের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজ মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করে আপনার ঘনিষ্ঠদের কাছে ট্রেন্ড সেটার হয়ে উঠুন।

৭. দীপাবলি হোক প্লাস্টিক বিহীন

দীপাবলিতে যেমন আমরা অন্যের জন্য উপহার কিনি সেইরকমই নিজেদের জন্যও চলে জোর কদমে কেনাকাটা। আর এই কেনাকাটার সময় বিক্রেতারা আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয় প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকারক তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। তাই চলুন এবার প্লাস্টিক ব্যাগকে জানাই চির বিদায়। কেনাকাটার সময় বাড়ি থেকেই নিয়ে যান কাপড়ের ব্যাগ, যা এই সমস্যার একমাত্র সমাধান।

৮. বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন

সবুজ দীপাবলি পালনের সর্বশেষ পদক্ষেপটি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা উৎসবের সময় আনন্দে আত্মহারা হয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটির কথা সম্পূর্ণই ভুলে যাই। আর সেই পদক্ষেপটি হল আতশবাজির প্লাস্টিকের কভার, মিষ্টির বাক্স, বিস্ফোরক এবং অ-বিস্ফোরক জিনিসের সমস্ত আবর্জনা আলাদাভাবে সংগ্রহ করা, যাতে এটির উপযুক্তভাবে নিষ্পত্তি ঘটে।

সকলকে শুভ এবং সবুজ দীপাবলির অগ্রিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আমার এই লেখার এখানেই ইতি টানলাম।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: