পাহাড়কোল গ্রাম – সবুজায়নের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি।”

রবি ঠাকুরের এই কবিতায় তাঁর দূরদৃষ্টিতা প্রশংসনীয়। কবি অনেক দিন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন মানব সভ্যতার অগ্রগতি কোথাও প্রকৃতিকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। যদিও এখনও এমন কিছু মানুষ আছেন যারা প্রকৃতিকে মাতৃসমা মনে করেন এবং তাঁর রক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। 

এই রকমই একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছেন সাঁওতাল উপজাতির এক আদিবাসী মহিলা। একটি রুক্ষ প্রাণহীন টিলাকে সবুজায়নের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার পাহাড়কোল গ্রামের বাসিন্দা রিঙ্কু গোপ। এখানকার আদিবাসীদের বিশ্বাস এই পবিত্র টিলাটি তাদের দেবতা পাহাড়সেনের বিশ্রামস্থল।

একসময় ৪৪টি আদিবাসী পরিবার গ্রামের এই অনুর্বর টিলাটিতে বসবাস করতেন, যা বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে সবুজে মোড়া একটি স্বপ্নরাজ্যে পরিণত হয়েছে এবং বহিরাগতদের কাছে হয়ে উঠেছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখন এই টিলা হাজার হাজার পাখির আশ্রয়স্থল।

রিঙ্কু গোপ জানিয়েছেন যে “এখানে প্রত্যেকে বিশ্বাস করেন যে খারিফ মরসুমে কৃষকরা যখন ধান বপন করেন তখন আমাদের দেবতা আশীর্বাদ স্বরূপ কৃষিকার্য সুসম্পন্ন করার জন্য বৃষ্টি এনে দেন। প্রতিবছর আমরা আমাদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য পৌষ সংক্রান্তির সময় শীতকালীন ফসল কাটার উৎসবে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পূজা করি।”

পৌষ সংক্রান্তির সময় যখন সারা বাংলা পিঠে পুলির উৎসবে মেতে ওঠে, তখন পাহাড়কোল গ্রামের আদিবাসী মহিলারা পবিত্র পাহাড়ের চূড়ায় উঠে একটি মুরগির বলি দেন, তারপর বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার রান্না করে তাদের দেবতা পাহাড়সেনের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। 

পাহাড়কোল গ্রামের বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। গ্রামের অধিকাংশ কৃষকদের মতোই রিঙ্কু গোপ-এরও প্রায় দুই একর জমি রয়েছে। যেখানে গ্রীষ্মকালে তিনি মূলত ধান বপন করেন, এছাড়া শীতকালে টমেটো ও সরিষার চাষও তিনি করে থাকেন।

বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের বাঁকুড়া এবং তার সংলগ্ন পুরুলিয়া জেলার বেশির ভাগই লাল মাটি দ্বারা আবৃত অনুর্বর জমি। একমাত্র পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতই কৃষকদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। যদিও এখানে শিলাবতী নদীর ১০০ মিটারের মধ্যেই একটি বাঁধ অবস্থিত, তবে বাঁধটি জল দ্বারা পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। রিঙ্কু গোপ এও জানিয়েছেন যে তিনি খুবই খুশি কারণ টিলাটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর থেকেই এই বাঁধের জলস্তর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঊষরমুক্তি প্রকল্প

কেন্দ্রীয় সরকারের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইন ২০০৫ একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প যা দেশের গ্রামীণ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও জীবিকা প্রদানের প্রচেষ্টা করে, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঊষরমুক্তি প্রকল্পটি চালু করে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে বিস্তৃত মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গলমহল এলাকায় মূলত আদিবাসীরা বসবাস করেন। এই প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল জঙ্গলমহলের অনুর্বর জমিগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে এখানকার আদিবাসীদের নিযুক্ত করে তাদের জীবিকার সুযোগ করে দেওয়া। যার ফলে কাজের সন্ধানে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিবাসন হ্রাস পাবে।

“প্রদান” নামক একটি বেসরকারি সংস্থা এই প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করতে বাঁকুড়ায় রাজ্য সরকারের সাথে কাজ করে পাহাড়ি এলাকার ৯.৫ হেক্টর জমি পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করেছে।

২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে পাহাড়কোল টিলা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়িত করার জন্য জোর কদমে কাজ শুরু হয়েছিল। টিলাটিতে সোনাঝুরি গাছের চারা রোপণের পাশাপাশি আশেপাশের পতিত জমিগুলিতে আম গাছের চারাও  রোপণ করা হয়েছিল।

২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২ সালে পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণের কাজ কিছুটা এগিয়েছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে আরও কিছু বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা চলছে। বর্তমানে ১০ হেক্টর জমির উপর আম বাগান গড়ে উঠেছে যার আওতায় ৩ হাজার ৬০০টি আম গাছ রয়েছে। ৬০ হেক্টর জমির উপরে ১৫ হাজারেরও বেশি আম গাছ লাগানো হয়েছিল যা নষ্ট হয়ে গেছে।

নীলাদ্রি গিরি নামক “প্রদান”-এর এক কর্মী জানায় যে সোনাঝুরি গাছ থেকে মাত্র ৫-৬ বছরের মধ্যে পূর্ণতাপ্রাপ্ত কাঠ পাওয়া যায়, যা সেখানকার বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে খুবই সাহায্য করবে। যারা এই টিলা পুনরুদ্ধারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন তারা মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইন- এর অধীনে সরকারের তরফ থেকে মজুরি পেয়েছেন।

টিলা সবুজায়ন ও মৃত্তিকা ক্ষয় রোধে পাহারকোলবাসীর অবদান

বাঁকুড়া জেলার হিড়বাঁধ ব্লকে অবস্থিত পাহাড়কোল টিলাটিতে ৩ বছর আগেও গাছপালার কোন চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না, এর ফলে আলগা মাটি ও নুড়ি নিচের দিকে গড়িয়ে এই টিলার পাদদেশে অবস্থিত কৃষিজমিতে জমতে থাকে যার কারণে এই জমিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।

কৃষকদের জমি রক্ষার জন্য ২০১৮ সাল থেকে এই টিলাটির পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়। সামাজিক বনসৃজনের নিয়ম অনুসরণ করে সরকারের ঊষরমুক্তি প্রকল্পের অধীনে রিঙ্কু গোপ সহ অন্যান্য গ্রামের বাসিন্দারা পরিখা খননের কাজ শুরু করেন এবং মাটির ক্ষয় রোধ করার জন্য ১৪,০০০ এরও বেশি সোনাঝুরি গাছের চারা রোপণ করেন।

এই প্রজাতির গাছটি বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ এটির বৃদ্ধির জন্য খুবই অল্প পরিমাণ জলের প্রয়োজন হয় এবং এই গাছটি শুষ্ক এলাকার জন্য আদর্শ। রিঙ্কু গোপ জানিয়েছেন “এই টিলাটিতে বৃক্ষরোপণ করায় সম্পূর্ণ এলাকার মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে মাটির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়েছে।” এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী বেসরকারি সংস্থা “প্রদান” রিঙ্কু গোপকে বৃক্ষরোপণ সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে।

বর্তমানে এই টিলাটিতে ভারতীয় ময়না, ঘুঘু, এশিয়ান কোয়েল এবং ঈগল সহ বহু প্রজাতির পাখিদের দেখা মেলে। এছাড়া এই টিলাটি গবাদি পশুদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে তারা খাদ্য অন্বেষণ করতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়।

একবার এই টিলায় আগুন লেগে যায় এবং সেই সময় গ্রামের প্রতিটি আদিবাসী সেই আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ছুটে গিয়েছিলো টিলার উপরে। তাদের রোপণ করা বৃক্ষগুলির প্রতি সমগ্র সম্প্রদায়ের সুরক্ষামূলক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল এই ঘটনাটির মাধ্যমে। এই সমগ্র ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন রিঙ্কু গোপ-এর বন্ধু বাসতি মান্ডি।

সামাজিক বনসৃজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল কৃষিক্ষেত্রকে মৃত্তিকা ক্ষয় ও প্রচণ্ড বায়ুপ্রবাহের হাত থেকে রক্ষা করা। সামাজিক বনসৃজন নিয়ে সর্বপ্রথম যে সমস্ত দেশগুলি গবেষণা শুরু করেছিল তাদের মধ্যে ভারত একটি। ১৯৭৬ সালে ভারতের জাতীয় কৃষি কমিশন এর সম্মেলনে প্রথম সামাজিক বনসৃজন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল।

ভারতের মধ্যে তেলেঙ্গানা, মেঘালয় ও ভারতের বাইরে ভিয়েতনামে পাহাড়ি অঞ্চলে বনায়নের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। তবে বাঁকুড়া জেলার ক্ষেত্রে বনায়নের কারণ একটু আলাদা। কৃষিকার্যই বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড হওয়ায় পাহাড়কোলের কৃষিজমিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল এখানে বনায়নের প্রধান উদ্দেশ্য।

পাহাড়কোল বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমার গুনিয়াদা গ্রামের অন্তর্গত। মহকুমা আধিকারিক মৈত্রী চক্রবর্তী খুবই খুশি হয়েছেন পাহাড়কোল টিলার পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের সফলতা দেখে। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে আদিবাসী গ্রামটিতে মৃত্তিকা ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে বহু দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক খুবই উপকৃত হয়েছেন। গোটা বাঁকুড়া জেলায় জলের সঙ্কট কৃষিকাজকে কঠিন করে তুলেছিল। তবে এখন পাহাড়কোল টিলা পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টা এখানকার ভূগর্ভস্থ জলের স্তর অনেক গুন বৃদ্ধি করে কৃষকদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। নীলাদ্রি গিরি এও জানিয়েছেন যে “পুরো গ্রামে আগে হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র গাছ ছিল। প্রায় ১৭০ জন পুরুষ ও মহিলা আদিবাসী আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছেন। তাদের সহায়তায় শুধুমাত্র টিলাতেই নয় তার সাথে খরা-প্রবণ উচ্চভূমিগুলিতেও বৃক্ষরোপণ করা সম্ভব হয়েছে।”  

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: