BengaliBengali FestivalsFEATUREDTravel and Living

পয়লা বৈশাখ- বাংলার এক মহা উৎসব

“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।
এসো এসো…”

চৈত্রের অবসানে পুরাতন বর্ষ হল শেষ, শুরু হল আরও এক নতুন বর্ষ। ‘পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি’-র অন্তিম প্রহরের অবসান ঘটিয়ে পূর্ব দিগন্তে উদীয়মান সূর্য এক নতুন পথের দিশায় আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলে। নববর্ষ পুরাতন সমস্ত দুঃখ, বেদনা ও গ্লানি ভুলিয়ে সূচনা করে এক নতুন জীবনের।

আজ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বাঙালির বর্ষবরণের এই মহা উৎসব সম্বন্ধে কিছু বিশেষ তথ্য রইল আপনাদের জন্য।

পয়লা বৈশাখের ইতিহাস

সৌর পঞ্জিকা, যা সূর্যের উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে, সেই পঞ্জিকা অনুযায়ীই বাংলার বারো মাস নির্ধারিত হয়েছে এবং এই পঞ্জিকার প্রথম মাস অর্থাৎ বৈশাখ মাস শুরু হয় গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। ভারতবর্ষের পশ্চিমবাংলা সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বহু আগে থেকেই সৌর বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটিকে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহাসমারোহে পালন করার রীতি চলে এসেছে। যদিও এখন দিন বদলের পালায় য়লা বৈশাখ একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, কিন্তু পূর্বে এটি একটি ঋতুকালীন উৎসব হিসেবে পালিত হত। সেই সময় বলতে গেলে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুই হয়নি। তাই কৃষকরা কৃষিকাজের জন্য সম্পূর্ণ ঋতুর উপর নির্ভরশীল ছিল। এই কারণে সেই সময় পয়লা বৈশাখের মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ।

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে মুঘলদের প্রভাব

কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিকবিদদের মতে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তক সপ্তম শতকের বাংলার হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। কিন্তু পরবর্তীকালে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠতা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট আকবর এই বর্ষপঞ্জির পরিবর্তন করে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আকবরের পূর্বে অন্যান্য মুঘল সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু এই পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভর করে তৈরি হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে এর কোন মিল ছিল না। এরফলে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে অসুবিধায় পড়তে হত। এই কারণেই আকবর প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কার করার আদেশ দেন। সম্রাটের রাজসভার জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সন চালু করেন।

আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময়কাল থেকে এই নতুন গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়। এই সময় সংশোধিত নতুন বাংলা সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’, যা পরবর্তীকালে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলাবর্ষ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

আকবরের শাসনামল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন প্রজারা তাদের সমস্ত খাজনা পরিশোধ করে দিতেন। তার পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন ভূস্বামীরা তাদের এলাকার সমস্ত মানুষদের মিষ্টি মুখ করিয়ে এই উৎসব পালন করতেন। এই দিনে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা অর্থাৎ নতুন হিসাবের বই তৈরি করা হত, সেই নিয়ম আজও প্রচলিত  আছে।

নীতিশ সেনগুপ্তর বক্তব্য অনুযায়ী ‘বাংলার দিনপঞ্জির প্রচলন যিনিই করে থাকুন না কেন, ঐতিহ্যবাহী বাংলা দিনপঞ্জির উপর ভিত্তি করে বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর রাজস্ব আদায়ের জন্য এটা সহায়ক ছিল।’

হিন্দু তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলা নববর্ষের ইতিহাস

ঐতিহাসিকবিদদের মতানুসারে পয়লা বৈশাখ উৎসবটি হিন্দু নববর্ষের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি বৈশাখী নামে পরিচিত। ভারতবর্ষের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে নববর্ষের উৎসব হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জি অনুযায়ী পালিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নামানুসারে এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছিল।

বাংলা নববর্ষের আধুনিক ইতিহাস

১৯১৭ সালে প্রথম আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই বছর পয়লা বৈশাখের দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিজয় কামনা করে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমসাময়িক কালে পশ্চিমবাংলা সহ অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিরা প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের দিন বর্ষবরণের উৎসব পালন করতেন, যা আজও নিয়ম ও নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি বাঙালি পালন করে চলেছেন।

পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

পয়লা বৈশাখ প্রতিটি বাঙালির বাঙালি সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সাথে একাকার হয়ে আছে এই দিনটির মাহাত্ম্য। আশার আলো নিয়ে প্রতি বছর এই দিনটি আমাদের ক্লান্ত, শ্রান্ত জীবনে আনে নতুন রঙিন ছোঁয়া। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে এই দিনটি হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।

বাংলায় পয়লা বৈশাখ উদযাপন

বঙ্গাব্দের প্রথম দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের এই বিশেষ দিনটিতে ভারতবর্ষের পশ্চিমবাংলায় বসবাসরত প্রতিটি বাঙালির মনে ধ্বনিত হয় নব জীবনের সঙ্গীত। ঘরে ঘরে বর্ষবরণের উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে নয় থেকে নব্বই সকলে। সৌর পঞ্জিকা অনুসারে পশ্চিমবাংলায় ইংরেজির এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে মহা সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় পয়লা বৈশাখ।

কিছু কিছু বাঙালি পরিবার বর্ষশেষের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অম্ল ও তেতো ব্যঞ্জন আহারে গ্রহণ করেন। মনে করা হয় এর মাধ্যমে সম্পর্কের সমস্ত তিক্ততা ও অম্লতা দূর হয়ে যায়। আর বছরের পয়লা দিনটিকে প্রত্যেক বাঙালি বিশেষভাবে পালন করেন। নববর্ষের সুপ্রভাতে বাঙালি পরিবারের প্রতিটি সদস্য স্নান সেরে দেব-দেবীর আরাধনা করেন। এরপর ছোটরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের প্ৰণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। বাড়ির গৃহিণীরা সকাল থেকে পঞ্চব্যঞ্জন রন্ধনে নিজেদের মন নিবিষ্ট করেন। আটপৌরে কাপড় ছেড়ে নতুন জামা কাপড়ে সেজে ওঠে প্রত্যেকটি বাঙালি পরিবার। এই দিনটিতে প্রত্যেক বাঙালি তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হয়ে পানাহারে মেতে ওঠে।

যদিও সমগ্র চৈত্র মাস জুড়ে চলতে থেকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিনে চড়কপূজা হয় অর্থাৎ শিবের উপাসনা করা হয়। সেই উপলক্ষ্যে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করা হয় চড়ক মেলা। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় গাজন।

নববর্ষের পূর্বে আরও এক বিশেষ আকর্ষণ হল চৈত্র সেল। চৈত্র মাসে জামা কাপড়ের দোকানে দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। আর এই কারণেই সারা চৈত্র মাস জুড়ে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে নতুন জামা কাপড় কেনার জন্য মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় এই দোকানগুলিতে।

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত নানান সংগঠনগুলি পয়লা বৈশাখের এই বিশেষ দিনে প্রভাতফেরীর আয়োজন করে। নৃত্য ও গীতে মুখরিত হয়ে ওঠে এই প্রভাতফেরী।

এই সময় পল্লি ও শহরাঞ্চলে শুরু হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সারা বৈশাখ মাস জুড়ে চলে। বিচিত্র আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনা-বেচা চলে এখানে। দূর-দূরান্ত থেকে এই মেলায় উপস্থিত হন বাড়ির বয়স্ক সদস্য থেকে শুরু করে খুদেদের দল।

আজকের দিনে অনেক বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে দেবী লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা করা হয় এবং নতুন হালখাতা তৈরি হয়। সেই উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের মিষ্টান্ন সহযোগে আপ্যায়ন করেন।

এছাড়াও নববর্ষের দিনে নাটক, যাত্রাপালা ও নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলার সর্বত্রই এক মধুর প্রীতিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

একই উৎসব ভিন্ন নাম

পয়লা বৈশাখের এই একই দিনে পশ্চিমবাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের আরও কিছু কিছু রাজ্যে ভিন্ন নামে পালিত হয় বর্ষবরণের এই মহা উৎসব।

বৈশাখী

পাঞ্জাবে পয়লা বৈশাখের এই দিনে পালন করা হয় বৈশাখী উৎসব। হিন্দু বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে উদযাপিত হয় বৈশাখী। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা তাদের নিজস্ব নিয়মানুসারে এই ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবটিকে মহাসমারোহে পালন করেন।

রঙ্গোলি বিহু

নতুন বছরের সূচনার এই দিনটি আসামে রঙ্গোলি বিহু বা বোহাগ বিহু নামে পালিত হয়। হিন্দু ও বৌদ্ধ বর্ষপঞ্জির সংমিশ্রণে নির্মিত হয়েছে অহমীয়া বর্ষপঞ্জি। আসামের বর্ষবরণের এই উৎসবটি মূলত ধান উৎপাদনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জুর শীতল

বর্ষবরণের এই বিশেষ দিনটিকে বিহারের মূলত মৈথিলী সম্প্রদায়ের মানুষেরা জুর শীতল উৎসব নামে পালন করেন। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১৪ই এপ্রিল মৈথিলী সম্প্রদায়ের নতুন বছরের সূচনার দিন। 

বর্তমানে নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতায় কোথায় যেন বর্ষবরণের এই উৎসবে প্রীতিময় আন্তরিকতা হ্রাস পেয়েছে, এই উৎসবকে যেন গ্রাস করেছে কৃত্রিমতা। এই উৎসব হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র একটি হৃদয়হীন আচার-অনুষ্ঠানের উৎসব, যেখানে মুষ্টিমেয় ধনী সম্প্রদায়ের ভোগবিলাসের সংকীর্ণ উল্লাসই শুধু চোখে পড়ে।

আসুন আমরা ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতের সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করে নববর্ষের সেই হৃত-গৌরব ফিরিয়ে নিয়ে আসি। আমরা সকলে সকলের জন্য যেন এটাই কামনা করি যে নববর্ষ আমাদের সকলের জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে আমার সকল পাঠক পাঠিকাদের জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

Author

Moumita Sadhukhan

A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation. 

Please share your valuable comments and feedback

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from Kuntala's Travel Blog

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading