পশ্চিমবঙ্গে দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির

অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী কালী পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে পূজিত হন। কথিত আছে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পতিত হয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। এই সমস্ত পবিত্র স্থানগুলি শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নামে পরিচিত। এই পবিত্র পীঠস্থানগুলিতে গড়ে ওঠে দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির। ভারতবর্ষে এই রকম ৫১টি শক্তিপীঠ আছে। যদিও শক্তিপীঠের সংখ্যা এবং অবস্থান নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এছাড়াও হিন্দু শাস্ত্রে কিছু উপপীঠের কথাও উল্লেখ আছে। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কিছু শক্তিপীঠ ও উপপীঠ অবস্থিত। তাছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে বহু কালী মন্দির। আজকে আমার লেখনীতে রইল পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য।

কালীঘাট মন্দির

পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় অবস্থিত কালীঘাট মন্দির ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম। মায়ের দর্শনের জন্য দূর দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে। শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরে দক্ষিণা কালী ও পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর পূজিত হন। পৌরাণিক শাস্ত্র মতে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর ডান পদাঙ্গুলি কালীঘাটে পতিত হয়েছিল যা বর্তমানে এইখানে রক্ষিত আছে। লোকমুখে এই কথা প্রচলিত যে আত্মারাম ব্রহ্মচারী এবং ব্রহ্মানন্দ গিরি নামক দুই জন সন্ন্যাসী একটি কষ্টিপাথরের শিলাখণ্ডে দেবীর রূপ দান করেন। ১৮০৯ সালে আদিগঙ্গার তীরে এই দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির স্থাপিত হয়। বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে এই মন্দিরের স্থাপনা করেন। মূল মন্দির ছাড়াও এখানে আরও অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির রয়েছে যেখানে রাধাকৃষ্ণ, শিব এবং অন্যান্য দেবদেবীর পূজা হয়।

ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি

কলকাতায় অবস্থিত আরও একটি দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির হল ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, যেটি ঠনঠনিয়ার শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির নামেও পরিচিত। লোকমুখে প্রচলিত ১৭০৩ সালে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামক একজন তান্ত্রিক মাটি দিয়ে নিজের হাতে এখানকার কালী প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। সেই মাটির প্রতিমাই প্রতি বছর সংস্কার করা হয়। শঙ্কর ঘোষ নামক একজন ধনী ব্যক্তি ১৮০৬ সালে বর্তমান কালী মন্দিরটি সহ পুষ্পেশ্বর শিবের আটচালা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই মন্দিরের নিত্যপূজার ব্যয়ভারও গ্রহণ করেছিলেন। এই মন্দিরে জ্যৈষ্ঠ মাসে দেবী ফলহারিণীর, কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দেবী আদিকালীর ও মাঘ মাসে দেবী রটন্তী কালীর পূজা করা হয়।

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির

হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। রানী রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৮৫৫ সালে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে দেবী কালী ভবতারিণী রূপে পূজিত হন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এই মন্দিরের পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দক্ষিণেশ্বরের এই দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির হয়ে ওঠে তাঁর সাধনাক্ষেত্র। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির চত্বরে মূল মন্দির সংলগ্ন আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে, যেমন দ্বাদশ শিব মন্দির, শ্রী শ্রী রাধাকান্ত মন্দির প্রভৃতি।

তারাপীঠ মন্দির

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাটের নিকট তারাপীঠ মন্দির অবস্থিত। তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান এই তারাপীঠ। তারাপীঠের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত সন্ন্যাসী বামাক্ষ্যাপার নাম। তিনি এই মন্দিরে মা তারার পূজা করতেন। তিনি কৈলাসপতি বাবা নামক এক তান্ত্রিকের শিষ্য ছিলেন এবং মন্দির সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রে তন্ত্র সাধনা করতেন। এই শ্মশানে এখনও অনেক তান্ত্রিক তন্ত্র সাধনা করেন। হিন্দুদের কাছে এই মন্দির এবং এই মন্দির সংলগ্ন শ্মশান একটি পবিত্র স্থান।

পৌরাণিক কাহিনী মতে তারাপুর বা তারাপীঠ গ্রামে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর তৃতীয় নেত্র বা নয়নতারা পতিত হয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে গিয়েছিল। ঋষি বশিষ্ঠ সর্বপ্রথম মায়ের এই প্রস্তরীভূত রূপটি দেখতে পান। তারপর তিনি দেবী সতীকে ‘মা তারা’ রূপে পূজা করেন। এই পবিত্র স্থান ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম একটি শক্তিপীঠ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জয়দত্ত বণিক নামক এক জনৈক বণিক বর্তমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সারা বছর ভক্তরা নিজেদের মনস্কামনা পূরণের জন্য এখানে মা তারার পূজা দিতে আসেন।

কিরীটেশ্বরী মন্দির

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কিরীটকণা গ্রামে এই দেবী কালীর বিশিষ্ট মন্দির অবস্থিত। এই পবিত্র স্থানে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর কিরীট অর্থাৎ মাথার মুকুটের একটি কণা পতিত হয়েছিল। এই স্থানটি ৫১ শক্তিপীঠের একটি, তবে এই নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। যেহেতু দেবী সতীর শরীরের কোন অঙ্গ এই স্থানে পতিত হয়নি তাই অনেক তান্ত্রিক এই স্থানটিকে পূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে গণ্য করেন না, তাঁরা এই স্থানটিকে উপপীঠ বলেন।

এখানকার বর্তমান মন্দিরটি খুব বেশি প্রাচীন নয়। এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ পূজিত হয় না। এখানে একটি উঁচু পাথরের উপর বেদী তৈরি করা আছে, সেই বেদীর উপরে আরও একটি ছোট বেদী আছে যা দেবীর কিরীট রূপে পূজিত হয়। এই মন্দিরে দেবী ‘বিমলা’ নামে এবং তাঁর ভৈরব ‘সম্বর্ত’ নামে পূজিত হন।

এখানে মূল মন্দির সংলগ্ন অনেক ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার মন্দির চত্বরে মেলা বসে যেখানে মায়ের অজস্র ভক্তদের সমাগম ঘটে।

কঙ্কালীতলা মন্দির

হিন্দুধর্মের শাক্ত মতে কঙ্কালীতলা মন্দির পবিত্র তীর্থ শক্তিপীঠগুলির অন্যতম। এই পবিত্র পীঠস্থানটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকটে অবস্থিত। দেবী দাক্ষায়ণী সতীর শরীরের কোন অংশ এই স্থানে পতিত হয়েছিল সেই নিয়ে বহু মতভেদ আছে। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে এই স্থানে দেবী সতীর অস্থি পতিত হয়েছিল, আবার ভারতচন্দ্রের রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী দেবী সতীর কটিদেশ অথবা কোমর পতিত হয়েছিল।

এখানে দেবী ‘গর্ভাদেবী’ নামে ও তাঁর ভৈরব ‘রুরু’ নামে পূজিত হন। মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ডে কয়েকটি প্রস্তরখণ্ড আছে যেইগুলিকে তান্ত্রিকরা দেবীর দেহাংশ বলে মনে করেন।

কঙ্কালীতলা গুপ্ত তন্ত্র সাধনার জন্য প্রসিদ্ধ এবং এই স্থানের সাথে জড়িয়ে আছে বহু অলৌকিক কাহিনী।

সিঙ্গুরের ডাকাত কালী মন্দির

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সিঙ্গুরের নিকট পুরুষোত্তমপুরে এই প্রসিদ্ধ কালী মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সম্বন্ধে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি এবং এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা কে সেই নিয়েও বহু মতভেদ আছে। অনেকের মতে এই মন্দিরটি ডাকাত সনাতন বাগদী নির্মাণ করেছিলেন, আবার অনেকে মনে করেন ডাকাত গগন সর্দার এই মন্দিরের নির্মাতা, আবার লোকমুখে এই কথাও শোনা যায় যে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রঘু ডাকাত।

এই মন্দিরে দেবী কালী ‘সিদ্ধেশ্বরী’ নামে পূজিত হন। অতীতে এই মন্দিরে নরবলির প্রথা ছিল।

শেওড়াফুলির নিস্তারিণী কালীবাড়ি

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শেওড়াফুলির সাথে আমার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। শেওড়াফুলি আমার জন্মস্থান এবং এই জায়গাটির সাথে আমার ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সমস্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার এই পুণ্য তিথিতে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে নিস্তারিণী কালী মন্দিরে। এই দিনে এখানে ছাগবলির রীতি প্রচলিত আছে।

ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় শেওড়াফুলি রাজবংশের রাজা হরিশচন্দ্র রায় ১৮২৭ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসের  কোন এক শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে গঙ্গার তীরে তিনি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নিস্তারিণী কালী মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসনে একটি তামার পদ্মাসনের উপর কষ্টিপাথরের দক্ষিণা কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত।

এখনও শেওড়াফুলির রাজপরিবারের সদস্যরাই দেবসেবা এবং মন্দির পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্বভার বহন করে চলেছেন।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: