লক্ষ্মী পূজার তাৎপর্য ও আচার অনুষ্ঠান

পশ্চিমবাংলায় প্রতিটি হিন্দু ঘরে বহু প্রাচীন কাল থেকে কোজাগরী পূর্ণিমার এই দিনে সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা হয়ে আসছে। শারদীয় দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আয়োজন করা হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে দেবী লক্ষ্মী মর্ত্যে আবির্ভূতা হন। কোজাগরী শব্দটির অর্থ ‘কে জাগরী' অর্থাৎ ‘কে জেগে আছে'। কথিত আছে যারা কোজাগরী পূর্ণিমায় রাত জেগে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করেন তাদেরকে দেবী লক্ষ্মী ধন সম্পদ প্রদান করেন। মোট ১৬ প্রকার সম্পদ প্রদান করেন মা লক্ষ্মী- খ্যাতি, জ্ঞান, সাহস ও শক্তি, জয়, সুসন্তান, বীরত্ব, স্বর্ণ, অন্যান্য রত্নরাজি, শস্য, সুখ, বুদ্ধি, সৌন্দর্য, উচ্চাশা, উচ্চ ভাবনা, নৈতিকতা, সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবন।

ভিন্ন রূপে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা

মূর্তি

মাটি দিয়ে দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা গড়ে সেই মূর্তির পূজা করা হয়।

আড়ি লক্ষ্মী

বেতের তৈরি ছোট চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার উপর দুটি কাঠের তৈরি লম্বা সিঁদুর কৌটো লাল চেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হয়। দেবীর এই রূপকেই আড়ি লক্ষ্মী বলা হয়।

কলার বের

কলার বাকলকে নতুন নারকেল কাঠি দিয়ে গোল করে আটকে তার মধ্যে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কন করা হয় এবং এর ভিতরে নিছনি রাখা হয়। কাঠের আসনের উপরে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ চিত্রণ করে তার উপরে এই রকম ৯টি চোঙা রাখা হয়। এই ৯টি বাকলের মধ্যে পঞ্চ শস্য দিয়ে অবশেষে শীষ যুক্ত নারকেল রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে বৌ সাজিয়ে দেবী লক্ষ্মীর রূপ দেওয়া হয়।

সপ্ততরী

নবপত্রিকা বা কলার পেটোর তৈরি নৌকাকে দেবী লক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। ইহাকেই সপ্ততরী বলা হয়। এই তরীকে বাণিজ্যের নৌকা হিসাবে কল্পনা করা হয়। এই সপ্ততরীর মধ্যে অনেকে টাকা, পয়সা, কড়ি, চাল, ডাল, হরিতকী, হলুদ সাজিয়ে রাখেন। বহু হিন্দু গৃহস্থে এখনও এই নৌকা তৈরি করা হয়, যদিও বর্তমানে বাজারেও এই নৌকা কিনতে পাওয়া যায়।

লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘট

লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটের মধ্যে চাল বা জল ভরে সেটিকে দেবী লক্ষ্মী রূপে কল্পনা করে অনেকে তাঁর পূজা করেন।

লক্ষ্মী সরা

পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে বহু হিন্দু গৃহস্থে লক্ষ্মী সরাকে পূজা করা হয়। এই সরার মধ্যে লক্ষ্মী ও তাঁর বাহন পেঁচা, জয়া-বিজয়া সহ নানান হিন্দু দেব-দেবীর চিত্র অঙ্কন করা হয়। পূর্ববাংলার ঢাকা, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলায় এই লক্ষ্মীসরার বিশেষ প্রচলন ছিল। অঞ্চল বিশেষে লক্ষ্মী সরার কয়েকটি নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন ঢাকাই সরা, সুরেশ্বরী সরা ইত্যাদি। দেশ ভাগের পর ভারতবর্ষে মূলত পশ্চিমবাংলার নদীয়ার তাহেরপুর, নবদ্বীপ এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্মী সরা অঙ্কন করা হয়। প্রাচীনকালে এই চিত্রণের কাজে আচার্য ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা নিযুক্ত থাকতেন। বর্তমানে কুম্ভকার, সূত্রধর ও পটুয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাও লক্ষ্মী সরা চিত্রণের কাজ করে থাকেন।

লক্ষ্মী পূজায় আলপনার তাৎপর্য

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলার একটি প্রাচীন লোকচিত্র ‘আলপনা'। কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা বাংলা, প্রতিটা বাঙালি বাড়ি সেজে ওঠে আলপনায়। এই পূজার দিনে সারা বাড়ি জুড়ে বিভিন্ন ধরণের নকশার সাথে সাথে ধানের ছড়া, মুদ্রা ও দেবী লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ অঙ্কন করা হয়। এই প্রতীকগুলির মাধ্যমে লক্ষ্মী পূজার মহত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শস্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় এই বিশেষ ধরণের আলপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।

ভিন্ন ধর্মে দেবী লক্ষ্মী

শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মেই নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও দেবী লক্ষ্মীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ ‘অভিধানপ্পদীপিকা'-তে তাঁকে সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে এবং ‘শালিকেদার' ও  ‘সিরি-কালকন্নি' জাতকে তাঁকে সৌভাগ্য ও জ্ঞানের দেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবী লক্ষ্মী বৌদ্ধতন্ত্রে বসুধারা নামে পূজিত হতেন। অপর দিকে জৈন ধর্মে কথিত আছে যে মহাবীরের মাতা ত্রিশলা যে রাত্রে তাঁকে স্বপ্নে ধারণ করেছিলেন, সেই রাত্রেই তিনি গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা

পশ্চিমবাংলায় লক্ষ্মী পূজার আচার অনুষ্ঠান অন্যান্য রাজ্যের থেকে সামান্য ভিন্ন। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ জায়গায় শুক্রবার দেবী লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে উপবাস রাখা হয় এবং তাঁর আরাধনা করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় অনেক হিন্দু ঘরে প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মী পূজা করা হয়। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বেশ ধূমধাম করে পালিত হলেও উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মূলত ধনতেরাস-দেওয়ালি তিথিকে কেন্দ্র করে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। শাস্ত্রজ্ঞদের মত অনুসারে যদি সারা বছরই ভক্তি সহকারে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা যায় তাহলে দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভের পথ সুগম হয়।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত লক্ষ্মী পূজার আচার সমূহ

হিন্দু শাস্ত্র মতে লক্ষ্মী পূজার নিম্ন লিখিত আচার অনুষ্ঠানগুলি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত আছে –

  • ঠাকুরের সিংহাসনে কড়ি এবং শঙ্খ রাখা গৃহের কল্যাণের জন্য খুবই শুভ মনে করা হয়।
  • দক্ষিণাবর্ত শঙ্খকে দেবী লক্ষ্মীর শঙ্খ বলা হয়। লাল, সাদা অথবা হলুদ রংয়ের একটি পরিষ্কার কাপড়ে, একটি রুপার অথবা মাটির পাত্রের উপর এই শঙ্খটিকে রাখতে হয়। এই শঙ্খের মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ বাসস্থানে প্রবাহিত হয়।
  • প্রতিদিন দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা অথবা পটের সামনে দু'টি ঘি-এর প্রদীপ জ্বালালে তাতে সংসারের মঙ্গল হয়। তার সাথে পদ্মফুল, নারকেল ও ক্ষীরের নৈবেদ্য প্রদান করলে দেবী লক্ষ্মী প্রসন্ন হন।
  • একটি বাঁশের তৈরি বাঁশিকে রেশমের কাপড়ের মধ্যে জড়িয়ে মা লক্ষ্মীর সিংহাসনে রাখলে তিনি প্রসন্ন হন, কারণ বাঁশি ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রী কৃষ্ণের অতি প্রিয় একটি জিনিস। সেই কারণে বাঁশি দেবী লক্ষ্মীরও খুবই প্রিয়।
  • প্রতিদিন দেবী লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন অঙ্কন করলে সেটি খুবই শুভ মনে করা হয়। যদি তা প্রতিদিন অঙ্কন করা সম্ভব না হয়, তাহলে বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার এবং লক্ষ্মী পূজার তিথিতে অতি অবশ্যই অঙ্কন করতে হবে।
  • প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার যদি কোন ব্যক্তি পরমান্ন দিয়ে গোসেবা করেন তবে তাঁর উপর মা লক্ষ্মী প্রসন্ন হন।
  • কথিত আছে তুলসী বৃক্ষে সমস্ত দেবতাদের বাস, আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী দেবী তুলসীই হলেন মা লক্ষ্মীর অপর এক রূপ। তাই তুলসী বৃক্ষের সামনে প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালালে দেবী লক্ষ্মী তুষ্ট হন।
  • প্রতি শুক্রবার পদ্মমূল দিয়ে তৈরি নয়টি সলতে দিয়ে একটি মাটির প্রদীপ দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা বা পটের সামনে জ্বালালে তা গৃহে ধন সম্পদের প্রাচুর্য ঘটায়।
  • ধারাবাহিকভাবে টানা ১২ দিন ধরে দেবী লক্ষ্মীর দ্বাদশ স্তোত্র ভক্তি সহকারে ১২ বার উচ্চারণ করলে ঋণমুক্তি ঘটে।
  • প্রতিদিন স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ১০৮ বার লক্ষ্মী গায়ত্রী মন্ত্র জপ করলে দেবী লক্ষ্মী প্রসন্ন হন। এই মন্ত্র জপ করার সময় পদ্মবীজের মালা ব্যবহার করলে তা আরও ভালো ফল প্রদান করে বলে মনে করা হয়।
  • এছাড়া ধারাবাহিকভাবে টানা ৩০ দিন ধরে দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা বা পটের সামনে ভক্তিভরে শ্রী সুক্ত পাঠ করলে দেবী বিশেষ প্রসন্ন হন।

অঞ্চল বিশেষে লক্ষ্মী পূজার আচার অনুষ্ঠানে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভক্তরা নানা ভাবে বিভিন্ন নিয়ম মেনে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করেন। নিয়মের অনেক পার্থক্য থাকলেও সকলের  উদ্দেশ্য একই, তা হল দেবীকে প্রসন্ন করা। তাই ভক্তিভরে পবিত্র মনে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করলে আপনার সকল মনস্কামনা অবশ্যই পূরণ হবে।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: