বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু

‘যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।'

এই মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে নারী এবং পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সমস্ত পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মী সকলের উপস্থিতিতে এবং তাদের ভালোবাসা ও আশীর্বাদে নবদম্পতি তাদের নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করেন। আর এই বিশেষ অনুষ্ঠানের এক অন্যতম প্রধান অঙ্গ খাওয়া দাওয়া। আর খাওয়া দাওয়াটা যখন কোন বাঙালি পরিবারের অনুষ্ঠানের হয়, তখন সেটা কব্জি ডুবিয়ে না হলে মন ও পেট কোনটাই ঠিক ভরে না।

বিয়েতে বর ও কনের পোশাক থেকে শুরু করে, ভেনু, ডেকোরেশন সব কিছুতেই চমক লাগাতে সঠিক প্ল্যানিংয়ের প্রয়োজন। আর যখন বিষয়টা রসনাতৃপ্তির হয় তখন তার প্ল্যানিং একটু বেশি গুরুত্ব দিয়েই করা উচিত। বিয়ের মেনু ঠিক করার আগে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার। প্রথমত বিয়ের সময়, অর্থাৎ বিয়েটি শীতকাল না গ্রীষ্মকাল, কোন ঋতুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সময় হিসাবে খাবারের সিলেকশন আলাদা আলাদা করতে হবে। দ্বিতীয়ত নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য যেমন ননভেজ খাবারের অফুরন্ত ভাণ্ডার থাকে, ঠিক সেইরকমই নিরামিষভোজী অতিথিদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।

আমার আজকের এই প্রবন্ধটি খানিকটা বিয়েবাড়ির মেনু কার্ডের মতো হয়ে উঠবে। স্টার্টার থেকে শুরু করে ডেজার্ট, নিরামিষ থেকে শুরু করে আমিষ, খাঁটি বাঙালি খাবার থেকে শুরু করে ভিনদেশি খাবার, সমস্ত কিছু মিলিয়ে বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু নিয়ে আমি আজকে হাজির হয়ে গেছি আপনাদের জন্য।

পানীয়

বিয়েটি ভবনে হোক অথবা খোলা মাঠে, শুরুতেই দেখা মিলবে বিভিন্ন ধরণের পানীয়-র স্টলের। শীতকালীন বিয়েতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে অতিথিদের জন্য হাজির থাকে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা ও কফি। যদিও শুধু চা বা কফি বললে এখন আর চলে না, কিছু কিছু বিয়েবাড়িতে চা এবং কফিরও থাকে বিভিন্ন ভ্যারাইটি। স্বাস্থ্য সচেতন ও বয়স্ক মানুষদের জন্য গ্রিন টি থেকে শুরু করে, হারবাল টি ও ব্ল্যাক কফিরও ব্যবস্থা থাকে।

বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন সমস্ত বিয়েবাড়িতেই মকটেলের কাউন্টার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন সিজনাল ফলের রস দিয়ে তৈরি ফ্রুট জুস আরও একটি জনপ্রিয় পানীয়। আর বিভিন্ন ধরণের কোল্ড ড্রিঙ্ক এবং লস্যি কয়েক দশক ধরে বিয়েবাড়ির পানীয়-র তালিকায় নিজেদের এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

স্টার্টার

বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু সম্বন্ধে বলতে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নানান ধরণের লোভনীয় স্টার্টারগুলি। আগেকার দিনে খাবারের পাতে প্রথমে পরিবেশন করা হত কাটলেট অথবা কবিরাজির মতো সব সুস্বাদু খাবার, তার সাথে থাকত কাসুন্দি ও স্যালাড। তবে বর্তমানে বিয়েবাড়ির খাবারের তালিকায় স্টার্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। এখন স্টার্টারের আলাদা আলাদা অনেকগুলি স্টল থাকে। সেই স্টলগুলিতে যেমন ননভেজ স্টার্টার থাকে, তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে থাকে নানান ধরণের ভেজ স্টার্টারও।

ননভেজ স্টার্টারের তালিকায় থাকে চিকেন অথবা ফিস পাকোড়া, চিকেন কাবাব, চিকেন মোমো, ফিস তন্দুরি, ফিস ফিঙ্গার থেকে শুরু করে বিভিন্ন আইটেম।

আর নিরামিষ স্টার্টারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে চিজ বল, ভেজ পাকোড়া, পনির টিক্কা, চিলি পট্যাটো, ক্রিসপি কর্ন ইত্যাদি।

এছাড়াও ফুচকা, পাপড়ি চাট ও দই বড়ার মতো জিভে জল এনে দেওয়া খাবারগুলি অতিথিদের খাওয়ার শুরুটা বেশ ভালোই জমিয়ে দেয়। 

স্যুপ ও স্যালাড

শীতকালীন বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু মানেই তাতে স্যুপ থাকাটা অতি আবশ্যক। গরম গরম স্যুপ একটি দারুণ অ্যাপিটাইজার। স্যুপের তালিকায় থাকতে পারে চিকেন সুইট কর্ন স্যুপ, ভেজিটেবল স্যুপ ইত্যাদি। 

বর্তমানে বিয়েবাড়ির খাবারের মেনুতে দেখা মেলে বেশ কয়েক প্রকারের স্যালাডের। যেকোনো খাবারের সাথে স্যালাড যোগ হলে খাবারের স্বাদ বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।

রায়তা

রায়তা এমন একটি পদ যেটি বর্তমানে বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। যেকোনো রিচ খাবারের সাথে অল্প একটু রায়তা থাকলে খাওয়াটা বেশ ভালোই জমে যায়।

রাইস

খুচখাচ খাবারের গল্প এখানেই শেষ করা যাক। আসা যাক মেন কোর্সের দিকে। বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু আর তাতে রাইস থাকবে না তা কেমন করে হয়। বিয়েবাড়িতে সাদা ভাত অর্থাৎ প্লেন রাইসের চল সেই আদিকাল থেকে এখনও অবধি চলে আসছে। ধোঁয়া ওঠা লম্বা লম্বা সুগন্ধি বাসমতী চালের ভাতের সাথে যেকোনো বাঙালি পদ খেতে খুবই ভালো লাগে। অনেকে পোলাও, ফ্রায়েড রাইস অথবা বিরিয়ানি করলেও সাথে প্লেন রাইস অতি অবশ্যই রাখেন। একদম প্লেন রাইস না রেখে অনেকে মেনুতে জিরা রাইস বা পিস রাইসও করে থাকেন। তবে বাসন্তী পোলাওয়ের গন্ধে যেমন গোটা বিয়েবাড়ি ম ম করে, সেইরকমই ভোজনরসিক বাঙালিদের মনও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। আবার নানান ধরণের ভেজিটেবল দিয়ে বাঙালি স্টাইলে ফ্রায়েড রাইস, পোলাওয়ের থেকে কিছু কম যায়না। আর বিরিয়ানির কথা বললে এটাই বলব যে কলকাতার বিরিয়ানির এক আলাদাই স্বাদ আছে, তা চিকেন হোক কিংবা মটন। বিশেষ করে কলকাতার বিরিয়ানির আলু সকলেরই খুব প্রিয়। তবে নিরামিষভোজী অতিথিদের মন খারাপ করার কিছু নেই, তাদের জন্য বানানো যেতে পারে ভেজ বিরিয়ানি।

রুটি ও লুচি

ভাতের অল্টারনেট হিসাবে রুটি জাতীয় খাবার অনেকেই পছন্দ করেন। সেটা হতে পারে রুমালি রুটি অথবা নান বা কুলচা। নান ও কুলচারও আবার থাকে নানান ভ্যারাইটি। এছাড়া সেকাল হোক বা একাল, বাঙালি বিবাহের খাবারের মেনুতে লুচি, রাধাবল্লভী অথবা কড়াইশুঁটির কচুরির  জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। 

ডাল

ভাত হোক অথবা রুটি যেকোনো কিছুর সাথে ডাল একটি অত্যাবশ্যক পদ। প্লেন রাইসের সাথে ভেজ ডাল অথবা মাছের মাথা দিয়ে ভাজা মুগ ডাল বাঙালিদের অতি প্রিয়। সেখানে লুচি বা রাধাবল্লভীর মতো পদের সাথে ছোলার ডাল খুবই ভালো লাগে। এছাড়া নান অথবা কুলচার সঙ্গ দিতে যোগ হতে পারে ডাল মাখানি।

ভাজাভুজি

ডালের পরে এবার একটু ভাজাভুজি না হলে কেমন করে চলে। ভাত ও ডালের সাথে যদি একটু ঝুরি আলু ভাজা অথবা তোপসে মাছের ফ্রাই থাকে তাহলে আর কোন কথাই নেই। আবার গরম গরম লুচির সাথে লম্বা লম্বা বেগুন ভাজার জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও নানান ধরণের ভাজাভুজির আইটেম বিয়েবাড়ির মেনুতে দেখতে পাওয়া যায়।

মাছ

কথায় আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি'। তাই ভোজনরসিক বাঙালিদের বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু মানেই মাছের আইটেমের প্রচুর ভ্যারাইটি। সুগন্ধি গরম গরম বাসমতী চালের ভাতের সাথে সর্ষে কিংবা ভাপা ইলিশ, ভেটকি মাছের পাতুরি, কাতলা কালিয়া, দই কাতলা, পাবদা মাছের ঝাল অথবা চিংড়ি মাছের মালাইকারি হলে রসে-বশে খাওয়া দাওয়াটা বেশ ভালোই জমে যায়।

মাংস

মাছের পরেই বাঙালিদের খাবারের তালিকায় দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় আইটেম হল মাংস। চিকেন অথবা মটন যেকোনো মাংসের আইটেমই বাঙালিদের অত্যন্ত প্রিয়। প্লেন রাইসের সাথে কচি পাঁঠার ঝোল হোক অথবা পোলাওয়ের সাথে মটন কষা, আবার ফ্রায়েড রাইসের সাথে চিলি চিকেনের জুটি সর্বকালের সেরা। আর মটন বিরিয়ানি বা নান অথবা কুলচার সাথে চিকেন রেসালা বা চিকেন চাপের স্বাদ অতুলনীয়। এছাড়া চিকেন টিক্কা বাটার মাসালা, কড়াই চিকেন, মটন দো পেঁয়াজার মতো আইটেমগুলিও যথেষ্ট ট্রেন্ডি।

ভেজ আইটেম

একটি আদর্শ বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু বলতে যা বোঝায় তাতে নিরামিষ রান্নার গুরুত্ব অপরিসীম। বহু বাঙালি বাড়িতে সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিনে নিরামিষ খাবার খাওয়ার রীতি আছে, তাছাড়া অনেকে আমিষ খাবার সম্পূর্ণভাবেই খায় না। তাই তাদের জন্য বিয়েবাড়ির মেনুতে নিরামিষ খাবারের আয়োজন করা হয়। যদিও পূর্বে আমি বেশ কয়েকটি ভেজ আইটেমের কথা বলেছি তবে আলাদা করে কয়েকটি বিশেষ ভেজ আইটেমের উল্লেখ না করলেই নয়। ফুলকপির রেসালা, স্টাফ আলুর দম, মিক্সড ভেজ, শাহী পনির, পনির কোর্মা, কড়াই পনির, মালাই কোফতা থেকে শুরু করে বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী ছানার ডালনা, ধোঁকার ডালনা ইত্যাদি নিরামিষ পদগুলির স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো।

কন্টিনেন্টাল

বাঙালি বিয়েতে বর্তমানে কন্টিনেন্টাল খাবারের বেশ চল আছে। মেক্সিকান, জাপানিজ, থাই, ইতালিয়ান কন্টিনেন্টাল খাবারগুলির প্রতি নিমন্ত্রিত প্রতিটি অতিথিই বেশ আকৃষ্ট হন।

ডেজার্ট

বাঙালি বিয়েতে ডেজার্টের তালিকায় সবার প্রথমে মিষ্টির স্থান। সেটা হোক ট্র্যাডিশনাল নলেন গুড়ের রসগোল্লা অথবা বেকড রসগোল্লা। এছাড়াও নানান ধরণের সন্দেশ, গুলাব জামুন, রসমালাই, রাবড়ির মতো মিষ্টিগুলিও রসগোল্লার সাথে তালে তাল মিলিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে। মিষ্টির সাথে সাথে বাঙালি বিয়েতে মিষ্টি দই একটি অত্যাবশ্যক পদ। এগুলি ছাড়াও ডেজার্ট হিসাবে বিভিন্ন ধরণের আইসক্রিম ও কুলফি বিয়েবাড়ির মেনুতে অবশ্যই থাকে। তবে শীতকালীন বিয়েতে আইসক্রিম বা কুলফির পরিবর্তে থাকে হট কেক, ফ্রুট কাস্টার্ড, সুফলে ইত্যাদি।

মুখশুদ্ধি

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার'। তাই বিয়েবাড়ির খাওয়ার শেষ পাতে বাঙালির প্রিয় মিষ্টি পান না হলে খাওয়াটা ঠিক জমে না। এখনকার বেশিরভাগ বিয়েবাড়িতে থাকে পানের একটি কাউন্টার, যেখানে নানান ধরণের পান সাজা থাকে নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। এছাড়াও বিয়েবাড়িতে মুখশুদ্ধি হিসাবে বিভিন্ন ধরণের পান মশলা, মৌরি ইত্যাদির চলও রয়েছে।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

2 thoughts on “<strong>বাঙালি বিবাহের জনপ্রিয় খাবারের মেনু</strong>

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: