শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা
বাঙালিদের কাছে শীতকাল মানেই গায়ে সোয়েটার আর মাথায় টুপি চাপিয়ে ঘুরতে যাওয়ার তোড়জোড়। গ্রীষ্মকালে সূর্যের দাবদাহে টুর প্ল্যানিং-এ অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে এবং বর্ষাকালে কিছু কিছু জায়গা ঘুরতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, আবার অনেক জায়গায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধও থাকে। তাই বেশিরভাগ বাঙালিই শীতের আমেজে ঘুরতে যেতে বেশি পছন্দ করেন। শীতকালে প্রকৃতি সামান্য রুক্ষ হলেও হিম শীতল হওয়ার স্পর্শে এক আলাদাই রূপে সেজে ওঠে। তার মধ্যে চলে ঝলমলে রোদের লুকোচুরি খেলা। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ সময় হল এই শীতকাল। আজকে আমার লেখনীতে আপনাদের জন্য রয়েছে কয়েকটি শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
সুন্দরবন
শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা সম্বন্ধে বলতে গেলে প্রথমেই যে জায়গাটির কথা মনে পরে সেটি হল সুন্দরবন। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এরমধ্যে ৬৬ শতাংশ এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত, বাকি ৩৪ শতাংশ ভারতের অন্তর্গত। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে বাংলার এই অরণ্য নিজের জায়গা করে নিয়েছে। পর্যটকদের কাছে এখানকার মূল আকর্ষণ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এখানে শীতকালে নদীর চড়ে সারি বেঁধে কুমিরদের রোদ পোহাতে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন রকমের পরিযায়ী পাখি, সরীসৃপ, চিত্রা হরিণ, বাঁদর সহ নানান প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থান এই অরণ্য। এখানে প্রধানত সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া ও কেওড়ার মতো ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদগুলি দেখতে পাওয়া যায়। সুন্দরবন ভ্রমণকে দুটি অংশে ভাগ করা যায়- এক দিকে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ভগতপুর, বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প, লোথিয়ান দ্বীপ, অপর দিকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সোজনেখালি, সুধন্যখালি, দোঁবাকি থেকে বুড়ির ডাবরি পর্যন্ত।

বকখালি
যারা সমুদ্র পছন্দ করেন তাদের জন্য শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা হিসাবে বকখালি আদর্শ। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার নামখানায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম বকখালি। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তবে শীতকালে চারিদিকে ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের মাঝে কয়েকটা দিন কাটানোর এক আলাদাই অনুভূতি আছে। শহরের কোলাহল থেকে অল্প দূরেই এই জায়গাটি নির্জনতাপ্রিয় ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। বঙ্গোপসাগরের এই সমুদ্র সৈকতে আপনি দেখতে পাবেন অজস্র লাল কাঁকড়া।
বকখালি থেকে কিছু দূরেই রয়েছে আরও একটি প্রসিদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র ফ্রেজারগঞ্জ। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৯০৩- ১৯০৮) স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই জায়গাটি আবিষ্কার করেন। সেই কারণেই তাঁর নামানুসারে এই গ্রামের একটি অংশের নামকরণ করা হয়েছে ফ্রেজারগঞ্জ। এখানকার সমুদ্র সৈকতের নিকটেই এখনও তাঁর বসতবাড়িটি রয়েছে।
শিলিগুড়ি
শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা হিসাবে দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত এই শৈল শহরটি নিজের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। শহরের যান্ত্রিকতার মাঝেও এই জায়গাটিতে রয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হল- মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, দুধিয়া, সাভিন কিংডম, সালুগাড়া মনেস্ট্রি, বেঙ্গল সাফারি পার্ক, সিপাই ধুরা চা বাগান, করোনেশন ব্রিজ, নর্থ বেঙ্গল সাইন্স সেন্টার, সেবক কালী মন্দির, কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম, লোকনাথ মন্দির, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। এছাড়াও শিলিগুড়িতে উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্ব বৃহৎ ইসকন মন্দিরটি অবস্থিত। আর শপিং ডেস্টিনেশন হিসাবে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে আপনি পেয়ে যাবেন আপনার প্রয়োজনীয় ও পছন্দসই সব ধরণের জিনিস। শিলিগুড়ি থেকে আপনি চাইলে অতি সহজেই ঘুরে আসতে পারেন দার্জিলিং-এর অন্যান্য টুরিস্ট স্পটগুলি থেকে।
মায়াপুর
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় অবস্থিত মায়াপুর এখানকার ইসকন মন্দিরের জন্য যথেষ্ট বিখ্যাত। এই সুবিশাল ইসকন মন্দিরের ভিতরে আপনি পাবেন এক শান্ত ও পবিত্র অনুভূতি। এই মন্দিরে প্রাত্যহিকভাবে ভোরবেলায় মঙ্গল আরতি আর সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যারতি হয়ে থাকে, যা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এখানে দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে। এখানে আগত সকল ভক্তদের জন্য প্রতিদিন অন্নভোগের আয়োজন করা হয়। অল্প সময় হাতে নিয়েই এই শীতে কোন এক সপ্তাহান্তে অতি সহজেই আপনি চলে আসতে পারেন মায়াপুরে।

মুকুটমণিপুর
শীতকালে ঘুরতে যাওয়ার সেরা জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার মুকুটমণিপুর। বাঁকুড়ার একদম দক্ষিণপ্রান্তে কংসাবতী এবং কুমারী নদীর সঙ্গমস্থলে আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি নিয়ে গড়ে উঠেছে মুকুটমণিপুর জলাধার। সেই জলরাশির ঘন নীল জলের মধ্যে থেকে মাঝেমধ্যে দেখা যায় অসংখ্য ডুবো পাহাড়। সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই জায়গাটিতে কংসাবতী বাঁধ অবস্থিত, যেটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ। এই বাঁধটি মুকুটের ন্যায় অসংখ্য টিলা দ্বারা বেষ্টিত। আপনি অনায়াসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে। আর যদি ছবি তোলা আপনার প্যাশন হয়, তাহলে শীতের দিনে মুকুটমণিপুরের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যগুলিকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে একদমই ভুলবেন না।
শান্তিনিকেতন
পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটির দেশ বীরভূম, আর সেই বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শান্তির নীড়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই জায়গাটিতে আপনি একই সাথে দেখতে পাবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্প সাহিত্যের অপরূপ মেলবন্ধন। এখানকার বিখ্যাত সোনাঝুরি হাটে আপনি পেয়ে যাবেন নানান ধরণের হাতের তৈরি জিনিস থেকে শুরু করে শাড়ি, ব্যাগ আরও অনেক কিছু। শান্তিনিকেতন এখানকার বিখ্যাত পৌষমেলার জন্য শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা হিসেবে পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটি স্থান। এছাড়াও এখানে বড় করে উদযাপিত হয় বসন্ত উৎসব। শান্তিনিকেতনের এই পৌষমেলা এবং বসন্ত উৎসব শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয় সারা ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বে এক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে। সাঁওতালি নাচের সাথে পা মেলাতে এবং বাউল গানের সুরে মন ভাসাতে এই শীতে আপনি চলে আসতে পারেন শান্তিনিকেতনে।


ঝালং
শীতকালে পশ্চিমবঙ্গে দেখার সেরা জায়গা সম্বন্ধে বলতে গেলে ঝালং-এর নাম না নিলে কেমন করে চলে। এই ছোট্ট গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে অবস্থিত এই জায়গাটি শীতকালের প্রথম দিকে হালকা ঠাণ্ডায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য আদর্শ। এই বছর ৩০শে নভেম্বর কোচবিহার থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম ঝালং-এর উদ্দেশ্যে। আমরা প্রাইভেট গাড়ি করে মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম ঝালং-এ। যদিও সফরটি এক রাতের ছিল, কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের মন কেড়ে নিয়েছিল এই পাহাড়ি এলাকাটি। জলঢাকা নদীর অবিশ্রান্ত গর্জন আর ছোট ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল ওই রাতে। আমরা রিভার ভিলা নামক একটি হোম স্টে-তে ছিলাম। এই হোম স্টে-টি জলঢাকা নদীর একদম ধারে অবস্থিত হওয়ায় অনেক কাছ থেকে এই নদীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি।
সময় কম থাকায় আমরা আশেপাশের জায়গাগুলি ঠিক ঘুরে আসতে পারিনি। তবে আপনাদের জন্য ঝালং-এর আশেপাশের কয়েকটি মনোরম জায়গার কিছু তথ্য দিয়ে দিলাম। ঝালং থেকে কিছু দূরেই পাহাড়ি পথে প্যারেন নামক একটি ছোট্ট গ্রাম রয়েছে। প্যারেনে পাহাড়ের গায়ে দেখতে পাবেন নানান রঙের অজস্র কাঠের বাড়ি আর রাস্তার ধার দিয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল কমলালেবুর বাগান।
প্যারেন পেরিয়ে ভুটান সীমান্তের গা ঘেঁষে রয়েছে ভারতের শেষ জনপদ বিন্দু। ছবির মতো সাজানো একটি পাহাড়ি গ্রাম বিন্দু, যেখানে আপনার চোখে পড়বে ফায়ারবল, পিটুনিয়া, গ্ল্যাডিওলাস ও অর্কিডের মতো নানান ধরণের পাহাড়ি ফুলের গাছ। বিন্দুতে রয়েছে জলঢাকা ব্যারেজ, যার ওপারেই রয়েছে ভুটান। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিন্দু থেকেই চোখে পড়বে হিমালয়ের বরফশৃঙ্গ। এছাড়াও ঝালং থেকে দলগাঁও হয়ে রঙ্গো বলে একটি জায়গায় যাওয়া যায়। আর প্যারেন থেকে ঘুরে আসতে পারেন তোদে।
আর দেরী না করে এইবারের শীতে উল্লিখিত জায়গাগুলির মধ্যে আপনার পছন্দের জায়গাটি বেছে নিয়ে সপরিবারে ঘুরে আসুন।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.