বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ৬টি সেরা ছবি
সত্যজিৎ রায়, এই নামটি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খচিত। বাংলা ছায়াছবিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তবে তাঁর সৃষ্টির পরিধি শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি অনেক হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার সিনেমাও তৈরি করেছিলেন। একের পর এক অসাধারণ সিনেমা তৈরি করে তিনি বাংলা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাঁর এক একটা সৃষ্টি এক একটা অমূল্য রত্ন। গল্পের প্লট থেকে শুরু করে, চরিত্রগুলির মধ্যে প্রাণ সৃষ্টি, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ এবং তাঁর নানাবিধ প্রতিভার মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন এক অভাবনীয় পরিবর্তন। বাংলা তথা সমগ্র ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতা শহরের সাহিত্য ও শিল্পের জগতে খ্যাতনামা রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। উপেন্দ্রকিশোর রায়ের পৌত্র এবং সুকুমার রায় ও সুপ্রভা দেবীর পুত্র ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী' ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এই পুরস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রাপ্ত ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট' পুরস্কারটি। এছাড়াও তিনি তাঁর বর্ণময় কর্মজীবনে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তারমধ্যে বিখ্যাত হল ১৯৯২ সালে তাঁর সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসাবে প্রাপ্ত অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার ‘অস্কার'। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্য তিনি ভারত রত্ন এবং পদ্মভূষণ সহ সকল মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।

আজকে আমাদের সকলের প্রিয় বাঙালি কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ১০২তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি তাঁরই অমর সৃষ্টি থেকে ৬টি বিখ্যাত বাংলা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব।
পথের পাঁচালী
সাল : ১৯৫৫
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ২ঘণ্টা ৫মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনিবালা দেবী, উমা দাশগুপ্ত প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৮.২/১০

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী'। ‘অপু ট্রিলজি' নামে খ্যাত তিনটি পর্বে নির্মিত অপুর কাহিনী পঞ্চাশের দশকে চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এই তিনটি পর্বের মধ্যে প্রথম পর্ব পথের পাঁচালীতে অপুর বাল্যকালের কাহিনীকে তুলে ধরা হয়েছে। সত্যজিৎ রায় এই সিনেমাটিতে অপু ও তার দিদি দুর্গার সম্পর্ককে এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যার কোনো তুলনা হয় না। গ্রামীণ জীবনের সরলতাই এই সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য।

এই সিনেমাটি জাতীয় পুরস্কার থেকে শুরু করে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। আজকের দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলির মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী' অন্যতম একটি সিনেমা। অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব যথাক্রমে ‘অপরাজিত' ও ‘অপুর সংসার'।
তিন কন্যা
সাল : ১৯৬১
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ১ঘণ্টা ৫৪মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : অনিল চট্টোপাধ্যায়, চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমার রায়, কণিকা মজুমদার, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৯/১০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা তিনটি ভিন্ন স্বাদের ছোট গল্প অবলম্বনে এই সিনেমাটি কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন।
তিন কন্যার প্রথম গল্প ‘পোস্ট মাস্টার'। এই গল্পে নন্দলাল নামক একজন কলকাতার ছেলে পোস্টমাস্টারের কাজে নিযুক্ত হন এক অজপাড়াগাঁয়ে। সেখানে এসে তার পরিচয় হয় এক অনাথ কিশোরী রতনের সাথে। রতন নন্দলালের সমস্ত কাজকর্ম করে দিত। এক অচেনা জায়গায় নন্দলালের সাথে রতনের যে পারস্পরিক নির্ভরতা এবং স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই কাহিনীই তিন কন্যার এই গল্পটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তিন কন্যার দ্বিতীয় গল্প ‘মণিহারা' একটি ভৌতিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ মণিমালিকার গয়নার প্রতি চরম আসক্তি তাকে কিভাবে তার মৃত্যুর পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তারই বর্ণনা আছে এই কাহিনীটিতে।
তিন কন্যার তৃতীয় গল্প ‘সমাপ্তি'। এই গল্পে এক চঞ্চল প্রাণ কিশোরী মৃন্ময়ীর বিবাহের প্রথাবদ্ধ আচরণের সাথে মানিয়ে না নিতে পারার কাহিনীকে হাস্যরসে পরিপূর্ণ করে আপন ভঙ্গিতে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ রায়।
নায়ক
সাল : ১৯৬৬
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ১ঘণ্টা ৫৭মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : উত্তম কুমার, শর্মিলা ঠাকুর প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৮.৩/১০

মহানায়ক উত্তম কুমারকে মাথায় রেখেই সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন তাঁর অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র, ‘নায়ক'। এই সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য তিনি নিজেই রচনা করেছিলেন। নায়কের প্রধান চরিত্র বাংলা সিনেমার সুপারস্টার অরিন্দম মুখোপাধ্যায় জাতীয় পুরস্কার নিতে ট্রেনে করে কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। সেই সময় তার আলাপ হয় অদিতি সেনগুপ্ত নামক এক মহিলা সাংবাদিকের সাথে। অদিতির সাথে অরিন্দমের কথোপকথনের মাধ্যমে এক সুপারস্টারের জীবনের কাহিনীকে অবলম্বন করে সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে। যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবকিছু থাকা সত্ত্বেও নায়কের জীবনের একাকীত্ব তাকে কিভাবে গ্রাস করেছে তাই এই সিনেমার মূল কাহিনী। এই সিনেমায় সাতটি ফ্ল্যাশব্যাক এবং দুটি স্বপ্নের দৃশ্যের মাধ্যমে অরিন্দমের জীবন কাহিনীকে একের পর এক তুলে ধরা হয়েছে।
জয়বাবা ফেলুনাথ
সাল : ১৯৭৯
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ১ঘণ্টা ৫২মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, সন্তোষ দত্ত প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৯/১০

প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা, সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র। আর তাকে নিয়েই তৈরি ফেলুদা গোয়েন্দা সিরিজের দ্বিতীয় ছবি ‘জয়বাবা ফেলুনাথ'। মগনলাল মেঘরাজ নামক বেনারসের এক অসাধু ব্যবসায়ী সেখানকার এক বাঙালি পরিবারের হীরে, চুনি ও পান্না খচিত একটি অমূল্য গণেশের মূর্তি কিনতে চেয়েছিলেন ওই পরিবারেরই এক সদস্য উমানাথ ঘোষালের থেকে। কিন্তু উমানাথ ঘোষাল মগনলালের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
তারপরই একদিন রাত্রে উমানাথ ঘোষালের বাবার সিন্দুক থেকে চুরি যায় সেই গণেশের মূর্তিটি।
ফেলুদা তার খুড়তুতো ভাই তপেশ রঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে এবং তার পরমপ্রিয় বন্ধু তথা বিখ্যাত লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর সাথে সেই সময়ই ছুটি কাটাতে যান বেনারসে। তখন সেই গণেশ মূর্তি চুরির তদন্তের ভার এসে পড়ে ফেলুদার উপরে। মগনলাল মেঘরাজ ফেলুদাকে ওই মূর্তি চুরির তদন্ত বন্ধ করতে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দেয়। তবে মগনলাল মেঘরাজ ছাড়াও সন্দেহের তালিয়ায় ছিল আরও কিছু ব্যক্তি। কে ছিল এই চুরির পেছনে? আর কিভাবেই বা ফেলুদা এই রহস্যের উন্মোচন করলেন? সেটা জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই দেখতে হবে সম্পূর্ণ সিনেমাটি।

হীরক রাজার দেশে
সাল : ১৯৮০
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ১ঘণ্টা ৫৮মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৮.৯/১০

বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি সিনেমা হল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন'। সত্যজিৎ রায় তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়ের অনুরোধে তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অমর সৃষ্টি ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন' এই দুই কাল্পনিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে এই সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন।
ভূতের রাজার তিন বরে অতি সহজ সরল দু'জন মানুষের জীবনের আমূল পরিবর্তনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমাটির মাধ্যমে। এই সিনেমাটিতে সত্যজিৎ রায় ভূত মানেই যে ভয়, সেই ধারণাটিকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন।
গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর সিকুয়েল ‘হীরক রাজার দেশে'। এই ছবিটিতে মূলত শাসকের সাথে শোষিতের সংঘাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অদম্য লড়াই এই সিনেমার মূল কাহিনী। এই লড়াইয়ে কিভাবে গুপী ও বাঘা তাদের অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে উদয়ন পণ্ডিত নামক এক অসহায় শিক্ষককে সহায়তা করে সেই কাহিনীই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই সিনেমাটিতে।
আগন্তুক
সাল : ১৯৯১
ভাষা : বাংলা
সময়কাল : ১ঘণ্টা ৩৭মিনিট
পরিচালক : সত্যজিৎ রায়
অভিনেতা ও অভিনেত্রীবৃন্দ : উৎপল দত্ত, দীপঙ্কর দে, মমতা শঙ্কর প্রমুখ
আইএমডিবি রেটিং: ৮/১০

সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ ছবি ‘আগন্তুক'। তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘অতিথি' অবলম্বনে তিনি এই সিনেমাটি তৈরি করেন। এই সিনেমাটিতে অনিলা ও তার পরিবার, ৩৫ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তার মামার সাথে প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎ করেন। নিজের পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও সেই আগন্তুককে অনিলা এবং তার পরিবারের সকলেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। সেই ব্যক্তির আগমন ছিল সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। সেই আগন্তুক তার ভ্রমণের কাহিনী শুনিয়ে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলেন। তার হঠাৎ ফিরে আসার মতোই তার চলে যাওয়াটাও ছিল অপ্রত্যাশিত। সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্রের তালিকাটিতে এরকমই আরও অনেক অনন্য এবং অসাধারণ সৃষ্টির সম্ভার রয়েছে। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম সেরা আরও কিছু সিনেমা যেমন মহানগর, চারুলতা, প্রতিদ্বন্দ্বী, সোনার কেল্লা, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেতের নাম নিলে এই প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.
Pingback: বাংলা উৎসব ভিত্তিক বিখ্যাত সিনেমা - Kuntala's Travel Blog