কলকাতায় ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন
২৬শে জানুয়ারি সকল ভারতবাসীর কাছেই একটি গৌরবময় দিন। আজকের এই বিশেষ দিনটিতে সারা দেশজুড়ে মহাসমারোহে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস। নানান অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক সুন্দর ছবি তুলে ধরা হয় আজকের এই বিশেষ দিনে। দিল্লি থেকে শুরু করে কলকাতা, সর্বত্র এই ছবিটা খানিকটা একই রকম। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরেও কলকাতায় প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। আজকে আমার লেখনীতে আপনাদের জন্য রইল কলকাতার রেড রোডে কিভাবে উদযাপিত হতে চলেছে ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবস, সেই সম্বন্ধীয় কিছু বিশেষ তথ্য।
২৬শে জানুয়ারির তাৎপর্য
মূল প্রসঙ্গে আসার আগে জেনে নেওয়া যাক এই দিনের নেপথ্যে থাকা কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী। ২৬শে জানুয়ারি, এই দিনটি ভারতের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারির দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, আর ১৯৫০ সালের এই দিনেই কার্যকর হয়েছিল ভারতের সংবিধান, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান।
প্রথমে আসা যাক পূর্ণ স্বরাজের কথায়, জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের শেষের দিকে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথ গ্রহণ করা হয়েছিল। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারির দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনটিকে মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন ‘স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস'। যদিও দীর্ঘ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় এবং এই দিনটিই স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা লাভ করে।
এবার ভারতীয় সংবিধান সংক্রান্ত কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ১৯৪৭ সালে ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল খসড়া কমিটি। সেই বছর ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে প্রথম ভারতীয় সংবিধানের খসড়া জমা দেওয়া হয়। তার প্রায় দুই বছর তিন মাস পর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারির দিন কার্যকর করা হল দেশের সংবিধান এবং ভারতবর্ষকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণ-প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ২৬শে জানুয়ারির এই বিশেষ দিনটি সারা দেশ জুড়ে দেশনায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহাসমারোহে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে।
কলকাতার রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন
প্রজাতন্ত্র দিবসের বেশ কিছুদিন আগে থেকে কলকাতার রেড রোডে শুরু হয়ে গিয়েছিল কুচকাওয়াজের মহড়া। এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে জোর কদমে চলেছে প্রস্তুতি।
প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরেও কলকাতার রেড রোডে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করা হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক চিরাচরিত প্রথা মেনে রেড রোডে কিভাবে উদযাপিত হতে চলেছে এই বছরের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবস।
জাতীয় পতাকা উত্তোলন
আজকে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে রেড রোডের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল মহামান্য ডঃ সি ভি আনন্দ বোস এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ। মাননীয় রাজ্যপাল ডঃ সি ভি আনন্দ বোস ভারতের জাতীয় পতাকা উন্মোচন করে আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ করবেন। জাতীয় সংগীতের সুরে মুখরিত হয়ে উঠবে সেই বিশেষ মুহূর্ত।
আজকের দিনে রেড রোডে উপস্থিত সকলে সাক্ষী থাকবেন অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন পুষ্পবৃষ্টির। রাজ্য সরকারের হেলিকপ্টার আকাশপথে পুষ্পবৃষ্টি করে ঐতিহাসিক রেড রোডের কুচকাওয়াজের অঙ্গন আজ ফুলে ফুলে ভরিয়ে তুলবে।
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ
কুচকাওয়াজের অন্যতম অঙ্গ সুর, তাল ও ছন্দের সার্থক সমন্বয়। ভারতীয় স্থল সেনা, বায়ু সেনা ও নৌ সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের জোয়ানরা এবং রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত আধিকারিকরা পাইপস অ্যান্ড ড্রামস সহযোগে রেড রোডের বুকে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ পরিবেশন করবেন। নিয়ম মেনে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের অভিবাদন গ্রহণ করবেন মাননীয় রাজ্যপাল ডঃ সি ভি আনন্দ বোস। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত সামরিক ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে ভারতীয় সেনার ভাণ্ডারে থাকা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র একের পর এক প্রদর্শিত হবে রেড রোড অঙ্গনে। কলকাতা পুলিশের অশ্বারোহী বাহিনীর অশ্বক্ষুরধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে কলকাতার রেড রোড। মহিলা ৱ্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স এবং উইনার্স টিম দ্বারা প্রদর্শিত হবে ‘নারী শক্তি'। এছাড়াও এই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করবে ১৭টি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা।
ট্যাবলো প্রদর্শন
এই বছর রেড রোডের শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চলেছে মোট তিনটি ট্যাবলো। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং যুব কল্যাণ দপ্তরের অগ্রগতির ধারা কিভাবে এগিয়ে চলেছে তারই পরিচয় বহনকারী দুটি ট্যাবলো থাকছে এবারের শোভাযাত্রায়।
এছাড়াও এবারে দুর্গাপূজার একটি সুদৃশ্য ট্যাবলো প্রদর্শিত হবে রেড রোডের বুকে। দুর্গাপূজা বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে এক বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে। ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটির স্বীকৃতি প্রাপ্ত কলকাতার দুর্গাপূজা বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ এবং আজ গোটা বিশ্বের গর্ব। এই স্বীকৃতি পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণীষে সংযোজন করেছে একটি নতুন রঙিন পালক।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সংস্কৃতির পীঠস্থান বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার লোকশিল্প বাংলার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এই বছর সারা রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা লোকপ্রসার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত লোকশিল্পীরা তাদের কৃষ্টি পরিবেশন করবেন সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য থেকে শুরু করে কোচবিহার জেলার রাজবংশী শিল্পীদের ভাওয়াইয়া গান, দার্জিলিং-এর দৃষ্টিনন্দন কুকরি নৃত্য এবং অগণিত বাউলদের সমবেত কণ্ঠে কোরাস, সব মিলিয়ে আজ এই প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে মুখরিত হয়ে উঠবে রেড রোড অঙ্গন।
পরিসমাপ্তি
আজ এই বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের পরিসমাপ্তিতে আবারও বেজে উঠবে জাতীয় সংগীতের সুর, যা আজও প্রত্যেকটি ভারতবাসীর গায়ে কাঁটার সঞ্চার করে। রেড রোড অঙ্গনে উপস্থিত সকলে উঠে দাঁড়িয়ে প্রণত হবে ভারত মাতার প্রতি, জাতীয় সংগীতের প্রতি, জাতীয় পতাকার প্রতি।
সমগ্র দেশবাসীকে জানাই ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
প্রজাতন্ত্র দিবসের এই শুভ দিনে চলুন আমরা শপথ গ্রহণ করি যে আমরা আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের নীতি ও আমাদের আইনকে সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণ করব।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.