বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য
“প্রার্থনা কো'রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।”
কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য মানেই বিদ্রোহ। উত্তাল মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রামে যখন সমগ্র ভারতবর্ষ মেতে উঠেছে ঠিক সেই সময় দৃপ্ত কণ্ঠে বিদ্রোহের বাণী নিয়ে বাংলা কাব্য জগতে আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী পরাধীন ভারতবর্ষের প্রতিটি বাঙালিকে মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেছিল। তাঁর সাহিত্যকর্ম প্রতিনিয়ত সমাজের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরেছে। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও সৈনিক।
পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যিনি নিজের কলম তুলে নিয়েছিলেন আজ সেই বিদ্রোহী কবির ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আজকে আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য।

জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও বিবাহ
কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে তাঁর জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় সম্বন্ধীয় কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। বাল্যকালে নজরুলকে ‘দুখু মিয়া' নামে ডাকা হত। ১৯০৮ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতৃবিয়োগ তাঁর জীবনে নিয়ে আসে চরম দারিদ্র্য। অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছিল তাঁর শৈশব।
কুমিল্লার দৌলতপুরের এক প্রকাশক আলী আকবর খানের ভাগ্নি নার্গিস আসার খানম ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী। আলী আকবর নজরুলকে ঘরজামাই হওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় তিনি বাসর রাতেই কুমিল্লা ত্যাগ করে চলে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি কুমিল্লা নিবাসী আশালতা সেনগুপ্তের সহিত পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর নজরুল তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নতুন নামকরণ করেন প্রমীলা।

শিক্ষাজীবন
চুরুলিয়া গ্রামের মক্তবে মৌলবি কাজী ফজলে আহমদের নিকট নজরুল তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মেধাবী নজরুল বাল্যকালেই দর্শন, কুরআন ও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। মক্তবে অধ্যয়নকালে তিনি বাংলা ভাষার সাথে সাথে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষাতেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
মক্তবের পাঠ সাফল্যের সাথে শেষ করার পর অর্থাভাবের কারণে তিনি উচ্চতর শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারেননি। পিতার অকাল মৃত্যুতে অতি অল্প বয়সেই তাঁকে সংসারের হাল ধরতে হয়। নজরুলকে তাঁর অফুরান মেধাশক্তি ও বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য দক্ষতার কারণে উক্ত মক্তবে এই অল্প বয়সেই শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ করেন সেখানকার কর্তৃপক্ষ। এর সাথে সাথে তিনি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করতেন। যদিও তিনি মসজিদ ও মক্তবে বেশিদিন কাজ করেননি। লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি বাংলার রাঢ় অঞ্চলের ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলে (লেটো) যোগ দেন। এই নাট্যদল থেকেই নজরুলের সাহিত্য চর্চার সূচনা হয়। এই সময় তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সাথে তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি থেকেও জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। ‘চাষার সঙ', ‘শকুনি বধ', ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ', ‘দাতা কর্ণ', ‘কবি কালিদাস', ‘আকবর বাদশাহ', ‘রাজপুত্রের গান', ‘মেঘনাদ বধ' ইত্যাদি সেই সময়ে নাট্যদলে তাঁর রচিত কিছু জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। এছাড়াও তিনি বহু শ্যামা সঙ্গীতও রচনা করেছিলেন। মসজিদ, মাজার, মক্তব ও লেটো দল থেকে অর্জিত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে রসদ জুগিয়েছে।
লেটো দলের পালা শেষ করে নজরুল পুনরায় ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। তাঁর এই নতুন শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় বর্ধমান জেলার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপরে তিনি বর্ধমানের মাথরুন ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু অর্থাভাব সাময়িকভাবে তাঁর শিক্ষাজীবনে আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি পুনরায় কাজে নিযুক্ত হন। প্রথমে তিনি বাসুদেবের কবিদলে কিছুদিন কাজ করেন এবং পরে একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা হিসেবে নিযুক্ত হন। সবশেষে তিনি আসানসোলের একটি বেকারি ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেন। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত নজরুলের বাল্যকাল অসামান্য দুঃখ বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য একে অপরের সাথ ছাড়ে নি। সেই কঠিন সময়েও নজরুল লিখে গেছেন বহু কবিতা ও ছড়া। বেকারি ও চায়ের দোকানে কাজ করার সময় তাঁর এই কবি প্রতিভা নজরে আসে আসানসোলের দারোগা রফিক উল্লাহের। রফিক উল্লাহ তাঁকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। পরে তিনি পুনরায় রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এখানেই ইতি ঘটে এবং সুদূর রণাঙ্গনে সূচনা হয় সৈনিক জীবনের।

সৈনিক জীবন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাপর্বে ১৯১৭ সালে নজরুল ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন এবং ১৯২০ সালের মার্চ মাস অবধি করাচি সৈন্যাবাসে কালযাপন করেন। এই সময়ে তিনি একজন সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য যে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও তার প্রমাণ মেলে। তিনি সেইসময়েও একের পর এক গল্প লিখে গেছেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। এছাড়াও সেইসময় নজরুলের লেখা উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল ‘হেনা', ‘ব্যথার দান', ‘মেহের নেগার' ও ‘ঘুমের ঘোরে'।
কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্য চর্চা
নজরুল বিশ শতকের বিশের দশকে সৈনিক জীবনের শেষে করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর জীবনে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের। যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি তাঁর চেতনায় নিয়ে আসে এক পরিণতি। সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কলমই হয়ে উঠবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার। কলকাতায় তিনি কলেজ স্ট্রীটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে যোগদান করেন। যেখানে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বাঁধন-হারা'। নজরুল ইসলামের ‘বোধন', ‘শাত-ইল-আরব', ‘খেয়া-পারের তরণী', ‘বাদল প্রাতের শরাব' প্রভৃতি একের পর এক বিদ্রোহী কবিতাগুলি সর্বত্র প্রশংসা অর্জন করেছিল। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু পত্রিকাগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১৯২২ সালে বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী', যা সমগ্র ভারতীয় সাহিত্য জগতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। সেই বছরই ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে'। এই রাজনৈতিক কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ায় ৮ই নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩শে নভেম্বর নজরুলের যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং সেই দিনেই তাঁকে কুমিল্লা থেকে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে বন্দী থাকাকালীন তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছিলেন। বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার পরও তাঁর সাহিত্য চর্চা অব্যাহত ছিল।
সাহিত্য চর্চার সাথে সাথে থিয়েটার, সিনেমা এবং বেতার জগতেও তিনি তাঁর কৃতিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। এছাড়াও তিনি রচনা করেছিলেন অসংখ্য শাস্ত্রীয় রাগ, কীর্তন এবং দেশাত্মবোধক গান।
অসুস্থতা
জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য চর্চায় নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োজিত করলেও মধ্যবয়সে পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে আমৃত্যু সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়।
তাঁর স্বল্পকালীন সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি লিখে গেছেন প্রেম, প্ৰকৃতি, বিদ্রোহ ও মানবতার অনবদ্য সব কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক। নজরুলের ক্ষুরধার লেখনীর স্ফুলিঙ্গ যেমন বিদ্রোহ নিয়ে এসেছে, তেমনি তাঁর বাণী ও সুরের অমিয় ঝর্ণাধারা সিঞ্চিত করেছে পাঠক মনকে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জ্বল। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সকল কূপমণ্ডূকতা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে আধুনিক সমাজ নির্মাণে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার জন্য তাঁর কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.