ভাইফোঁটা উদযাপনের ধর্মীয় তাৎপর্য
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা,
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা,
ভাই আমার সোনার বাটা,
সূর্য চন্দ্র যত কাল,
ভাই আমার তত কাল।
ছোটবেলা থেকেই এই মন্ত্রোচ্চারণ করে দাদার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে শুরু হয় আমার ভাইফোঁটার দিনটি। আজ পর্যন্ত এর কোনোরূপ ব্যতিক্রম ঘটেনি। তারপর চলে খুড়তুতো, পিসতুতো, মামাতো দাদা ও ভাইদের ফোঁটা দেওয়ার পর্ব। কালী পূজা শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ভাইফোঁটার প্রস্তুতি। মিষ্টির দোকানের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কেনা, ভাইদের জন্য গিফ্ট কেনা, ওই দিনের খাবার দাবারের সমস্ত আয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার মতোই প্রতিটি বোনই অধীর আগ্রহে বছরভর অপেক্ষা করে থাকে এই বিশেষ দিনটির জন্য। শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই বিশেষ দিনটিতে প্রত্যেক ভাই উপস্থিত হয় তার প্রিয় বোনটির কাছে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পালিত হয় এই লৌকিক উৎসব। এই বিশেষ দিনে উপবাস থেকে প্রতিটি বোন তার ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে। তবে এই ভাইফোঁটা উদযাপনের ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কোনো ধারণা নেই। কীভাবে শুরু হল এই উৎসবের প্রচলন? কীই বা এই উৎসবের রীতি-নীতি? আজকে এই সব কিছুর উত্তর রয়েছে আমার এই প্রবন্ধে। চলুন তাহলে আর বেশি দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক এই উৎসবের ধর্মীয় তাৎপর্য থেকে শুরু করে রীতি-নীতির মতো আরও নানান তথ্য।

এই উৎসব কি শুধু বাঙালিদের?
এই উৎসব কিন্তু শুধুমাত্র বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তাই মূল প্রসঙ্গে আসার পূর্বে চলুন জেনে নেওয়া যাক পশ্চিমবাংলা ছাড়া আর কোথায় কোথায় পালিত হয় এই উৎসব। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে সমগ্র ভারতবর্ষ এবং আমাদের কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পালিত হয় এই লৌকিক উৎসব। বাংলায় ভাই-বোনের মধুর সম্পর্কের যে উৎসব ভাইফোঁটা নামে পরিচিত সেই উৎসবই আবার পশ্চিম ভারতে ভাইদুজ নামে পালিত হয়। মহারাষ্ট্র, গোয়া এবং কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলা হয় ভাইবীজ। পশ্চিমবাংলার দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে, প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে এই উৎসব ভাইটিকা নামে পরিচিত। এছাড়াও বাংলাদেশ, আসাম ও ত্রিপুরার হিন্দু-বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাইফোঁটার প্রচলন আছে।
ভাইফোঁটা কবে পালিত হয়
ভাইফোঁটা উদযাপনের ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে কবে পালিত হয় এই উৎসব।
ভাইফোঁটা, যার শাস্ত্রসম্মত নাম ভাতৃদ্বিতীয়া একটি তিথিকৃত্য। পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সাধারণত কালী পূজার দুই দিন পরে এই উৎসব পালিত হয়। অমাবস্যার পর এই দ্বিতীয়াতেই প্রথম চাঁদের দর্শন পাওয়া যায়। তাই এই তিথিকে আত্মজ্ঞানের প্রকাশক হিসেবে গণ্য করা হয়। ভারতবর্ষের কিছু কিছু জায়গায় যে সমস্ত মহিলাদের নিজের ভাই নেই তারা চন্দ্রদেবতাকে ভাই কল্পনা করে এই উৎসব পালন করেন।

ভাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটার প্রচলনের পশ্চাতে কিছু পৌরাণিক কাহিনী
আমাদের সমাজে যে সমস্ত লৌকিক উৎসবগুলি পালিত হয়ে আসছে সেই প্রত্যেকটি উৎসব উদযাপনের পশ্চাতে রয়েছে কিছু প্রচলিত কিংবদন্তি। ভাতৃদ্বিতীয়ার ধর্মীয় তাৎপর্য বুঝতে হলে এই উৎসবের পশ্চাতে যে পৌরাণিক কাহিনীগুলি রয়েছে সেই কাহিনীগুলি সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।
যম ও যমুনার কাহিনী
সর্বাধিক প্রচলিত যে কিংবদন্তিটির মাধ্যমে ভাতৃদ্বিতীয়ার ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাই সেই কাহিনীটি হল যম ও যমুনার কাহিনী। কেন ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিলে যমের দুয়ারে কাঁটা পড়ে তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে এই কাহিনীতেই। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ধর্ম ও মৃত্যুর দেবতা যম এবং তাঁর বোন যমুনা বা যমি ছিলেন সূর্যদেবের সন্তান। কোনো এক কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনা তাঁর ভাই যমের মঙ্গল কামনায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে পূজা শুরু করেন এবং যমের কপালে ফোঁটা দেন। দেবী যমুনার এই পূজার ফলস্বরূপ যমরাজ অমরত্ব লাভ করেন। তাই ভাতৃদ্বিতীয়ার আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া। এই প্রথা মেনেই আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। মৃত্যুর দেবতা যমরাজ যেন কোনো ভাইকে অকালে না নিয়ে যেতে পারেন সেই কারণেই যমের দুয়ারে কাল্পনিক কাঁটা স্থাপন করে বোনেরা যমরাজের আসার পথ রুদ্ধ করে এবং যমুনার মতোই ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে তার দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করে। এই বিশেষ দিনে দেবী যমুনা ও যমরাজের পূজা করা অত্যন্ত শুভ বলে বিবেচিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণ ও সুভদ্রার কাহিনী
ভাতৃদ্বিতীয়ার প্রচলনের পশ্চাতে রয়েছে আরও এক কিংবদন্তি। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে আমরা নরকাসুরের উল্লেখ পাই। এই নরকাসুরকে বধ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। নরকাসুর বধের পর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে যান। তখন বিজয়ী শ্রীকৃষ্ণের আগমনে সুভদ্রা বিশেষ পূজা করেন এবং শ্রীকৃষ্ণের কপালে বিজয় তিলক কেটে দেন। সেই দিনটিও ছিল কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি।

ভাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটার ধর্মীয় রীতি-নীতি
১. শাস্ত্রানুসারে সর্বদা পূর্ব দিকে মুখ করে ফোঁটা নেওয়া শুভ। তাই এই দিনে ভাইদের পূর্ব দিকে মুখ করে বসিয়ে ফোঁটা দিন।
২. যে আসনে আপনি আপনার ভাইকে বসতে দেবেন সেই আসনটি যেন সুতির কাপড়ের হয়।
৩. চন্দন বাটার সময় অবশ্যই পবিত্র গঙ্গাজল ব্যবহার করবেন। গঙ্গাজলের পরিবর্তে গোলাপ জলও ব্যবহার করতে পারেন।
৪. ভাইফোঁটার বরণের থালায় চন্দনের সাথে ধান, দূর্বা, প্রদীপ অবশ্যই রাখবেন।
৫. ফোঁটা দেওয়ার সময় চন্দন, দই, শিশিরের জল এবং কাজল অবশ্যই ব্যবহার করবেন।
৬. প্রথমে প্রদীপ দিয়ে ভাইয়ের আরতি করে ধান, দূর্বা মাথায় দিয়ে ভাইকে আশীর্বাদ করবেন এবং চন্দনের ফোঁটা দিয়ে নিজের ইষ্টদেবতার কাছে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা জানিয়ে তার দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করবেন। সম্পর্কে বড় হলে দাদার পা ছুঁয়ে বোনেরা আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন এবং ভাইয়েরা তার দিদিকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেবেন।
৭. ফোঁটা দেওয়ার সময় শঙ্খধ্বনি দিতে ভুলবেন না। এছাড়াও বাঙালিদের যেকোনো শুভ কাজে উলুধ্বনি অত্যাবশ্যক।
৮. বিজোড় সংখ্যক মিষ্টি কাঁসা বা পিতলের থালায় সাজিয়ে নিজের ভাই বা দাদাকে পরিবেশন করবেন।
৯. এরপর চলে উপহার আদান প্রদানের পালা। যদিও উপহার আদান প্রদান ধর্মীয় রীতি-নীতির অংশ নয়, তবুও ভাই-বোনের মুখে একরাশ হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য এটি ভাইফোঁটার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। সবশেষে বাঙালিদের অন্যান্য উৎসবগুলির মতোই এই উৎসবেও থাকে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া।
উল্লিখিত এই রীতি-নীতিগুলি পরিবারভেদে সামান্য ভিন্ন হতে পারে। তবে মন দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রার্থনা করলে আপনার ভাইয়ের জীবনের সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অবশ্যই দূর হয়ে যাবে।
আমার সকল পাঠক পাঠিকাকে শুভ ভাতৃদ্বিতীয়ার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে ভাইফোঁটা উদযাপনের ধর্মীয় তাৎপর্য সংক্রান্ত এই প্রবন্ধটির এখানেই ইতি টানলাম।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.