রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস ও কিছু পৌরাণিক কাহিনী
ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল রাখিবন্ধন উৎসব। ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কের এ এক নিবিড় উদযাপন। এই পবিত্র সম্পর্ককে আজীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতি বছর সাধারণত শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সমগ্র ভারতবর্ষ তথা বিশ্বব্যাপী পালিত হয় রাখিবন্ধন উৎসব। এই উৎসবে প্রত্যেক দিদি বা বোন তার দাদা বা ভাইয়ের ডান হাতের মণিবন্ধে ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে একটি মঙ্গলসূত্র বেঁধে দেয়। এই পবিত্র সুতো বা রাখি তাদের দাদা বা ভাইদের সমস্ত অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা কবচের ন্যায় রক্ষা করে। বিনিময়ে দাদা বা ভাইয়েরা তাদের দিদি বা বোনেদের আমরণ রক্ষার শপথ নেয়। তারপর চলে উপহার বিনিময়, একে অপরকে মিষ্টিমুখ করানো ও খাওয়া-দাওয়ার পর্ব।
তবে এই উৎসব শুধুমাত্র ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সমাজ তথা সমগ্র মানবজাতিকে সুসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে এই চিরন্তন উৎসব। আজ এই পবিত্র রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস ও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কিছু পৌরাণিক কাহিনী আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
রাখিবন্ধন উৎসবের পৌরাণিক তাৎপর্য
রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনা বা এই প্রথার উৎপত্তির কথা বলতে গেলে হিন্দু পুরাণের কিছু কাহিনীর কথা উঠে আসে। আজকে সেই পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী নিয়ে আমি আলোচনা করব।
দেবরাজ ইন্দ্র ও শচীদেবীর কাহিনী
পুরাণের এই কাহিনীটি দেবতা ও অসুরদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে যখন দেবতারা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিল, সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর গুরু বৃহস্পতির সাহায্য চাইলেন। গুরু বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রকে শ্রাবণ পূর্ণিমার দিন তাঁর কব্জিতে মন্ত্রপূত একটি পবিত্র সুতো পরার পরামর্শ দিলেন। গুরু বৃহস্পতির পরামর্শ অনুযায়ী দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবী তাঁর হাতে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেন। এই মন্ত্রপূত পবিত্র সুতোর বলে দেবতারা অসুরদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন। এই পৌরাণিক কাহিনীকে অনুসরণ করেই ভারতে নারীরা যুদ্ধের পূর্বে প্রত্যেক সৈনিকের হাতে একটি করে সুতো বেঁধে দেওয়ার রীতি শুরু করে। এই আশা নিয়েই এই পবিত্র সুতো সৈনিকদের হাতে বেঁধে দেওয়া হতো, যে এটি তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ষা করবে এবং জয় এনে দেবে।

দৈত্যরাজ বলি ও দেবী লক্ষ্মীর কাহিনী
ভগবান বিষ্ণুর উপাসক ও একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন দৈত্যরাজ বলি। বলির এই চরম ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু নিজের আবাস বৈকুণ্ঠ ধাম ত্যাগ করে বলির রাজ্যে এসে তাঁর রাজ্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। তখন দেবী লক্ষ্মী তাঁর স্বামীকে বৈকুণ্ঠ ধামে ফিরিয়ে আনার জন্য এক ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশে বলির রাজ্যে যান এবং বলির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। দেবী লক্ষ্মী বলিকে জানান তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন যাবৎ নিখোঁজ এবং তিনি তাঁর স্বামীর খোঁজ করতেই বলির রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন। বলি সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে দেবী লক্ষ্মীকে তাঁর প্রাসাদে থাকার অনুমতি দেন। বলি রাজার প্রাসাদে থাকাকালীন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন দেবী লক্ষ্মী দৈত্যরাজ বলির মঙ্গল কামনা করে তাঁর হাতের কব্জিতে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেন। বিনিময়ে দৈত্যরাজ বলি দেবী লক্ষ্মীকে একটি বর দেন এবং সেই বর পেয়ে দেবী বলি রাজাকে তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে বলেন। দেবী লক্ষ্মী তখন বিভ্রান্ত বলি রাজার কাছে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন এবং তাকে সব ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে বলি ভাই-বোনের ভালোবাসার প্রতিদান স্বরূপ ভগবান বিষ্ণুকে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে বৈকুণ্ঠ ধামে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানান। কিন্তু বলিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণু সিদ্ধান্ত নেন যে বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও মহেশ্বর প্রত্যেকে চার মাস করে বলি ও তাঁর রাজ্যকে রক্ষা করবেন।

শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর কাহিনী
মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর কাহিনী রাখিবন্ধন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি কাহিনী। রাজসূয় যজ্ঞের সময় শিশুপালকে হত্যা করার পরে শ্রীকৃষ্ণের আঙ্গুল কেটে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে। তখন পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী নিজের শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের হাতের আঘাত প্রাপ্ত স্থানে বেঁধে দেন। অনাত্মীয়া হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে নিজের বোনের মর্যাদা দেন এবং তাঁকে সর্বদা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কালে শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে ভাই-বোনের সম্পর্ককে দৃষ্টান্ত স্বরূপ গড়ে তোলেন।

যমরাজ ও যমুনার কাহিনী
যখন সম্পর্কটা ভাই-বোনের হয় তখন যম ও যমুনার প্রসঙ্গ আসবে না তা কি করে হয়। বাঙালিদের ভাইফোঁটার মন্ত্রে যেমন এনাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেই রকমই রাখিবন্ধন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যেও যম ও যমুনার একটি কাহিনী রয়েছে। যমরাজের অমরত্ব প্রার্থনা করে তাঁর বোন যমুনা যমরাজের কব্জিতে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেন। তারপর থেকে যমরাজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যার হাতে তাঁর বোন রাখি বেঁধে দেবেন এবং বিনিময়ে যে যমুনাকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করবে তাকে যমরাজ স্বয়ং রক্ষা করবেন অর্থাৎ সে অমরত্ব লাভ করবে।

দেবতাদের দ্বারা প্রচলিত এই উৎসবটি আজ ভারতের প্রতিটি ঘরে ঘরে পালিত হয়। ভাই-বোনের স্নেহের বন্ধনকে আরও দৃঢ়, শক্তিশালী ও পুনরুজ্জীবিত করে তোলে এই পবিত্র উৎসব।
রাখিবন্ধন উৎসবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস ঘাঁটলে বহু অজানা কাহিনী আমাদের সামনে উঠে আসে। চলুন তাহলে আজ ইতিহাসের পাতা থেকে সেই রকমই কয়েকটি কাহিনী সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
রোকসানা ও পুরুর কাহিনী
রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস আমাদের নিয়ে যায় সেই সময়ে যে সময় আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধ বেঁধেছিল। এই যুদ্ধের কাহিনী যদিও কারোরই অজানা নয়। তবে এ কাহিনী শুধুই যুদ্ধের নয়, যুদ্ধ ছাড়াও ভাই ও বোনের পবিত্র সম্পর্কের একটি কাহিনীও লুকিয়ে রয়েছে এর মধ্যে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেন। পুরুর বীরত্বের কথা শুনে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রানি রোকসানা তাঁর স্বামীর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা করেন। তখন রানি ভারতের পবিত্র রাখিবন্ধন উৎসবের কথা শোনেন এবং স্বামীর প্রাণ রক্ষা করতে পুরুকে একটি রাখি পাঠান। পুরু তাঁকে বোনের স্বীকৃতি দেন এবং আশ্বস্ত করেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের কোনো ক্ষতি করবেন না। যদিও সেই যুদ্ধে আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল পুরুকে।
কর্ণাবতী ও হুমায়ূনের কাহিনী
রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে আরও এক ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কের। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের চিতোর আক্রমণের আগাম বার্তা পেয়ে চিতোরের রানি কর্ণাবতী মোঘল সম্রাট হুমায়ূনকে সাহায্যের জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর রাজ্য ও পরিবারকে রক্ষা করার জন্য সেই চিঠির সাথে একটি রাখিও প্রেরণ করেছিলেন। রানি কর্ণাবতীর চিঠি পেয়ে সম্রাট হুমায়ুন সেই সময় বাংলায় চলাকালীন সামরিক অভিযান পরিত্যাগ করে তাঁকে সাহায্য করতে চিতোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্রাট হুমায়ূনের পৌঁছানোর পূর্বেই চিতোরের সেনাবাহিনী বাহাদুর শাহের কাছে পরাজিত হয় এবং রানি কর্ণাবতী নিজের ও তাঁর সঙ্গিনীদের সম্মান রক্ষার্থে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে জওহর প্রথা অনুযায়ী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন।

রাখিবন্ধন উৎসব, বঙ্গভঙ্গ ও রবীন্দ্রনাথ
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান Il…..
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান Il
রাখি পূর্ণিমার সাথে কোনো রকম সংযোগ না থাকলেও রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গেলে উঠে আসে বাঙালির প্রাণের কবি রবি ঠাকুরের প্রসঙ্গ। রাখিবন্ধন উৎসবকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একটি ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব কিভাবে অরাজকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কিভাবে তা এক মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছিল, রাখিবন্ধন উৎসবের ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে সেই কাহিনীরই।
এ কাহিনী ভারতের প্রাক স্বাধীনতা কালের, এ কাহিনী অবিভক্ত বাংলার, এ কাহিনী হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের, এ কাহিনী বাঙালির।

১৯০৫ সালের জুন মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলার বিভাজন অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই বাংলার মাটিতে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে, সেই আন্দোলনকে স্তিমিত করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গের চক্রান্ত করেছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য সেই দিনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমগ্র দেশ জুড়ে রাখিবন্ধন উৎসবের পরিকল্পনা করেন। সেই অশান্ত মুহূর্তকে সম্প্রীতির বন্ধনে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
শিক্ষিত বাঙালি সমাজ অনুভব করেছিল যে এই বঙ্গভঙ্গ বাংলা ভাষাভাষী জনগণের জাতীয় সচেতনতা ও ক্রমবর্ধমান সংহতির উপর কার্জনের হানা সুনিশ্চিত আঘাত। বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য সমগ্র বাংলা জুড়ে শুরু হয় উত্তাল আন্দোলন। এই আন্দোলনে যারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি কলকাতা, ঢাকা, সিলেট এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই-বোনদের আহ্বান জানিয়েছিলেন একতার প্রতীক হিসেবে রাখিবন্ধন উৎসব পালন করার জন্য। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন বাঙালির ঐক্য বন্ধনের দিন ঘোষিত হয়েছিল। শহর জুড়ে বিলি করা হয়েছিল প্রচারপত্র। রবীন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি এই রাখিবন্ধন উৎসবের মন্ত্র বাতলে দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর। শুধু তাই নয়, আশ্বিনের এই শুভক্ষণকে সেই সময় পঞ্জিকাতেও স্থান দিয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন। যদিও সময়ের সাথে সাথে এই দিনটির উল্লেখের কথা কোথায় যেন তলিয়ে গেছে।
তবে যে বাঙালি ধর্মীয় ও সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে রাখিবন্ধনের এই পবিত্র উৎসবকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জায়গা দিয়েছে, যে বাঙালি সৌভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতিকে বেঁধেছে রাখির সুতোয়, সেই বাঙালির কাছে ভাই-বোনের সম্পর্কের বাইরেও সমাজকে এক সুতোয় বাঁধার উৎসবই রাখিবন্ধন। তাইতো শ্রাবণের এই রাখিবন্ধন উৎসবে বার বার ফিরে আসে রবি প্রসঙ্গ।
রাখিবন্ধন উৎসব উপলক্ষ্যে সকলকে আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি আমার এই প্রবন্ধটিতে ইতি টানলাম।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.