শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয়
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জরী;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।”
শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলোয় ভরা মেঘ, নদী-নালা-খাল-বিলের ধারে দুগ্ধশুভ্র কাশফুলের সমারোহ প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে এক অপরূপ সাজে। এক মনমাতানো সুবাসে ভরে ওঠে চারিপাশ। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় আগমনীর আগমন বার্তা। প্রকৃতি যেন হয়ে ওঠে উৎসব মুখর। এই অনুভূতি ঠিক কি রকম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই সম্ভব নয়। প্রতিটি বাঙালির কাছেই এই বিশেষ অনুভূতির মূল্য অপরিসীম।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসব হল শারদীয় দুর্গোৎসব। যদিও সমস্ত ধর্মীয় ভেদাভেদ ভেঙে যায় এই উৎসবের আলোয়। প্রকৃত অর্থে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলিত হওয়ার উৎসবই হল শারদীয় দুর্গোৎসব।
তবে কেনই বা এই শারদীয় দুর্গোৎসবকে বলা হয় অকালবোধন? প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয়? এর পিছনে রয়েছে নানান কাহিনী। তারই মধ্যে কিছু প্রচলিত ও জনপ্রিয় কাহিনী আমার এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু।

কে, কেন, কোন সময় প্রথম দুর্গা পূজা করেছিলেন?
প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয় সেই প্রসঙ্গে আসার পূর্বে আমাদের জেনে নিতে হবে, কে ছিলেন দেবী দুর্গার প্রথম উপাসক? কোন সময় হয়েছিল প্রথম দুর্গা পূজা?
মর্ত্যে দেবী দুর্গার প্রথম উপাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয় সুপুরের রাজা সুরথকে। এই সুপুর নামক স্থানটি অধুনা পশ্চিমবাংলার বীরভূম জেলার বোলপুরে অবস্থিত। সুরথ রাজাই প্রথম সত্যযুগে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। কিন্তু কেনই বা রাজা দেবী দুর্গার উপাসনা শুরু করেছিলেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনী।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুরথ রাজা রাজ্যহারা হন। সর্বস্ব হারিয়ে রাজা পথে পথে ঘুরতে থাকেন। সেই সময় সমাধি নামক এক সর্বহারা বৈশ্যের সাথে রাজার পরিচয় ঘটে, যাঁর পরিবার প্রতারণা করে তাঁর যথা সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বণিক উভয়ই মেধস মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। উভয়ের জীবনের করুণ কাহিনী শুনে মুনি তাঁদের দেবী দুর্গার উপাসনা করার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুসারে রাজা সুরথ ও সমাধি বণিক অম্বিকারূপিণী দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে পূজা শুরু করেন। তিন বছর উপাসনা করার পর তাঁরা দেবী দুর্গার দর্শন পান। তখন তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ মনোবাঞ্ছার কথা দেবীকে জানান এবং দেবী তাঁদের উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে উভয়কে বর প্রদান করেন।

দেবী দুর্গার উপাসনা করে সুরথ রাজা তাঁর হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন এবং সমাধি বণিক তত্ত্বজ্ঞান লাভ করলেন। তাঁরা বসন্তকালে এই পূজা করেছিলেন বলে এটিকে বাসন্তী পূজা বা বসন্তকালীন দুর্গোৎসব বলা হয়। যেহেতু সর্বপ্রথম বসন্তকালে দুর্গোৎসব পালিত হয়েছিল তাই বার বার এই প্রশ্ন উঠে আসে শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয়? এই শারদীয় দুর্গোৎসবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি শব্দ, সেটি হল অকালবোধন। এই অকালবোধন বলতে ঠিক কি বোঝায়? কেনই বা শারদীয় দুর্গোৎসবকে অকালবোধন বলা হয়? চলুন এবার জেনে যাওয়া যাক তারই কাহিনী।
অকালবোধনের অর্থ
অকাল শব্দের অর্থ অসময় অথবা অশুভ সময়। অর্থাৎ যে সময়টি কোনো শুভ কার্য সম্পন্ন করার জন্য সঠিক নয়। আর বোধন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল জাগ্রত করা। অতএব অকালবোধন শব্দের অর্থ হল অসময়ে জাগরণ।
শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন অকালবোধন বলা হয়?
উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ বছরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুটি ভাগ হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন। বছরের ছ'মাস অর্থাৎ বাংলার মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত থাকে উত্তরায়ন, এই সময় উত্তর গোলার্ধে দিন বড় ও রাত ছোট হয়। বাকি ছ'মাস অর্থাৎ শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত থাকে দক্ষিণায়ন, এই সময় উত্তর গোলার্ধে দিন ছোট ও রাত বড় হয়।
উত্তরায়নের সময় কেন দেবতাদের পূজা করা হয়?
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরায়নের সময়কে দেবতাদের দিন হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। এই ছ'মাস দেবতারা জাগ্রত থাকেন। তাই দেবতাদের আরাধনার জন্য সর্বোত্তম সময় হল উত্তরায়নের সময়টি। এই কারণেই চৈত্র মাস দেবী দুর্গার আরাধনার পবিত্র ও উপযুক্ত সময়।
দক্ষিণায়নের সময় কেন দেবতাদের পূজা করা অশুভ?
পুরাণ অনুযায়ী দক্ষিণায়নের সময়টিকে অসুরদের আধিপত্যের সময় হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়কাল দেবতাদের রাত্রি। এই সময় দেবতারা গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকেন। তাই দক্ষিণায়নের সময় দেবতাদের জাগ্রত করতে যথেষ্ট সাধ্য সাধনার প্রয়োজন হয়।
শরৎকাল এই দক্ষিণায়নের অন্তর্গত হওয়ায় এই সময় দেবী দুর্গাকে জাগ্রত করে অধিষ্ঠিত করতে হয়। তাই শারদীয় দুর্গোৎসবকে অকালবোধন বলা হয়।

