রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য
বিশ্বের যেকোনো জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড সেই জাতির কবি ও সাহিত্যিক। তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে পৌঁছে যায় জ্ঞানের আলো। বাংলার কবি ও সাহিত্যিকদের অমূল্য সৃষ্টি সমগ্র বাঙালি জাতির উৎকৃষ্টতার পরিচয় বহন করে। আর সেই বাঙালি জাতির মননে ও কৃষ্টিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্যের একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব কালজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তিনি বাংলা সাহিত্যে ইউরোপিয়ান সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান যোগ করে তাতে নিয়ে এসেছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তিনি এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ দেশ কালের ঊর্ধ্বে, তিনি বিশ্বমানবের। তাঁর রচিত সাহিত্য শুধু ভারতবাসীকে নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ‘গুরুদেব', ‘কবিগুরু' ও ‘বিশ্বকবি' অভিধায় ভূষিত হয়েছেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, সংগীতস্রষ্টা, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা, চিত্রকর ও দার্শনিক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আজকে আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষা জীবন
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে লেখার আগে তাঁর জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে দু'চার কথা না বললেই নয়।
কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (৭মে, ১৮৬১ সাল) জন্মগ্রহণ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মগুরু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান ছিলেন।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দেশ ভ্রমণের নেশার কারণে বছরের অধিকাংশ সময়ই কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। মাতৃবিয়োগ ও পিতার বেশিরভাগ সময় বাড়িতে অনুপস্থিত থাকার দরুন রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবন কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনেই।
তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছু দিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। বিদ্যালয় শিক্ষায় অনাগ্রহী রবীন্দ্রনাথ বাড়িতেই গৃহ শিক্ষকের নিকট হইতে জ্ঞান অর্জন করেন।
১৮৭৮ সালে পড়াশোনা করতে তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। সেখানে তিনি ব্রাইটনের পাবলিক স্কুলে কিছুদিন এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেনরি মর্লির নিকট তিন মাস ইংরেজি সাহিত্য চর্চা করেন। তবে ১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডের শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তারপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও তা আর হয়ে ওঠেনি।
১৮৮৩ সালে ভবতারিণীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পরে রবীন্দ্রনাথ ভবতারিণীর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর মোট পাঁচটি সন্তান ছিল। তারা হলেন: মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ।

বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বাংলা কবিতায় তাঁর অবদানের কথা উঠে আসে। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করেছিলেন। প্রথমে তিনি সাধু ভাষা বেছে নিয়েছিলেন কাব্য রচনা করার জন্য। তবে পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতাগুলিতে চলিত ভাষার প্রয়োগও লক্ষ্য করা গেছে। তিনি তাঁর লেখা কবিতায় এক পর্যায়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন আধুনিকতাকে, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি উপলব্ধি করেন ছন্দ ও লয় বিহীন কাব্য পাঠক নন্দিত নাও হতে পারে। তাই তিনি তাঁর পূর্বের ধারায় ফিরে আসেন।
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য মানেই সকলের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম ‘গীতাঞ্জলি'। এই গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘সং অফারিংস' গ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে প্রথম এশীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। গীতাঞ্জলি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী', ‘কল্পনা', ‘চিত্রা', ‘বলাকা', ‘মহুয়া', ‘চৈতালি', ‘পূরবী', ‘সেঁজুতি', ‘ভগ্ন হৃদয়', ‘পুনশ্চ', ইত্যাদি প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থগুলি রচনা করেন। তাঁর কাব্যের মধ্যে যেমন রয়েছে রোম্যান্টিকতা ঠিক তেমনই রয়েছে জীবনবোধ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মাধ্যমে আমাদের পরিচয় ঘটে বাস্তবতার সাথে। সব মিলিয়ে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের অবদান অতুলনীয়।

বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। তিনি মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট'। তারপর তিনি ‘রাজর্ষি', ‘চোখের বালি', ‘নৌকাডুবি', ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ', ‘গোরা', ‘ঘরে বাইরে', ‘চতুরঙ্গ', ‘যোগাযোগ', ‘শেষের কবিতা', ‘দুই বোন', ‘মালঞ্চ' ও ‘চার অধ্যায়' উপন্যাসগুলির রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট উপন্যাসগুলি শুধু বাংলা সাহিত্যকেই নয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতকেও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বাংলা ছায়াছবি ‘ঘরে বাইরে'। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি' এবং ‘চতুরঙ্গ' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির মাধ্যমে কবিগুরু চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান অর্জন করে নিয়েছেন।
বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথের জীবনে যা কিছু তাঁর কবি মনকে আলোড়িত করেছিল তাই নিয়েই তিন বহু ছোটগল্প রচনা করেছিলেন। ছোটগল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই পাঠক মনে দোলা দিতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলি মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত হত। বিভিন্ন পর্বে তাঁর লেখা মোট চুরাশিটি ছোটগল্প নিয়ে ‘গল্পগুচ্ছ' নামক গল্প সংকলনটি রচিত হয়। এই গল্প সংকলনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্প হল ‘কঙ্কাল', ‘নিশীথে', ‘মণিহারা', ‘ক্ষুধিত পাষাণ', ‘নষ্টনীড়', ‘হৈমন্তী', ‘স্ত্রীর পত্র', ‘কাবুলিওয়ালা', ‘মুসলমানীর গল্প', ‘দেনাপাওনা' ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের লেখা একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে বহু চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘পোস্টমাস্টার', ‘মণিহারা' ও ‘সমাপ্তি' অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত বাংলা ছায়াছবি ‘তিন কন্যা' এবং ‘নষ্টনীড়' অবলম্বনে ‘চারুলতা', তপন সিংহের পরিচালনায় নির্মিত ‘অতিথি', ‘কাবুলিওয়ালা' ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ', পূর্ণেন্দু পত্রীর পরিচালনায় নির্মিত ‘স্ত্রীর পত্র' ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলির মাধ্যমে সামাজিক ভেদাভেদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ভেঙে এক সুন্দর সমাজ গঠনের নিরলস প্রচেষ্টা করেছেন। যে কারণে তার ছোটোগল্পগুলি প্রতিটি পাঠকের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

বাংলা নাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথের নানাবিধ প্রতিভার মধ্যে নাটক রচনা ও একই সাথে সেই নাটকে তাঁর অভিনয় দক্ষতা বাঙালি সহ সমগ্র ভারতবাসীকে অভিভূত করেছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে তাঁর নাট্যাভিনয়ের হাতেখড়ি হয়। কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য রচনায় তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা বাংলা সাহিত্যের উষ্ণীষে সংযোজন করেছে বহু রঙিন পালক।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম গীতিনাট্য ‘বাল্মীকিপ্রতিভা' মঞ্চস্থ হয় ১৮৮১ সালে। তারপর একের পর এক অসাধারণ গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য ও নৃত্যনাট্য তিনি আমাদের উপহার হিসেবে দিয়ে গেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল ‘রাজা ও রাণী', ‘বিসর্জন', ‘চিত্রাঙ্গদা', ‘মালিনী', ‘বৈকুণ্ঠের খাতা', ‘চিরকুমার সভা', ‘শারদোৎসব', ‘ডাকঘর', ‘অচলায়তন', ‘মুক্তধারা', ‘রক্তকরবী', ‘ফাল্গুনী', ‘নটীর পূজা', ‘কালের যাত্রা', ‘শাপমোচন', ‘চণ্ডালিকা', ‘তাসের দেশ' ইত্যাদি।

বাংলা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গেলে পরিশেষে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের কথা না বললে আমার এই প্রবন্ধটি অসমাপ্ত থেকে যাবে।
প্রবন্ধ রচনায় রবীন্দ্রনাথের অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বড় স্থান দখল করে আছে। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই সমস্ত প্রবন্ধে সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানান বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধ হল ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম', ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি', ‘রাশিয়ার চিঠি', ‘নবযুগ', ‘কালান্তর', ‘বৃহত্তর ভারত', 'নারী', ‘হিন্দু-মুসলমান', ‘শূদ্রধর্ম', ‘কংগ্রেস', ‘চরকা', ‘সভ্যতার সংকট' ইত্যাদি।
আমরা ধন্য যে এই বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রনাথের ন্যায় প্রতিভাবান কবির জন্ম হয়েছিল। যতদিন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন কবিগুরু বাঙালির জ্ঞানে, কর্মে ও সাধনার মধ্যে জীবিত থাকবেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে আমি আমার প্রবন্ধটিতে ইতি টানলাম।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Pingback: সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য - Kuntala's Travel Blog