সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য
বাংলা সাহিত্য জগতে ইন্দ্রপতন। গত ৮ই মে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় লিখে গিয়েছেন বহু গল্প এবং উপন্যাস। তবে শুধু গল্প বা উপন্যাসই নয়, প্রবন্ধ এবং সমালোচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছে বাস্তবতার সাথে। ধর্ম, সংস্কার, রাজনীতি, দেশ ও সমাজ নিয়ে তাঁর লেখাগুলি আমাদের সামনে ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। তাঁর লেখার মধ্যে ছিল অবারিত স্পষ্টতা। সহজ সরল আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে তাঁর অসাধারণ লেখনী পাঠক মনে গভীর আঁচড় কেটেছে। নশ্বর জীবন ছেড়ে অবিনশ্বরতার পথে যাত্রা করলেও সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য চির অমর হয়ে থাকবে পাঠক মনে।
আজকে জীবনশিল্পী সমরেশ মজুমদারের স্মরণে তাঁর বিপুল সৃষ্টিসম্ভার থেকে কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে আমি আলোচনা করব।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
১৯৪৪ সালের ১০ই মার্চ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গয়েরকাটায় কৃষ্ণদাস মজুমদার এবং শ্যামলী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। তাঁর জন্মকালে সমগ্র দেশ জুড়ে চলছিল উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলন, বাতাসে ম-ম করছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পোড়া গন্ধ। যার প্রভাব পড়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলেও। এমন একটি সময়ে সমরেশ মজুমদারের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে উত্তরবঙ্গের বুকে। তাঁর কলমে বার বার তাই ঘুরেফিরে এসেছে সেই উত্তরবঙ্গের অনন্য সৌন্দর্য। পাঠকের চোখে তিনি তুলে ধরেছেন সেখানকার অলি গলির স্পষ্ট ছবি।
জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় আসেন। তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
উত্তরবঙ্গের মফস্বলে জন্ম হলেও তাঁর জীবনের একটি বৃহৎ অধ্যায় জুড়ে রয়েছে শহর কলকাতা। তিনি শহরের মানুষের জীবনের বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই তাঁর গল্পের ক্যানভাসে প্রতি নিয়ত ধরা পড়েছে সেই চিরপরিচিত শহরের মানুষগুলি। মূলত উত্তরবঙ্গ ও কলকাতার সীমানা ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অমর সাহিত্য।
সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য চর্চা
সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য বাঙালির কাছে এক অমূল্য সম্পদ। প্রথম জীবনে তিনি গল্প বা উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেননি, তাঁর সমস্ত ভাবনা চিন্তা ছিল নাটক-কেন্দ্রিক। প্রথমে তিনি নাটক লেখার চেষ্টা করেছিলেন, যার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর লেখা প্রথম গল্প ‘অন্তর আত্মা'। এই গল্প দিয়েই সূচনা হয় তাঁর লেখক জীবনের। ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় তাঁর এই গল্পটি ছাপা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ‘গৌচপ্রম' ছদ্মনামে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়' প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায়। অনিমেষ নামক একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে সমরেশ মজুমদারের রচিত ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার', ‘কালবেলা', ‘কালপুরুষ' তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়। যদিও এটিকে ট্রিলজি বললে ভুল বলা হবে, এই সিরিজের চতুর্থ ও শেষ উপন্যাসটি হল ‘মৌষকাল'। এই চারটি উপন্যাস ‘অনিমেষ চতুষ্ক' নামে খ্যাত।
তবে মৌষকাল উপন্যাসটি সেইভাবে পাঠক মনে সাড়া জাগাতে পারেনি। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘সাতকাহন', ‘তেরো পার্বণ', ‘গর্ভধারিণী', ‘ভিক্টোরিয়ার বাগান', ‘স্বপ্নের বাজার', ‘অগ্নিরথ', ‘আট কুঠুরি নয় দরজা' ইত্যাদি। সমরেশ মজুমদারের সৃষ্টি বিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা চরিত্র ‘অর্জুন' পাঠক মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। রুপোলি পর্দাতেও এই চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বাংলা সিনেমা। এছাড়াও সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা' ও ‘বুনো হাঁসের পালক' অবলম্বনেও নির্মাণ হয়েছে বিখ্যাত বাংলা ছবি। শুধুমাত্র রুপোলি পর্দাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁর সৃষ্টি, ছোট পর্দাতেও তিনি তাঁর ছাপ রেখে গিয়েছেন। বাংলা সিরিয়ালের আদিপর্বে সমরেশ মজুমদারের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘তেরো পার্বণ' বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
সমরেশ মজুমদার তাঁর সাহিত্য জীবনে বহু সংখ্যক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস কালবেলার জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তারও আগে ১৯৮২ সালে তিনি পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার। তাঁকে ২০০৯ সালে ‘কলিকাতায় নবকুমার'- এর জন্য বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল। যদিও সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি পুরস্কার দিয়ে মাপা কখনই সম্ভব নয়।
সমরেশ মজুমদারের কিছু অমর সৃষ্টি
চলুন তাহলে আর দেরি না করে সমরেশ মজুমদারের সৃষ্ট সাহিত্য সম্ভার থেকে অবশ্যপাঠ্য কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলা যাক।
উত্তরাধিকার
সমরেশ মজুমদার এবং তাঁর সাহিত্য বলতে প্রথমেই যে নামটি উঠে আসে সেটি হল জনপ্রিয় অনিমেষ সিরিজ। আর এই অনিমেষ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার'। এই উপন্যাসে বাম ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে নকশালবাড়ি আন্দোলনের কাহিনী আমাদের মনে উত্তাল সত্তরের দশকের একটি স্পষ্ট ছবি এঁকে দিয়েছে। সমরেশ মজুমদারের এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র অনিমেষ আমাদের পরিচয় করিয়েছে সত্তরের স্বপ্ন দেখা প্রজন্মের সাথে। অনিমেষের উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল এলাকা থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসা, সত্তরের অগ্নিগর্ভ কলকাতার সাথে তার পরিচিতি ও তার আত্ম-অনুসন্ধানের কাহিনীই উত্তরাধিকার।

কালবেলা
অনিমেষ সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কালবেলা'। উত্তরাধিকার উপন্যাসটিতে অনিমেষকে বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণাহীন সহজ সরল এক তরুণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, আর তার পরবর্তী উপন্যাসে সেই তরুণকেই দেখা গিয়েছে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়তে। অনিমেষ বুঝতে পারে আদর্শ ও বাস্তবতার পার্থক্য। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে থাকে হতাশা। তারপর অনিমেষের জীবনে আবির্ভাব ঘটে মাধবীলতার। মাধবীলতা অনিমেষের জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। অনিমেষের জীবনের সমস্ত প্রতিকূল মুহূর্তে সে পাশে পেয়েছে মাধবীলতাকে। তারা প্রমাণ করে দিয়েছে বিপ্লব ও প্রেম সবসময় পরস্পরবিরোধী হয় না, একে অপরের পাশে থেকে হাতে হাত ধরে সমস্ত কঠিন পরিস্থিতিকেই জয় করা যায়।

কালপুরুষ
অনিমেষ সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস ‘কালপুরুষ'। কাল বদলের পালায় বদলেছে অনেক কিছু। অনিমেষ ও মাধবীলতা এই দুই জনপ্রিয় চরিত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের পুত্র অর্ক। নিজের আদর্শে পুত্রকে গড়তে চেয়েছিল অনিমেষ। কিন্তু সমকালীন অন্তঃসারহীন কুটিল রাজনীতি এবং পঙ্কিল সমাজব্যবস্থার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে অর্ক হয়ে ওঠে অন্ধকার অসামাজিক রাজত্বের প্রতিনিধি। তবে অনিমেষের আদর্শবাদ এবং মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতা যে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান তার বোধোদয় ঘটতেও বিলম্ব হয়নি। অর্কের আত্মোপলব্ধির কাহিনী এই উপন্যাসকে এক আলাদাই মাত্রা এনে দিয়েছে।
সমরেশ মজুমদার এই ট্রিলজির মাধ্যমে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি নিখুঁত ছবি তুলে ধরেছিলেন।

অগ্নিরথ
উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষের গল্প যেমন মানুষের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেইরকমই অগ্নিরথ মানুষকে ভুলতে দেয়নি সায়ন ও এলিজাবেথের শেষ পরিণতির কথা। সমরেশ মজুমদারের অন্যতম সেরা সৃষ্টিগুলির মধ্যে একটি ‘অগ্নিরথ'। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান সায়ন ও পরহিতৈষী বিদেশিনী নারী এলিজাবেথকে কিভাবে দুর্বৃত্তের আগুন গ্রাস করে নেয় তারই কাহিনী অগ্নিরথ।

সাতকাহন
সমরেশ মজুমদারের আরও এক পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী উপন্যাস ‘সাতকাহন'। এই গল্প দীপাবলির হলেও বহু অসহায় নারীর কথা তিনি তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসটির মাধ্যমে। এখনও আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত মেয়েদের সম্মুখীন হতে হয় বহু বাধার, শুধু সমাজ বললে ভুল হবে নিজের পরিবার-পরিজনও যেন জীবনের প্রতিকূলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দীপাবলিও সেই একই পথের পথিক। শত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ও বিরহ দহন সত্ত্বেও স্থির সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ক্ষমতা রাখে সমরেশের এই চরিত্রটি। এখনও বহু নারী দীপাবলি হতে চায়, চায় অগ্নি বলয় অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। সমরেশ মজুমদারের সৃষ্ট সমস্ত কাল্পনিক চরিত্রগুলির মধ্যে দীপাবলি অনন্য।

সমরেশ মজুমদারের লেখায় তাঁর পাঠকেরা কোথাও না কোথাও নিজের জীবনের গল্প খুঁজে পায়, তাই তো তিনি সব মানুষের কথাকার। সেই কথাকারকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের মতো আমি আমার লেখায় ইতি টানলাম।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Pingback: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য - Kuntala's Travel Blog