শরৎকালে কে এবং কেন দুর্গা পূজার প্রচলন করেন?
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয়েছিল? কেই বা এই অসময়ে দেবী দুর্গার উপাসনা করেছিলেন? শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয়েছিল তা নিয়ে যে কাহিনীটি বহুল প্রচলিত সেটি হল লঙ্কাধিপতি রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য বিষ্ণুর সপ্তম অবতার শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কাহিনী।
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক শরৎকালে দুর্গা পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনির মহাকাব্যে শ্রীরামচন্দ্রকৃত দুর্গা পূজার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
লঙ্কাধিপতি রাবণের বন্দি দশা থেকে দেবী সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র বানর সেনার সহায়তায় লঙ্কা আক্রমণ করেন। একে একে লঙ্কার সেনাবাহিনী ও অসংখ্য পুত্রমিত্র হারিয়ে হীনবল রাবণ এই সংকট মুহূর্তে যুদ্ধে সাহায্য চেয়ে দেবী অম্বিকার বন্দনা শুরু করেন। রাবণের উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করার বর প্রদান করলেন। এই বরপ্রাপ্তি হওয়ায় লঙ্কাধিপতি অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।

অচিরেই শ্রীরামচন্দ্র বুঝতে পারলেন দেবীর উপস্থিতিতে রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করা অসম্ভব। এই সংকট মোচনের জন্য শ্রীরামচন্দ্র দেবতাদের নিকট দ্বারস্থ হলেন। অবশেষে প্রজাপতি ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে দেবী দুর্গার পূজা করার উপদেশ দিলেন। কিন্তু শরৎকালে দক্ষিণায়নের সময় কীভাবে হবে দেবী দুর্গার আরাধনা সেই ভেবে শ্রীরামচন্দ্র চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা জানালেন দেবীর অকালবোধন করতে হবে। প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন বেল গাছের তলায় দেবীর বোধন করেন এবং অধিবাসের সময় স্বহস্তে বেঁধে দেন নবপত্রিকা। তিনি সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে করলেন সন্ধিপূজা। কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের নবমী পূজার বিশেষ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বহুরকমের বনফুল ও বনফলে এই পূজা সম্পন্ন হয়েছিল। তবে সম্পূর্ণ নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পূজা করার পরও শ্রীরামচন্দ্র দেবীর দর্শন পেলেন না। তখন বিভীষণের পরামর্শে শ্রীরামচন্দ্র দেবীকে একশত আটটি দুর্লভ নীলকমল অর্থাৎ নীল পদ্ম নিবেদন করে তুষ্ট করেছিলেন।
তবে এর পিছনেও রয়েছে আরও এক কাহিনী। নীল পদ্ম অতি দুর্লভ একটি ফুল। পৃথিবীতে একমাত্র দেবীদহ নামক হ্রদেই এর সন্ধান মেলে। আর এই হ্রদ লঙ্কা থেকে বহু দূরে অবস্থিত। এই পরিস্থিতিতে হনুমান নীল পদ্মের খোঁজে রওনা দিলেন দেবীদহের উদ্দেশ্যে। নিমেষের মধ্যে সেই দুর্লভ নীল পদ্ম নিয়ে হনুমান হাজির হলেন শ্রীরামচন্দ্রের নিকট। তবে পূজার সময় ঘটলো এক বিপত্তি, গণনা করে দেখা গেল ফুলের সংখ্যা একশত সাতটি। আসলে একশত আটটি নীল পদ্মের মধ্যে একটি ফুল দেবী মায়াবলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নিরুপায় হয়ে শ্রীরামচন্দ্র তাঁহার একটি পদ্মলোচন দেবীর চরণে অর্পণ করতে উদ্যত হন। তাঁর এইরূপ আচরণে ও ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে সেই সময় দেবী দুর্গা তাঁকে দর্শন দেন। দেবী তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন এবং রাবণের পক্ষ ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপর শ্রীরামচন্দ্র দশমীর পূজা সমাপ্ত করে দেবী প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে রাবণ বধের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করলেন। এর পরবর্তী কাহিনী কারোরই অজানা নয়।

অকালবোধনের অপর এক কাহিনী
শরৎকালে কেন দেবী দুর্গার পূজা করা হয় সেই প্রসঙ্গে আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং দেবীর অকালবোধন ও পূজা সম্পন্ন করেছিলেন। তবে কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম্ম পুরাণ অনুসারে শ্রীরামচন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ব্রহ্মার স্তবে দেবী চণ্ডিকা জাগ্রত হন এবং তাঁকে জানান সপ্তমী তিথিতে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের ধনুকে প্রবেশ করবেন। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশটি মস্তক ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে, তবে পুনরায় তা জোড়া লাগবে। নবমীর দিন নিহত হবেন রাবণ। দশমীর দিন পালিত হবে বিজয়োৎসব। আজও প্রজাপতি ব্রহ্মার পূজার নিয়মানুসারেই পূজিত হন দেবী দুর্গা।
এই প্রচলিত তথ্য অনুসারে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গা পূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। সেই বিধান অনুযায়ী যুগ যুগ ধরে মহাসমারোহে পালিত হয়ে চলেছে শারদীয় দুর্গোৎসব। তবে বাংলায় মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন দেবী দুর্গা।
আমার সকল পাঠক পাঠিকাদের জন্য রইল শারদীয় দুর্গোৎসবের আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.